বুঝতে পারছি। আমি রেজিগনেশন লেটার দিয়ে কাল সকালে দেশে চলে যাব। দয়া করে আমাকে গাছ থেকে নামানোর ব্যবস্থা করুন।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে ইয়াকুব সাহেব এসে পড়লেন।
ততক্ষণে আরও বহু লোক জড়ো হয়েছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা চলে এসেছে।
বেজায় হৈচৈ।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, আমার ছাত্র গোবরের কারণে এই লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে। সে তার জন্যে সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। এক্ষুনি সে হেডস্যারকে গাছ থেকে নামাবে।
সবাই হতভম্ব হয়ে দেখল হেডস্যার পাখির পালকের মতো খুব ধীরে ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে আসছেন। সেক্রেটারি সাহেব এই দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না। মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন।
এমন অস্বাভাবিক ঘটনা কিভাবে ঘটছে কেউ কিছু বুঝতে পারল না। ব্যাপারটা বুঝতে ইয়াকুব সাহেবের সপ্তাহখানেক সময় লাগল। একটা ভূতের বাচ্চা তার সঙ্গে বাস করছে এবং ব্যায়াম শিখছে এটা চট করে বিশ্বাস করার কথাও না আবার কাণ্ডকারখানা চোখের সামনে ঘটতে দেখা যাচ্ছে। শুরুতে গোবরকে সবাই ভয়ে ভয়ে দেখত-শেষে অভ্যস্ত হয়ে গেল। এক রবিবার সকালে ইয়াকুব সাহেব তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
পড়াশোনায় গোবর তেমন ভাল ছিল না, তবে ম্যাট্রিক এক চান্সেই পাস করল। যদিও পরীক্ষার সময় বেশ সমস্যা হয়েছিল। ইনভিজিলেটর এসে দেখেন একজন পরীক্ষার্থীর খাতায় আপনা-আপনি কলম দিয়ে লেখা হচ্ছে কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তিনি কিছুক্ষণ দৃশ্যটি দেখলেন, তার পরেই মাথা ঘুরে নিচে পড়ে গেলেন। মাথায় পানি ঢেলে তাকে সুস্থ করা হলো। ধারণা করা হয়েছিল বিষয়টা নিয়ে তিনি খুব হৈচৈ করবেন। তা করলেন না। কোনো প্রশ্নও করলেন না।
গোবরের খুব শখ ছিল কলেজে পড়বে। হেডমাস্টার সাহেব চেষ্টাও করেছিলেন। নিজে সঙ্গে গিয়ে অনেক কলেজে যোরাঘুরি করেছেন। সব কলেজের প্রিন্সিপালরা যেই শুনেছেন তিনি একটা ভূতকে কলেজে ভর্তি করাতে চান ওমি হেডমাস্টার সাহেবকে বের করে দিয়েছেন। তাঁর কোনো কথাই শুনতে চান নি। গোবর মনে খুব কষ্ট পেল। মনের কষ্ট আরও বাড়ল যখন ইয়াকুব সাহেব মারা গেলেন। তিনদিনের জ্বরে হঠাৎ মৃত্যু। চিকিৎসা করার সুযোগও ছিল না। ইয়াকুব সাহেবের মৃত্যুর পর গোবর বেচারা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল। দিনরাত আমগাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকত। তার বাবা-মার সঙ্গেও গোবরের বনে নি। তারা ফিরে এসেছিলেন–গোবরের ম্যাট্রিক পাস করা নিয়ে অসম্ভব বিরক্ত হলেন। তুই ভূত সমাজের কলংক-এই বলে তারা অনেক দূরে কোথাও চলে গেলেন।
নীলগঞ্জের মানুষজন গোবরের কারণে খুব সুখে দিন কাটাত। চোর-ডাকাতের কোনো উপদ্রব ছিল না। নীলগঞ্জ থানার বড় দারোগা সাহেবের কাজের অভাবে কোমরে বাত হয়ে গেল। একবার চেয়ারে বসলে উঠতে পারেন না। উঠলে বসতে পারেন না এমন অবস্থা। চোর-ডাকাত ভুলেও নীলগঞ্জে আসে না। হঠাৎ একজন মনের ভুলে চলে সে। গোবর তখন তাকে ধরে খুব উঁচু কোনো সুপারি গাছে বসিয়ে ওসি সাহেবকে খবর দেয়। ওসি সাহেব বিরস মুখে বলেন, কে, গোবর?
জি।
আবার ধরেছিস?
জি।
সুপারি গাছের মাথায় রেখে দিয়েছিস?
জি।
এই কাণ্ডটা তুই কেন করিস বল তো? বর্ষার দিন, স্লিপ কেটে যদি সুপারি গাছ থেকে পড়ে কোমর ভাঙে তাহলে তো তুই বিপদে পড়বি। তিনশ দুই ধারায় কেইস হয়ে যাবে। তোকে কোমরে দড়ি বেঁধে কোর্টে চালান করতে হবে। আইনের চোখে ভূত-প্রেত সব সমান বুঝলি?
আর করব না স্যার।
ওসি সাহেব মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলেন, তুই বড় যন্ত্রণা করিস। তোকে স্নেহ করি বলে কিছু বলি না। এখন না বলে পারছি না। সাবধান হয়ে যা।
.
গোবর এখনো বেঁচে আছে। তবে বুড়ো হয়ে গেছে। আগের মতো শক্তি-সামর্থ্য নেই। আমগাছে বসে দিনরাত ঝিমায়। মাঝেমাঝে আফসোসের সঙ্গে বলে–এই যুগের পড়াশোনার মান খুব নিচে নেমে গেছে। সামান্য সমাস তাও পারে না। রসগোল্লার ব্যাসবাক্য কি–রসের গোল্লা না রসে ডুবানো গোল্লা তাও জানে না। বড়ই পরিতাপের বিষয়। বড়ই আফসোস। সামান্য একটা দরখাস্ত সেটাও ইংরেজিতে লিখতে পারে না। আফসোস। বড়ই আফসোস।
আমের সময় ছোট ছোট বাচ্চারা গাছের নিচে ভিড় করে। তারা খুব ঘ্যানঘ্যান করে–গোবর চাচা, গোবর চাচা, আম পেড়ে দাও না।
গোবর প্রচণ্ড ধমক দেয়–ভাগ, ঘুমের সময় বিরক্ত করিস না। মারব থাপ্পড়।
বাচ্চারা তারপরেও বিরক্ত করে, তারা জানে গোবর চাচা কখনো তাদের থাপ্পড় মারবে না। এক সময় আম পেড়ে দেবে। কারণ গোবর চাচা তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভূত।
নিউটনের ভুল সূত্র
রূপেশ্বর নিউ মডেল হাইস্কুলের সায়েন্স টিচার হচ্ছেন অমর বাবু।
অমর নাথ পাল, বি.এসসি. (অনার্স, গোল্ড মেডাল)।
খুব সিরিয়াস ধরনের শিক্ষক। স্কুলের স্যারদের আসল নামের বাইরে একটা নকল নাম থাকে। ছাত্র মহলে সেই নামেই তাঁরা পরিচিত হন। অমর বাবু স্কুলে ঘড়ি স্যার নামে পরিচিত। তাঁর বুক পকেটে একটা গোল ঘড়ি আছে। ক্লাসে ঢোকার আগে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নেন। ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ামাত্র আবার ঘড়ি বের করে সময় দেখেন। তখন যদি তাঁর ভুরু কুচকে যায় তাহলে বুঝতে হবে ঘণ্টা ঠিকমতো পড়েনি। দুএক মিনিট এদিক-ওদিক হয়েছে।
তার ক্লাসে নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হবে। হাসা যাবে না, পেনসিল দিয়ে পাশের ছেলের পিঠে খোঁচা দেয়া চলবে না, খাতায় কাটাকুটি খেলা চলবে না। মনের ভুলেও যদি কেউ হেসে ফেলে তিনি হতভম্ব চোখে তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলবেন, সায়েন্স ছেলেখেলা নয়। হাসাহাসির কোনো ব্যাপার এর মধ্যে নেইৗয়েন্স পড়াবার সময় তুমি হেসেছ, তার মানে বিজ্ঞানকে তুমি উপহাস করেছ। মহা অন্যায় করেছ। তার জন্যে শাস্তি হবে। আজ ক্লাস শেষ হবার প্রবাড়ি যাবে না। পাটীগণিতের সাত প্রশ্নমালার ১৭, ১৮, ১৯ এই তিনটি অঙ্ক করে বাড়ি যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?