জ্বি-না।
দেখে কেমন-কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে অসুস্থ। গায়ে কি জ্বর আছে?
জ্বি-না।
রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল?
না, তবে দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
কী দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?
অমর বাবু ইতস্তত করে বললেন, দেখলাম শূন্যে ভাসছি।
আরে ভাই এটা কি দুঃস্বপ্ন? শূন্যে ভাসা, আকাশে উড়ে যাওয়া–এইসব স্বপ্ন তো আমি রোজই দেখি। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি অনেক উঁচু থেকে ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেছি, খুজব টেনশানের স্বপ্ন।
অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, ঠিক স্বপ্ন না, মনে হয় জাগ্রত অবস্থায় দেখেছি।
কী বললেন? জাগ্রত অবস্থায়? জেগে জেগে দেখলেন আপনি শূন্যে ভাসছেন?
জি।
জাগ্রত অবস্থায় দেখলেন শূন্যে ভাসছেন?
অমর বাবু জবাব দিলেন না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন। ইদরিস সাহেব বললেন, রাত-দিন সায়েন্স সায়েন্স করে আপনার মাথা ইয়ে হয়ে গেছে। বিশ্রাম দরকার। আপনি এক কাজ করুন— ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যান। আজ ক্লাস নেয়ার দরকার নেই। আমি হেড স্যারকে বলে আসি?
না না, আমার শরীর ঠিকই আছে।
অমর বাবু যথারীতি ক্লাসে গেলেন। তাঁর পড়াবার কথা আলোর ধর্ম। তিনি শুরু করলেন মাধ্যাকর্ষণ।
দুটি বস্তু আছে। একটির ভর m; অন্যটির ভর m; তাদের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে তাহলে মাধ্যাকর্ষণ বলের পরিমাণ হবে
(m1m2)/r
এটি একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। স্যার আইজাক নিউটনের বিখ্যাত সূত্র। এর কোনো নড়চড় হবে না। হতে পারে না। বাবারা বুঝতে পারছ?
ছেলেরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। আজ পড়াবার কথা আলোর ধর্ম, প্রতিফলন, প্রতিসরণ; স্যার মাধ্যাকর্ষণ পড়াচ্ছেন কেন?
বাবারা কি বলছি বুঝতে পারছ?
ছাত্ররা জবাব দিল না।
যদি কেউ বুঝতে না পার হাত তোল।
কেউ হাত তুলল না। একসময় ঘণ্টা পড়ে গেল। কোনোদিনও যা হয় না তাই হলো। অমর বাবু ঘণ্টা পড়ার পরেও চুপচাপ বসে রইলেন। পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখলেন না বা উঠেও গেলেন না। চোখ বন্ধ করে মূর্তির মতো বসে রইলেন। ছাত্রদের বিস্ময়ের কোনো সীমা রইল না।
.
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অমর বাবু স্কুল লাইব্রেরিতে বসে আছেন। হাতে একটা বই। নাম– মৌমাছিদের বিচিত্র জীবন। পড়তে বড় ভালো লাগছে। কত ক্ষুদ্র প্রাণী অথচ কী অসম্ভব বুদ্ধি! কী অসম্ভব জ্ঞান! মৌচাকের ভেতরের তাপমাত্রা তারা একটা নির্দিষ্ট স্থানে স্থির করে রাখে। বাড়তেও দেয় না, কমতেও দেয় না। এই কাজটা তারা করে অতি দ্রুত পাখা কাঁপিয়ে। তাপমাত্রা এক হাজার ভাগের এক ভাগ বেশ-কম হয় না। মানুষের পক্ষেও যা বেশ কঠিন।
তিনি রাত আটটার দিকে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। শরীরটা ভালো লাগছে না। একটু জ্বর জ্বর লাগছে। টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দিয়ে গেছে। তিনি কিছু খাবেন না বলে ঠিক করলেন। না খাওয়াই ভালো হবে। অনেক সময় পেটের গণ্ডগোল থেকে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়। তাতে আজেবাজে স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটা ঘটতে পারে। না খেলে তা হবে না। লেবুর শরবত বানিয়ে এক গ্লাস শরবত খেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়লেন।
কাল শীত শীত লাগছিল, আজ আবার গরম লাগছে। জানালা খোলা, সামান্য বাতাস আসছে। সেই বাতাস মশারির ভেতর ঢুকছে না। তিনি মশারি খুলে ফেললেন। মশা কামড়াবে। কামড়াক। গরমের চেয়ে মশার কামড় খাওয়া ভালো।
মশারি খুলে ফেলে বিছানায় শোয়া মাত্র আবার গত রাতের মতো হলো। তিনি ধীরে ধীরে শূন্যে উঠে যেতে লাগলেন। দেখতে-দেখতে তার মাথা ঘরের ছাদ স্পর্শ করল।
তিনি হাত দিয়ে সেই ছাদে ধাক্কা দেয়া মাত্র খানিকটা নিচে নেমে আবার উপরে উঠতে লাগলেন। একী অদ্ভুত কাণ্ড! আবারো কি স্বপ্ন? না, স্বপ্ন না। আজকেরটা স্বপ্ন না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তার উপর কাজ করছে না। পৃথিবীর ভর যদি হয় m1 তিনি যদি হন m2 এবং তাঁর ভর m2 যদি হয় শূন্য তাহলে মাধ্যাকর্ষণ বল হবে শূন্য। তাঁর ভর কি এখন শূন্য? তিনি পাশ ফিরলেন, শরীরটা চমৎকারভাবে ঘুরে গেল। সাঁতার কাটার মতো করলেন। তেমন লাভ হলো না। যেখানে ছিলেন সেখানেই রইলেন। এটাই স্বাভাবিক, বাতাস অতি হালকা। হালকা বাতাসে সাঁতার কাটা যাবে না।
ব্যাখ্যা কী? এর ব্যাখ্যা কী? একটা মানুষের ভর হঠাৎ শূন্য হয়ে যেতে পারে না। নিচে নামার উপায় কী? মনে-মনে আমি যদি চিন্তা করি নিচে নামব তাহলে কি নিচে নামতে পারব? তিনি মনে-মনে চিন্তা করলেন— নেমে যাচ্ছি, দ্রুত নেমে যাচ্ছি। লাভ হলো না। যেখানে ছিলে সেখানেই রইলেন।
আচ্ছা তিনি যদি থুথু ফেলেন তাহলে থুথুটার কী হবে? মাটিতে পড়ে যাবে না শূন্যে ঝুলতে থাকবে? তিনি থুথু ফেললেন। খুব স্বাভাবিকভাবে থুথু মাটিতে পড়ল। গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে ছেড়ে দিলে সেটিও কি শূন্যে ভাসতে থাকবে? না-কি নিচে পড়ে যাবে? অতি সহজেই এই পরীক্ষা করা যায়। তিনি গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফেললেন। ছেড়ে দিতেই দ্রুত তা নিচে নেমে গেল। তার মানে এই অদ্ভুত ব্যাপাটির সঙ্গে শুধুমাত্র তিনিই জড়িত। তার গায়ের পোশাকের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। তিনি চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছেন মাধ্যাকর্ষণ বল যদি হয় F তাহলে–
F=(m1m2)/ r^2
m1 পৃথিবীর ভর। m2 তাঁর নিজের ভর। r হচ্ছে তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব। m2 যদি ‘0’ হয়, F হবে শূন্য। কিংবা r যদি হয় অসীম তাহলেও F হবে ‘0’ কোনো বিচিত্রি কারণে কি তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব অসীম হয়ে যাচ্ছে? ভাবতে ভাবতে অমর বাবুর ঘুম পেয়ে গেল। একসময় মাটি থেকে ছফুট উঁচুতে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর ঘুম। তার নাকও ডাকতে লাগল। ঘুমের মধ্যেই তিনি পাশ ফিরে শুলেন। কোনো রকম অসুবিধা হলো না।