ইলেকট্রিক বাতির আলো খাওয়া যায় না?
আমরা খাই না। কেউ কেউ খায়। একেবারেই টেস্ট নেই। খেলে এল্যার্জির মতো হয়। হাত-পা ফুলে যায়। তবে স্যার জিনিসটার মধ্যে ভাইটামিন আছে।
ইয়াকুব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, খাওয়া নিয়ে এত বাছবিচার করলে তো চলবে না। সব জিনিস খেতে হবে। এটা খাব ওটা খাব না করলে তো চলবে না।
এটা স্যার আপনি বুঝবেন। সন্তান আপনার হাতে তুলে দিয়েছে। যা করলে ভালো হয় করবেন। প্রয়োজনে শাসন করবেন। ওর স্বাস্থ্য ঠিক না হলে আমার আত্মহত্যা ছাড়া পথ থাকবে না। পানিতে ডুবে মরতে হবে। একজন ভূতের কাছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর চেয়ে অপমানের মৃত্যু আর কিছুতেই হয় না।
ইয়াকুব সাহেব ভূতের কথায় খুব আনন্দ পেলেন। সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে এই উদ্বেগ যদি মানুষদের মধ্যে থাকত তাহলে কত ভালো হতো। বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে বাবা মার যত চিন্তা তার একশ ভাগের এক ভাগ চিন্তাও স্বাস্থ্য নিয়ে নেই। ইংরেজি, অংকের জন্যে প্রাইভেট মাস্টার রাখে অথচ স্বাস্থ্যের জন্যে প্রাইভেট মাস্টার নেই। কি অন্যায়!
জনাব, যদি অনুমতি দেন তাহলে যাই।
যাবেন?
আমাকে তুমি করে বলবেন স্যার। আপনি বলে অধমকে লজ্জা দেবেন না।
ভূতের বিনয়ও তাঁর ভালো লাগল। বিনয় নামক ব্যাপারটা তো দেশ থেকে উঠেই যাচ্ছে। এটাও দুঃখের কথা। তবে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন কিনা তাও তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। স্বপ্ন হতে পারে, আবার উত্তেজিত মস্তিষ্কের কল্পনাও হতে পারে। ইয়াকুব সাহেব গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, আচ্ছা, ছেলেকে রেখে যাও, দেখি কি করতে পারি।
স্যার, আপনার অসীম দয়া। মনে বড় শান্তি পেলাম। ছেলেটাকে আরও আগেই আপনার কাছে আনা উচিত ছিল। আগে আনলে স্বাস্থ্যটা ইতোমধ্যে অনেকখানি ভালো হতো। মানুষজনকে ভয় দেখাতে শুরু করতে পারত।
ইয়াকুব সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ভয় দেখানো মানে?
ভূতের প্রধান কাজই তো ভয় দেখানো। আমরা করি কি স্যার সুযোগ পেলেই মানুষকে ভয় দেখাই। তা আমার ছেলে ভয় দেখাবে কি-সে নিজেই ভয়ে অস্থির। কি লজ্জার কথা ভেবে দেখুন। ভূতের ছেলে অথচ ভয় দেখাতে পারছে না। ঐদিন কি হলো শুনুন। রাত দশটার মতো বাজে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আপনাদের স্কুলের হেডস্যার ছাতা মাথায় দিয়ে বাজারে যাচ্ছেন। আমি ছেলেকে বললাম, বাপধন, একটা কাজ কর তো, পেছন থেকে গিয়ে হেডস্যারের ছাতাটা টেনে ধর। দেখ, উনি কেমন ভয় পান। তা ছেলে এই কাজ করবে না। তার সাহস নেই। বুক নাকি ধড়ফড় করে। কি লজ্জার কথা! আমার ছেলের এই হল সাহসের নমুনা।
তোমার বুঝি খুব সাহস?
নিজের কথা নিজের মুখে বলা ঠিক না, আত্মপ্রশংসা হয়। তবে স্যার আপনাদের দশজনের দোয়ায় হাজার হাজার মানুষকে ভয় দেখিয়েছি। নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেবকে কি আপনার মনে আছে? ইয়া জোয়ান। ভূত-প্রেত কিছুই বিশ্বাস করেন না। অসীম সাহস। এমন ভয় দেখিয়েছি তাঁকে যে একেবারে হার্ট অ্যাটাকের মতো হয়ে গিয়েছিল। ঘটনাটা আপনাকে সংক্ষেপে বলি–ওসি সাহেব রাত একটার সময় দলবল নিয়ে আসামি ধরতে যাচ্ছেন, সাহসী লোক তো–আগে আগে যাচ্ছেন। আমি করলাম কি, ঠিক তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, কেমন আছেন ওসি সাহেব?
ওসি সাহেব চমকে উঠে বললেন, কে, কে? কে কথা বলল?
আমি তখন তার অন্য কানের কাছে মুখ নিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো আদুরে গলায় বললাম, এই খোকাবাবু গু খাবে?
ওসি সাহেব সঙ্গে সঙ্গে ফিট। সেটা একটা দেখার মতো দৃশ্য। হা হা হা। মনে হলেই আনন্দ হয়।
ইয়াকুব সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কাজটা কি ঠিক হলো? এটা তো অদ্রতা। শুধু অদ্ৰতা না অসভ্যতাও। আমার কাছে থাকলে তো এসব চলবে না। আচার ব্যবহারও শিখতে হবে।
আপনি যা বলবেন তাই। আপনি দয়াপরবশ হয়ে আপনার চরণ কমলে আমার ছেলেটাকে আশ্রয় দিয়েছেন-এই যথেষ্ট। আপনার হাতে ছেড়ে দিয়েছি। এখন তাহলে স্যার যাই। যাবার আগে একটা কথা নিবেদন করতে চাই স্যার।
নিবেদন করো।
আমার সন্তানকে চরণে আশ্রয় দিয়েছেন এই জন্যে সামান্য উপহার দিতে চাই।
কি উপহার?
এক কলসি সোনার মোহর। বাদশাহ জাহাঙ্গীর আমলের। কলসিটা কোথায় তা আছে আপনাকে দেখিয়ে দেব, আপনি তুলে নেবেন।
এইসব লাগবে না। সামান্য কাজের জন্য আমি অর্থ গ্রহণ করি না।
আপনি এই কথা বলবেন আমি জানতাম। যাই স্যার।
আমগাছের ডালে একটা প্রবল ঝাঁকুনি হলো। তারপর চারদিকে নিঃশব্দ। ইয়াকুব সাহেব বললেন, কেউ আছে?
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
এই যে ভূতের ছেলে, তুমি কি আছ? তোমার নাম তো জানা হলো না?
কোনো উত্তর নেই। তিনি নিশ্চিত হলেন যে এতক্ষণ যা ঘটেছে সবই কল্পনা। কল্পনা ছাড়া কিছুই না। মাথা গরম হয়েছিল তাই এইসব দেখেছেন।
তিনি ঘরে ঢুকে খেতে বসলেন। তখনই ঘটনাটা ঘটল। তিনি দেখলেন পানি ভর্তি একটা গ্লাস ভাসতে ভাসতে তার দিকে আসছে। তার থালার পাশে এসে গ্লাসটা আপনাআপনি থেমে গেল। সুন্দর করে বসে গেল থালার পাশে। ইয়াকুব সাহেবের গা খানিকটা কেঁপে উঠল। বুক ধকধক করতে লাগল। এই জাতীয় দৃশ্য আগে দেখেন নি। কখনো দেখবেন তাও ভাবেন নি। ভূতের বাচ্চাটা তাহলে যায় নি। আছে। ঘরেই আছে। তিনি চাপা গলায় বললেন, তুমি আছ?