সেক্রেটারি সাহেব সব শুনে হাসতে হাসতে বললেন, ইয়াকুব সাহেব আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করেছেন।
ঠাট্টা?
অবশ্যই ঠাট্টা। আপনি উনাকে পাগল ভাবেন, এই জন্যেই পাগলের মতো কথাবার্তা বলে উনি আপনাকে ভড়কে দিয়েছেন। জোনাকি পোকার আলো খাচ্ছে তার ছাত্র–এই সব তো ঠাট্টার কথা, এটও বুঝেন না? আমার কি মনে হয় জানেন? আমার মনে হয়, আপনি এক ধরনের স্নায়বিক উত্তেজনায় ভুগছেন। এই কথা বলায় কিছু মনে করবেন না।
জি না, কিছু মনে করছি না।
আপনি ইয়াকুব সাহেবকে খবর দিয়ে স্কুলে আনুন। উনাকে আগের মতো ক্লাস নিতে দিন। দেখবেন উনি আর ঠাট্টা-তামাশা করছেন না।
জি আচ্ছা।
হেডস্যার ইয়াকুব সাহেবকে খবর দিয়ে স্কুলে আনলেন। যথারীতি ক্লাস নিতে বললেন। একবার ভাবলেন জোনাকি পোকার আলো খাওয়ার ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করবেন। শেষটায় বাদ দিলেন। দরকার কি ঝামেলায়। বরং দুএকটা সামাজিক দ্রতার কথা বলাই ভালো। হেডস্যার বললেন, ইয়াকুব সাহেব, আছেন কেমন?
জি ভালো আছি। তবে খুব ব্যস্ত।
ব্যস্ত কেন?
ছাত্র একটা আছে, ব্যায়াম শেখাচ্ছি।
কোন ছাত্র? গোবর যার নাম?
জি। একটা বইও লিখছি।
ব্যায়ামের বই?
বইয়ের কি নাম?
ভূতদের সহজ ব্যায়াম শিক্ষা।
কি বললেন–ভূতদের সহজ ব্যায়াম শিক্ষা?
জি। আমাদের জীবনে যেমন ব্যায়ামের প্রয়োজন আছে, ভূতদেরও আছে।
তা তো বটেই। আপনার ধারণা-এই বই পড়ে ভূতরা সব ব্যায়াম শিখবে?
তা শিখবে। ওদের শেখার আগ্রহ খুব বেশি।
হেডস্যার অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। একজন বৃদ্ধ উন্মাদের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলা উচিত না। কি থেকে কি হয়ে যায় কে জানে। হঠাৎ খ্যাক করে কামড়ে ধরতে পারে। এদের কাছ থেকে যতটা দূরে থাকা যায় ততই ভালো।
.
গোবরের ব্যায়াম শিক্ষা পুরোদমে চলছে। ফ্রি হ্যাঁন্ড এক্সারসাইজ, যোগ ব্যায়ম কোনোটাই বাদ যাচ্ছে না। ইয়াকুব সাহেব ঘরে রিং টানিয়ে দিয়েছেন। রিং-এর খেলাও হয়। জানা গেছে গোবর লম্বায় একটু খাটো। রিং টানাটানিতে যদি খানিকটা লম্বা হয়।
খাওয়া-দাওয়ার দিকে তিনি খুব লক্ষ রাখছেন। নানান ধরনের আলোর ব্যবস্থা করেছেন–মোমবাতির আলো, ঘিয়ের প্রদীপের আলো, তিসির তেলের আলো, জোনাকির আলো। টর্চ লাইটের আলো আছে। তবে এই আলো গোবরের সহ্য হয় না। খাওয়া মাত্র বমি হয়ে যায়।
গোবরের স্বাস্থ্য কতটা ভালো হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। ওজন বাড়ল কি-না ধরতে পারছেন না, কারণ ভূতদের ওজন নেই। হাত-পা মোটা মোটা হলো কি-না তাও বোঝা যাচ্ছে না। কারণ ভূতদের দেখা যায় না।
একদিন সন্ধ্যার কথা। ইয়াকুব সাহেব ভূতদের সহজ ব্যায়াম শিক্ষা বইটার সেকেন্ড ট্যাপ্টার লিখছেন–গোবর এসে তার পা ছুঁয়ে সালাম করে দাঁড়াল। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কি ব্যাপার?
গোবার ফিসফিস করে বলল, আমার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে স্যার।
ইয়াকুব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে কি করে বুঝলে?
গোবর ক্ষীণ স্বরে বলল, এখন মানুষকে ভয় দেখাতে পারি।
সে কি! কাকে ভয় দেখালে?
হেডস্যারকে।
ইয়াকুব সাহেব মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, তাকে কিভাবে ভয় দেখিয়েছ?
গোবর মিনমিন করে বলল, তাকে একটা সুপারি গাছের মাথায় বসিয়ে রেখেছি। গাছে বসে তিনি চিৎকার করছেন।
ইয়াকুব সাহেব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, কখন করলে এই কাজ?
কিছুক্ষণ আগে।
আর কখনো এই কাজ করবে না। কখনো না। হেড মাস্টার সাহেব বিশিষ্ট ভ ভদ্রলোক। স্কুলঅন্তপ্রাণ। তাকে ভয় দেখানো অমার্জনীয় অপরাধ হয়েছে। আমি খুব রাগ করেছি। সেই সঙ্গে ব্যথিত হয়েছি।
গোবর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মানুষদের ভয় দেখাতেই হয়। এটা ভূতদের নিয়ম।
ভয় যদি দেখাতেই হয় দুষ্টু লোকদের ভয় দেখাবে। ধরো, ডাকাত এসেছে গ্রামে, ডাকাতদের ভয় দেখাও। চোর এসেছে, চোরদের ভয় দেখাও। দেশে দুষ্ট মানুষের তো অভাব নেই।
আর করব না স্যার।
শুধু স্বাস্থ্য ভালো করলে তো চলবে না। স্বাস্থ্যের সঙ্গে ন্যায়-নীতি শিখতে হবে। আদব-কায়দা শিখতে হবে। আমি তো ঠিক করেছি হেডস্যারকে বলে তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। আজ যা কাণ্ড করেছ তাতে হেডস্যার রাজি হবেন কিনা কে জানে। দুষ্টু ছাত্ৰ হেডস্যারের চোখের বিষ। তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে, বুঝলে?
জি স্যার, বুঝেছি।
কোন্ গাছে হেডস্যারকে বসিয়ে রেখেছে? চলো যাই উনাকে নামিয়ে নিয়ে আসি। একা একা নামতে পারবে না। সুপারি গাছ থেকে নামা কঠিন ব্যাপার।
স্কুল সেক্রেটারির বাসার ঠিক সামনের সুপারি গাছের মাথায় হেডস্যার বসে আছেন। কিছুক্ষণ পরপর চিৎকার করছেন–বাঁচাও, বাঁচাও।
সেক্রেটারি সাহেব দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হলেন। অবাক হয়ে বললেন, গাছে কে?
আমি নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেডমাস্টার।
গাছে বসে কি করছেন?
কিছু করছি না, শুধু বসে আছি।
গাছে উঠলেন কিভাবে?
জানি না।
জানি না মানে?
গাছে উঠেছেন, তারপর বলছেন জানেন না কিভাবে উঠেছেন?
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি গাছে বসে আছি।
নেমে আসুন। আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।
নামতে পারছি না। কি করে নামতে হয় জানি না।
আপনার যে মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে বুঝতে পারছেন?
পারছি।
আপনি শিক্ষক হিসেবে খুবই ভালো। কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন বিকৃতমস্তিষ্ক শিক্ষক রাখা সম্ভব না।