কেউ বলতে পারল না। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, সামান্য জিনিস বলতে পারছিস না? অংক হচ্ছে মাথার ব্যায়াম। তাহলে ব্যায়াম কত রকমের হলোর দুরকম। শরীরের ব্যায়াম এবং মাথার ব্যায়াম। শরীরের ব্যায়ম ক ধরনের হয় তোরা জানিস? তোদের ক্লাসে ফার্স্ট বয় কে উঠে দাঁড়া দেখি?
ফার্স্ট বয় উঠে দাঁড়াল। ইয়াকুব সাহেব হতাশ গলায় বললেন, ও-কি, এমন বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়েছিস কেন? সোজা হয়ে দাঁড়া। বুক টান করে দাঁড়া। বুক টান করে দাঁড়ানোও এক ধরনের এক্সারসাইজ।
ভাগ অংক কিছুই করা হলো না। পুরো এক ঘণ্টা চলে গেল। ইয়াকুব স্যার জলের মতো বুঝিয়ে দিলেন বুকটান করে দাঁড়ানোর কি উপকারিতা। এতে ফুসফুসের কি হয়-এই সব।
ক্লাসের শেষে তিনি কমন রুমে এসে বসেছেন, হেডস্যার ডেকে পাঠালেন। থমথমে গলায় বললেন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনার পড়ানো শুনছিলাম। এক সময় শুনি আপনি গান গাচ্ছেন। এর মানে কি?
ইয়াকুব সাহেব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, গান না স্যার। যোগ ব্যায়াম নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম। ছাত্রদের পড়ে শুনালাম। এই কবিতাটা গানের সুরে পড়তে হয়। তাই নিয়ম।
অংকের ক্লাসে আপনি যোগ ব্যায়ামের কবিতা পড়াচ্ছেন, এর মানে কি?
ইয়াকুব সাহেব মাথা চুলকাতে লাগলেন। হেড স্যার কঠিন স্বরে বললেন, আমার তো ধারণা আপনার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।
খারাপ হয় নি, স্যার।
আপনি বললে তো হবে না, আমরা দশজন যা দেখছি তাতে আমাদের ধারণা হয়েছে, আপনার মাথা পুরো এলোমলো অবস্থায় আছে। সবাই আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করে এটা জানেন?
জি না।
তা তো জানবেনই না। আপনাকে নিয়ে যে হাসি-তামাশা হয় তা বোঝার মতো বুদ্ধিও তো আপনার নেই। শুনছি ইদানীং না-কি ঘাস খাচ্ছেন। এটা কি সত্যি?
ইয়াকুব সাহেব জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। তাঁর নীরবতার কারণ হচ্ছে ঘাস খাওয়ার ব্যাপারটা সত্যি। তার ধারণা হয়েছে ঘাসে প্রচুর ভিটামিন। সেই ভিটামিন কাজে লাগানো যায় কি-না তা পরীক্ষা করে দেখছেন। আধাসের কচি ঘাসে এক তোলা সোডা দিয়ে ঘন্টা খানিক জ্বাল দিয়েছেন। থকথকে সবুজ জেলির মতো একটা বস্তু তৈরি হয়েছে। রোজ বিকেলে চিনি দিয়ে তিনি সেই বস্তু দুচামচ করে খান।
কি, কথা বলছেন না কেন? ঘাস খাচ্ছেন না-কি?
জি স্যার, খাচ্ছি?
খেতে কেমন?
খেতে ভালো না, তবে বলকারক।
হেডস্যার থমথমে গলায় বললেন, লোকে যখন জানবে এই স্কুলের একজন প্রবীণ শিক্ষক রোজ ঘাস খাচ্ছেন তখন স্কুল সম্পর্কে তাদের কি ধারণা হবে বলুন দেখি?
আপনি যদি নিষেধ করেন তাহলে আর খাব না।
na, আমি নিষেধ করব না। আপনার ইচ্ছা হলে ঘাস খাবেন, কাঁঠাল পাতা খাবেন, কচুরিপানা খাবেন। আপনি খাবেন রুচিমত–আমি সেখানে বলার কে? তবে ঢাকঢোল পিটিয়ে খাবেন না। গোপনে খাবেন।
জি আচ্ছা।
শুধু একটা কথা আপনাকে বলি–ব্যায়াম নিয়ে হৈচৈ করবেন না। স্কুল পড়াশোনার জায়গা। কুস্তির আখড়া না। ব্যায়াম প্রসঙ্গে একটি কথাও যেন আর না শুনি।
বই কি লিখতে পারব স্যার?
কি বই?
ছোটদের ব্যায়ামের অ আ ক খ।
আপনি আমার সামনে থেকে যান।
তিনি বিষণ্ণ মুখে বের হয়ে এলেন। তাঁর মনটা ভেঙে গেল। রোজ যথানিয়মে স্কুলে যান। টিচার্স কমন রুমে চুপচাপ বসে থাকেন। বিকেলে বাসায় ফিরে আসেন। তাঁকে কোনো ক্লাস দেয়া হয় না। এমনকি পিটি ক্লাসও না। ব্যায়ামের বইটা লেখার চেষ্টা করেন। লেখা তেমন আগায় না। মন ভার না থাকলে লেখা আসে না।
দেখতে দেখতে ম্যাট্রিক পরীক্ষা এসে গেল। কোচিং ক্লাস শুরু হয়েছে। রোজ তিন ঘণ্টার কোচিং-ইংরেজি, অংক, ইলেকটিভ অংক, বিজ্ঞান। স্কুলের গত বছরের রেজাল্ট খারাপ হয়েছে, এবার যেন খারাপ না হয়।
এই সময় ইয়াকুব সাহেব এক কাণ্ড করলেন। এক সকালে হেড স্যারের ঘরে উঁকি। দিয়ে বললেন, স্যার আসব?
জরুরি কিছু না থাকলে আসবেন না। কাজ করছি।
খুব জরুরি।
আসুন। বলুন কি ব্যাপার?
ইয়াকুব সাহেব হড়বড় করে বললেন–ম্যাট্রিকের ছাত্রদের তো কোচিং হচ্ছে। আমি ভাবছিলাম এই সঙ্গে এক ঘণ্টা ব্যায়ামের কোচিং দিয়ে দিলে খুব ভালো হয়।
হেডস্যার হতভম্ব হয়ে বললেন, ব্যায়ামের কোচিং মানে? কি বলছেন আপনি?
ছাত্রদের এক ঘন্টা করে ব্যায়াম করা। ফ্রি হ্যাঁন্ড এক্সারসাইজ, বৈঠক, বুকডন আর যোগ ব্যায়াম। যোগ ব্যায়ামের মধ্যে থাকবে–প্রাণায়াম এবং কুম্ভক। সব লিখে এনেছি।
ইয়াকুব আলি সাহেব খাতাটা এগিয়ে দিলেন। খাতায় ছক টেনে সবকিছু লেখা। কোন বারে কি ব্যায়াম, কতক্ষণের ব্যায়াম সব সাজানো আছে।
একেবারে সিলেবাস বানিয়ে নিয়ে এসেছেন?
জি স্যার।
কেন এটা করেছেন জানতে পারি?
পরীক্ষার আগে আগে স্বাস্থ্যটা ঠিক রাখা খুবই জরুরি। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে একটু কঠিন প্রশ্ন দেখলেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবে এবং পরীক্ষার আগের রাতে একশ তিন জ্বর এসে যাবে। এতদিনের পরিশ্রম সব গেল।
হেড স্যার হিমশীতল গলায় বললেন, আপনি কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছেন না–কি?
জি না স্যার, ফাজলামি করব কেন?
আমার তো আপনার কথাবার্তা শুনে সে রকমই ধারণা হচ্ছে।
আপনি যদি উত্তেজিত না হয়ে আমার খাতার ছকগুলি একটু পরীক্ষা করে দেখেন, খুব যত্ন নিয়ে করেছি। প্রচুর মেধা ব্যয় করেছি।
শুনুন ইয়াকুব আলি সাহেব, আপনি আর স্কুলে আসবেন না।