কি বললেন স্যার?
আপনি আর স্কুলে আসবেন না। আমার ধারণা আপনার ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেছে। আপনার স্কুলে আসা মানে স্কুলের জন্য সমস্যা। আমি স্কুল কমিটিতে বিষয়টি তুলব। তারা যা সিদ্ধান্ত নেয় নেবে।
স্কুলে না এসে আমি করবটা কি স্যার?
বাড়িতে বসে ব্যায়াম-কবিতা লিখবেন এবং ঘাসের চাটনি খাবেন। এখন আমার সামনে থেকে যান। এ কি, খাতা না নিয়ে চলে যাচ্ছেন কেন? খাতা নিয়ে যান।
তিনি বাড়িতে চলে এলেন। মন অসম্ভব খারাপ। বয়স কম হলে চিৎকার করে কাঁদতেন। এই বয়সে চিৎকার করে কাঁদা মানায় না বলে কাঁদতেও পারছেন না। সত্যি সত্যি চাকরি চলে গেলে গভীর সমুদ্রে পড়তে হবে। খাবেন কি?
ঘাসের চাটনি জিনিসটা বলকারক হলে অতি অখাদ্য। কষটা তিতকুটে ভাব আছে। মুখে নিলেই বমি ভাব হয়, নাড়িভুড়ি উল্টে আসে। এই বস্তু খেয়ে জীবনধারণ করা নিতান্তই অসম্ভব। প্রাইভেট টিউশানিও যে করবেন সে উপায় নেই। কে আর ব্যায়ামের জন্যে প্রাইভেট টিউটর রাখবে?
তিনি দুপুরে কিছু খেলেন না। রাতেও কিছু খাবেন না বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। শেষমেশ ক্ষিদের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে খিচুড়ি রাঁধতে বসলেন। ভোলা উনুনে রান্না হচ্ছে। তিনি দরজার দিকে পেছনে ফিরে বসেছেন, হঠাৎ মনে হলো কে যেন দরজার পাশে এসে দাঁড়াল। চিকন গলায় বলল, জনাব আপনার সঙ্গে কি একটা কথা বলব?
ইয়াকুব আলি বললেন, কে?
আমাকে তো জনাব চিনবেন না। যদিও আমি আপনার প্রতিবেশী।
খিচুড়ি ধরে গিয়েছে। চামচ দিয়ে প্রবল বেগে নাড়তে হচ্ছে বলে ইয়াকুব সাহেব দরজার দিকে তাকাতে পারছেন না। খিচুড়ি নাড়তে নাড়তে বললেন, কোন বাড়িতে থাকেন, বলুন। বললেই চিনব। আমি তো জনাব কোনো বাড়িতে থাকি না, আম গাছে থাকি। আপনার বাসার পেছনে যে আমগাছ আছে ঐ আমগাছে থাকি।
আম গাছে থাকেন মানে? আপনি কে?
আমি স্যার একজন ভূত।
ইয়াকুব সাহেবের মনে হলো তিনি কানে ভুল শুনেছেন। ভূত আবার কি? ভূত প্রেত থাকে বাচ্চাদের রূপকথার বই-এ। নিশ্চয়ই কোনো দুষ্ট ছেলে ফাজলামি করছে। তিনি খিচুড়ির হাঁড়ি চুলা থেকে নামিয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। চারদিকে ফকফক চাঁদের আলো। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। এটা কি স্বপ্ন স্বপ্ন হওয়া তো সম্ভব না। স্বপ্নে গন্ধ পাওয়া যায় না। তিনি খিচুড়ির গন্ধ পাচ্ছেন। খিচুড়ি ধরে গেছে। সেই ধরা খিচুড়ির পোড়া পোড়া গন্ধ।
ইয়াকুব সাহেব ভূতে বিশ্বাস করেন না, তবু তার গা ছমছম করতে লাগল। এসব কি হচ্ছে? তিনি কাঁপা গলায় বললেন, কে? কে কথা বলছিল?
জি জনাব, আমি। আপনার পাশেই আছি। অদৃশ্য হয়ে আছি তো, এই জন্যে দেখতে পাচ্ছেন না। বড় আশা করে আপনার কাছে এসেছি, জনাব। অধীনকে নিরাশ করবেন না।
বাতাসের সঙ্গে কথা বলার কোনো মানে হয় না। তার যা করা উচিত তা হচ্ছে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খেতে বসা। তবু তিনি নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, আমার কাছে কি ব্যাপার?
আমার সন্তানটাকে আপনার দরবারে নিয়ে এসেছি জনাব। বড় আশা করে এনেছি।
কি জন্যে এনেছেন?
ওর স্বাস্থ্যটা খুবই খারাপ। যদি দয়া করে তার শরীরটা ঠিক করে দেন। ব্যায়াম ট্যায়াম করান। এই বিষয়ে আপনার চেয়ে ভালো তো কেউ জানে না। আপনি হচ্ছেন বিশেষজ্ঞ অতি ওস্তাদলোক।
ইয়াকুব সাহেব মনে মনে খুশি হলেন। যা ঘটছে তা স্বপ্ন না চোখের ভুল তিনি জানেন না। তবু তো তাকে ব্যায়াম বিষয়ে কিছু ভাল কথা বলছে। এইটাইবা কে বলে?
স্যার, একটু দয়া করুন, মা-হারা সন্তান।
তিনি চমকে উঠলেন। ভূতদেরও মৃত্যু হয়। মানুষ মরে ভূত হয় শুনেছেন, ভূত মরে কি হয়?
ইয়াকুব সাহেব গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, এই ছেলের মাতা কি গত হয়েছেন?
জি না স্যার, পালিয়ে গেছে। দুর্বল পাতলা ছেলে দেশে মনের দুঃখে দেশান্তরী হয়েছে। ভূত-সমাজে এরকম ছেলে জন্মে দিলে মার অপমান। সবাই ছিঃ ছিঃ করে। এখন যদি স্যার আপনি আপনার চরণ কমলে অধীনের সন্তানকে ঠাঁই দেন–মনটা শান্ত হয়। আমি ছেলের মার সন্ধানে যেতে পারি। ছেলেকে নিয়ে আপনার কোনো চিন্তা করতে হবে না স্যার। ছেলে নম্র-ভদ্র। আপনার খাটের নিচে শুয়ে থাকবে। ছোটখাটো কাজকর্ম করে দেবে।
কি কাজকর্ম করে দেবে?
এই ধরুন এক গ্লাস পানি আনা, থালা-বাসন ধোয়া। ভারী কাজ পারবে না স্যার। শরীর দুর্বল।
শরীর দুর্বল হলো কেন?
খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করে না। না খেলে শরীরে বল হয়? স্যার আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি, আপনি বলুন। এই বিষয়ে আপনার চেয়ে বেশি কে জানে? এই যে রোজ বিকেলে দুচামচ করে ঘাসের চাটনি খাচ্ছেন, কি জন্যে খাচ্ছেন? শরীর ঠিক রাখার জন্যই তো খাচ্ছেন। জিনিসটা যে খেতে কি খারাপ সে তো খাবার সময় আপনার মুখ দেখেই বুঝতে পারি। ছেলেকে কত বার বলেছি এই লোকটাকে দেখে শেখ–স্বাস্থ্যের জন্য কত কষ্ট করতে হয়।
ইয়াকুব সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ভূতদের খাদ্য কি?
আমাদের খাদ্য হলো স্যার-আলো। চাঁদের আলো। সূর্যের আলোও খাওয়া যায় তবে সহজে হজম হয় না। তারার আলো, মোমবাতির আলো–এইগুলো খুব ভালো। খেতে স্বাদ আছে। সহজে হজম হয়। বিশেষ করে মোমবাতির আলো তো খুবই উপকারী। তা স্যার মোমবাতির আলো তো আজকাল পাওয়াই যায় না। সব জায়গায় ইলেকট্রিক বাতি।