অপরাধী শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। তার লাঞ্ছনা দেখে অন্য কেউ হয়তো ফিক করে হেসে ফেলল। অমর স্যার থমথমে গলায় বলবেন, ও-কি! তুমি হাসছ কেন? হাস্যকর কিছু কি বলেছি? তুমি উঠে দাঁড়াও। অকারণে হাসার জন্যে শাস্তি হিসেবে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবে।
অমর বাবু পকেট থেকে ঘড়ি বের করবেন। পাঁচ মিনিট তিনি একদৃষ্টিতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইবেন। ছাত্ররা মূর্তির মতো বসে থাকবে।
.
অমর বাবুর বয়স পঞ্চাশ। স্ত্রী, দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে–এই নিয়ে তাঁর সংসার। দুটি ছেলেই বড় হয়েছে–রূপেশ্বর বাজারে একজনের কাপড়ের ব্যবসা, অন্যজনের ফার্মেসি আছে। ভালো টাকা রোজগার করে। একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। অন্য মেয়েটির বিয়ের কথা হচ্ছে। এদের কারোর সঙ্গেই তাঁর বনে না। স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদের তিনি সহ্য করতে পারেন না। অনেক দিন হলো বাড়িতেও থাকেন না। স্কুলের দোতলায় একটা খালি ঘরে বাস করেন। সেখানে বিছানা বালিশ আছে। একটা স্টোভ আছে। গভীর রাতে স্টোভে চা বানিয়ে খান।
রূপেশ্বর স্কুলের হেড স্যার তাঁকে বলেছিলেন, আপনার ঘর-সংসার থাকতে আপনি স্কুলে থাকেন, এটা কেমন কথা?
অমর বাবু গম্ভীর গলায় বললেন, রাত জেগে পড়াশোনা করি, একা থাকতেই ভালো লাগে। তা ছাড়া ওদের সঙ্গে আমার বনে না। তবে স্কুলে রাত্রিযাপন করে যদি আপনাদের অসুবিধার কারণ ঘটিয়ে থাকি তাহলে আমাকে সরাসরি বলুন, আমি ভিন্ন ব্যবস্থা দেখি।
হেড স্যার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আরে না–এই কথা হচ্ছে না। আপনার যেখানে ভালো লাগবে আপনি সেখানে থাকবেন।
তিনি অমর বাবুকে ঘটালেন না। কারণ, অমর বাবু অসম্ভব ভালো শিক্ষক। অঙ্কের ডুবোজাহাজ! ডুবোজাহাজ বলার অর্থ তাকে দেখে মনে হয় না তিনি অঙ্ক জানেন। ভাবুক ভাবুক ভাব আছে। ক্লাসে কোনো অঙ্ক তাকে করতে দিলে এমন ভাব করেন যেন অঙ্কটা মাথাতেই ঢুকছে না। তারপর পকেট থেকে গোল ঘড়ি বের করে ঘড়ির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, চোখ বন্ধ করে মুখেমুখে অঙ্কটা করে দেন। স্কুলের অনেক ছাত্রের ধারণা এই ঘড়িতে রহস্য আছে। ঘড়ি অঙ্ক করে দেয়। ব্যাপার তা নয়। তাঁর ঘড়ির সেকেণ্ডের কাটাটায় গণ্ডগোল আছে। কখনো দ্রুত যায় কখনো আস্তে তবে গড়ে সমান থাকে। এইটাই তিনি মাঝে মাঝে পরীক্ষা করেন।
অমর বাবুকে ভালো মানুষ বলা যেতে পারে তবে তিনি অমিশুক, কথাবার্তা প্রায় বলেন না বললেই হয়। কারোর সাতে-পাঁচেও থাকেন না। টিচার্স কমন রুমে জানালার পাশের চেয়ারটায় চুপচাপ বসে থাকেন। ঘণ্টা পড়লে ক্লাসে রওনা হন। স্কুলের আরবি শিক্ষক মৌলানা ইদরিস আলি তাঁকে নিয়ে মাঝেমধ্যে ঠাট্টা-তামাশা করার চেষ্টা করেন। বিশেষ লাভ হয় না। তিনি ঠাট্টাতামাশা পছন্দ করেন না। কেউ ঠাট্টা করলে কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকেন।
আজ বৃহস্পতিবার, হাফ স্কুল। আগামী কাল ছুটি। ছাত্র-শিক্ষক সবার মধ্যেই একটা ছুটি ছুটি ভাব চলে এসেছে। থার্ড পিরিয়ডে অমর বাবুর ক্লাস নেই। তিনি জানালার কাছের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছেন। ইদরিস সাহেব তার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, তারপর অমর বাবু, আপনার সায়েন্সের কী খবর?
অমর বাবু কিছু বললেন না, তবে চোখ তুলে তাকালেন। মনে-মনে রসিকতার জন্যে প্রস্তুত হলেন। বিজ্ঞান নিয়ে এই লোকটি কঠিন রসিকতা করে যা তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না।
ইদরিস সাহেব পানের কৌটা থেকে পান বের করতে করতে বললেন, অনেকদিন থেকে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছে। রোজই ভাবি আপনাকে জিজ্ঞেস করব।
জিজ্ঞেস করলেই পারেন।
ভরসা হয় না। আপনি তো আবার প্রশ্ন করলে রেগে যান।
বিজ্ঞান নিয়ে রসিকতা করলে রাগি। এমনিতে রাগী না–আপনার প্রশ্নটা কী?
ইদরিস সাহেব পান চিবুতে চিবুতে বললেন, পৃথিবী যে ঘুরছে এই নিয়ে প্রশ্ন। পৃথিবী তো ঘুরছে, তাই না?
জি। পৃথিবীর দুরকম গতি–নিজের অক্ষের উপর ঘুরছে, আবার সূর্যের চারদিকে ঘুরছে।
বাঁই বাঁই করে ঘুরছে?
জি?
তাই যদি হয় তাহলে আমাদের মাথা কেন ঘুরে না? মাথা ঘোরা উচিত ছিল না? এমনিতে তো মাঠে দুটা চক্কর দিলে মাথা ঘুরতে থাকে। ওকি, এ-রকম করে তাকাচ্ছেন কেন? রাগ করছেন না-কি?
বিজ্ঞান নিয়ে রসিকতা আমি পছন্দ করি না।
রসিকতা কি করলাম?
অমর বাবু মোর চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। ঘণ্টা পড়বার আগেই ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এই তার নিয়ম। পৃথিবী কোনো কারণে হঠাৎ উল্টে গেলেও নিয়মের ব্যতিক্রম হবে না।
আজ পড়ার বিষয়বস্তু হলো আলো। আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ। বড় চমৎকার বিষয়। আলো হচ্ছে একই সঙ্গে তরঙ্গ ও বস্তু। কী অসাধারণ ব্যাপার। ক্লাস টেনের ছেলেগুলি অবিশ্যি এসব বুঝবে না। তবে বড় হয়ে যখন পড়বে তখন চমৎকৃত হবে।
অমর বাবু ক্লাসে ঢুকেই বললেন, আলোর গতিবেগ কত— কে বলতে পার? সাতজন ছেলে হাত তুলল। তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল। তার ধারণা ছিল সবাই হাত তুলবে। ছেলেগুলি কি সায়েন্সে মজা পাচ্ছে না? তা কি করে হয়? পৃথিবীতে মজার বিষয় তো একটাই। সায়েন্স।
তুমি বল, আলোর গতিবেগ কত?
প্রতি সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল।
ভেরি গুড। এখন তুমি বল, আলোর গতি কি এর চেয়ে বেশি হতে পারে?