হুঁ
হুঁ না, বলো জি। এটা হলো দ্রতা। দ্রতা শিখতে হবে। খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
না।
এ তো কোনো কাজের কথা না। এখনো জ্যোৎস্না আছে, যাও খেয়ে আসো।
ক্ষিদে নেই।
ক্ষিদে নেই বললে শুনব না। স্বাস্থ্য রক্ষার প্রধান নিয়ম হলো সময়মত খাওয়া দাওয়া করা। যাও বললাম, একটা মোড়া নিয়ে উঠানে গিয়ে বসো। আরাম করে চাঁদের আলো খাও। তোমাদের খাওয়ার নিয়ম-কানুন তো আমি ঠিক জানি না। চাঁদের আলো কেমন করে খাও? চিবিয়ে খাও না গিলে ফেলো?
সবাই চিবিয়ে খায়। আমি কুঁৎ করে গিলে ফেলি। ভালো লাগে না তো, এই জন্যে।
অসম্ভব, এখন থেকে গেলা চলবে না। একগাল করে চাঁদের আলো মুখে নেবে, বত্রিশ বার করে চিবুবে। এতে হজম ভালো হয়। বুঝলে?
হুঁ।
আবার হুঁ? বলো জি।
জি।
নাম কি তোমার?
ৎৎঘুঁৎ!
এই নাম তো উচ্চারণ করা সম্ভব না। তোমার নাম আমি দিলাম গোবর।
গোবর?
শুনেই আঁৎকে উঠলে। বিখ্যাত কুস্তিগীর গোবার পালোয়নের নামে তোমার নাম দিলাম। গোবার বাবু ১৯২০ সনে কুস্তিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ান হয়েছিলেন। বাঙালি ছেলে। ইংল্যান্ড, আমেরিকার সব বাঘা বাঘা কুস্তিগীরকে কুপোকাৎ করেছিলেন। তোমাকেও তাই হতে হবে। তুমি হবে ভূত-সমাজের গোবর বাবু। বুঝলে?
গোবর বাবু হতে চাই না।
চাইলেও হতে হবে। তোমাকে আমি গোবর বানিয়ে ছাড়ব। বুঝলে?
জি।
ব্যায়াম শুরু হবে কাল সকাল থেকে। চার্ট করে দেব। রুটিন দেখে দেখে ব্যায়াম হবে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা নিয়েও আমি চিন্তা করব। কোন খাবারটা তোমার সবচে প্রিয়?
জোনাকি পোকার আলো।
আচ্ছা, জোনাকি পোকা কয়েকটা ধরে আনার চেষ্টা করব। আর শোনো, খাটের নিচে শোয়ার দরকার নেই। আমার সঙ্গেই ঘুমুবে। খাট বড় আছে, অসুবিধা হবে না। তোমরা কি দাঁত মাজ?
অন্যরা মাজে। আমি মাজি না, ভালো লাগে না।
তোমাকে দাঁত মাজতে হবে। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে একবার, ঘুম থেকে উঠার পর একবার।
জি আচ্ছা।
ইয়াকুব সাহেব রাতে ঘুমুতে গেলেন। ঘুম খুব ভালো হলো না। তার পাশে একটা ভূতের বাচ্চা শুয়ে আছে। তাকে দেখা যাচ্ছে না তবে সে যে আছে তা বোঝা যাচ্ছে। ভূতদের ব্যায়াম কিভাবে করতে হয় তিনি জানেন না। আস্তে আস্তে জানবেন। একটা বই লেখার চিন্তাও মাথায় ঘুরতে লাগল। বইটার নাম হবে–ভূতদের সহজ ব্যায়াম শিক্ষা।
স্কুল কমিটির বৈঠকে হেড স্যার খুব জোরালো বক্তব্য রাখলেন। বক্তব্যের বিষয়বস্তু হচ্ছে, একজন পাগল শিক্ষককে স্কুলে রাখার কোনো মানে হয় না। সে স্কুলের প্রতি হুমকি স্বরূপ। তাকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য করা উচিত। ইত্যাদি।
স্কুলের সেক্রেটারি আজমল সাহেব বললেন, ইয়াকুব স্যারকে তো আমি চিনি। আমার শিক্ষক ছিলেন। অতি ভালো মানুষ। তাকে পাগল বলছেন কেন? কি পাগলামি উনি করেছেন?
উনি ঘাস খাচ্ছেন।
ঘাস খেতে যদি উনার ভালো লাগে, খাবেন। শাকসবজি আমরা খাই না? কাঁচা লেটুস পাতা খাই, কি-খাই না? উনি হয়তো খোঁজ পেয়েছেন যে ঘাসে কোন নতুন ভাইটামিন আছে যা অন্য কিছুতে নেই। এতে পাগলামির কি দেখলেন? তেমন কোনো ভিটামিনের সন্ধান পাওয়া গেলে আমার তো মনে হয় আমাদের সবারই ঘাস খাওয়া উচিত।
হেডস্যার বললেন, ঘাস খাওয়া ছাড়াও সারাক্ষণ ব্যায়াম ব্যায়াম করেন।
তা তো করবেনই। তিনি হচ্ছেন ব্যায়ামের শিক্ষক। উনি ব্যায়াম ব্যায়াম করবেন? যিনি অংকের শিক্ষক তিনি করবেন অংক অংক। যিনি গানের শিক্ষক তিনি গান নিয়ে মাতামাতি করবেন। এ ছাড়া উনি আর কি করেছেন যার থেকে আপনার ধারণা হয়েছে উনি পাগল?
এস. এস. সি. পরীক্ষার কোচিং হচ্ছিল, উনি বললেন ব্যায়ামেরও কোচিং দরকার।
আমার তো মনে হয় অতি উত্তম কথা বলেছেন। পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপের মধ্যে শরীরটা ঠিক রাখতে হবে। রুগ্ণ শরীর পড়াশোনার চাপ সহ্য করতে পারবে না। আপনি উনাকে বলুন ব্যায়ামের কোচিং শুরু করতে।
হেড স্যার বিমর্ষ গলায় বললেন, জি আচ্ছা, বলব।
আর শুনুন, চট করে একজনকে পাগল বলবেন না। এটা ঠিক না।
হেডস্যার শুকনো মুখে বের হয়ে এলেন। তার মেজাজ খুব খারাপ। বাসায় ফিরছেন। বাসা অনেকখানি দূর। মাইল খানিকেরও বেশি। পোস্টাফিসের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন। অন্ধকারে একটা লোক ঝোঁপের পাশে বসে আছে। হেডস্যার বললেন, কে ওখানে? কে?
স্যার আমি। আমি ইয়াকুব।
ওখানে কি করছেন?
জোনাকি পোকা ধরছি স্যার।
জোনাকি পোকা ধরছেন কেন?
ইয়াকুব সাহেব চুপ করে রইলেন। জবাব দিলেন না। খুকখুক করে দুবার কাশলেন।
কি ব্যাপার, জোনাকি পোকা কেন ধরছেন? খাবেন না-কি?
জি স্যার। তবে পোকা খাওয়া হবে না। পোকার আলো খাওয়া হবে।
কে খাবে, আপনি?
জি না, আমার এক ছাত্র।
ও আচ্ছা। আপনার ছাত্র? তা আলোটা কিভাবে খাবে?
গিলে ফেলা যায়, আবার চিবিয়েও খাওয়া যায়। আমি চিবিয়ে খেতে বলেছি। এতে হজমের সুবিধা। মুখে জারক রসের সঙ্গে আলোটা ভালো করে মিশতে পারে।
নাম কি আপনার ছাত্রের?
ওর নাম গোবর।
হেড স্যার বিস্মিত হয়ে বললেন, গোবর! বাপ-মা নাম রেখেছে গোবর?
জি না, বাপ-মা অন্য নাম রেখেছে। আমি নাম দিয়েছি গোবর।
ভালো করেছেন। খুব ভালো করেছেন। সুন্দর নাম। বিষ্টা হলে আরও ভালো হতো। তা গোবর নামও খারাপ না।
হেডস্যার আর দাঁড়ালেন না। একজন উন্মাদের সঙ্গে বেশি সময় থাকা ঠিক না। মাথার ঠিক নেই কখন কি করে বসবে। স্কুলের সেক্রেটারিকে এই ঘটনার কথা বলতে হবে। তারপরেও যদি উনি মনে করেন ইয়াকুব সাহেব মানসিকভাবে সুস্থ তাহলে ভিন্ন কথা। হেডস্যার আবার সেক্রেটারি সাহেবের বাসায় ফিরে গেলেন। দেরি করে লাভ নেই। আজই বলা যাক।