এই তো, এখানে। খুব ভালো খবর এনেছি তোমার জন্যে। তোমার মা ভালো হয়ে গেছেন। এখন ঘুমুচ্ছেন দেখে এসেছি।
নীলুর মনে হলো আনন্দে সে কেঁদে ফেলবে। হইয়ুর বাবা আপন মনে খানিকক্ষণ হেসে বলল, তোমার একটা ফুটফুটে ভাই হয়েছে নীলু। সেও শুয়ে আছে তোমার মার পাশে।
নীলুর কী যে ফুর্তি লাগল! এখন সে একা থাকবে না। এখন তার একটা ভাই হয়েছে। ভাইকে নিয়ে নীলু শুধু খেলবে।
দেখতে দেখতে ভোর হয়ে এলো। গাছে কাক ডাকতে শুরু করেছে।
হইয়ুর বাবা বলল, ও হইয়ু, লক্ষ্মী মনা, ভোর হয়ে আসছে। চল আমরা যাই।
কিন্তু হইয়ু কিছুতেই যাবে না। সে ঘাড় বাকিয়ে বলতে লাগল, আমি যাব না। আমি মানুষের সঙ্গে থাকব। আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।
হইয়ুর বাবা দিল এক ধমক।
হইয়ু কাঁদতে কাঁদতে বলল, তেঁতুলগাছে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে না। আমি নীলুর সঙ্গে থাকব, আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।
কিন্তু সকাল হয়ে আসছে। হইয়ুর বাবাকে চলে যেতেই হবে। সে হইয়ুকে কোলে করে নিয়ে গেল আর হইয়ুর সেকী হাত পা ছোঁড়াছুড়ি, সেকী কান্না!
আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।
আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।
নীলুর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। কান্না পেতে লাগল।
তারপর কী হয়েছে শোনো। নীলুর মা কয়েক দিন পর একটি ছোটমতো খোকা কোলে করে বাসায় এসেছেন। মা হাসি মুখে বললেন, ভাইকে পছন্দ হয়েছে নীলু?
হয়েছে।
বেশ, এবার ছোট ভাইকে দেখাও, জন্মদিনে কী উপহার পেয়েছ। যাও নিয়ে। এসো।
নীলু কী আর করে, নিয়ে এলো তার মাথা নেই পুতুল। মা ভাঙা পুতুল দেখে খুব রাগ করলেন। নীলুকে খুব কড়া গলায় বললেন, নতুন পুতুলটির এই অবস্থা! দুদিনেই ভেঙে ফেলেছ? ছি ছি বলো নীলু, কী করে ভেঙেছ বলো?
নীলু কিছুতেই বলল না, চুপ করে রইল। কারণ সে জানে হইয়ু আর হইয়ুর বাবার কথা বললে মা একটুও বিশ্বাস করবেন না। শুধু বলবেন, এইটুকু মেয়ে কেমন বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলছে।
বড়রা তো কখনো ছোটদের কোনো কথা বিশ্বাস করেন না।
গোবর বাবু
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের ড্রিল স্যারের নাম ইয়াকুব আলি। বয়স পঞ্চাশের উপর। বেঁটে-খাটো মানুষ। সাধারণত ড্রিল স্যারদের স্বাস্থ্য খুব ভালো হয়ে থাকে। ইয়াকুব আলি সাহেব ব্যতিক্রম। ভয়ংকর রোগা। বছরের বেশিরভাগ সময় পেটের অসুখে ভুগেন। যে ঋতুতে সে অসুখটা হওয়ার কথা তাঁর তা হয়। বসন্তকালে চিকেন পক্স কিংবা হাম হয়, বর্ষাকালে ভয়াবহ ধরনের ডায়রিয়া হয়। সারা শীতকাল খকখক করে কাশেন, এই সময় তার হাঁপানির টান ওঠে।
ভদ্রলোক নিতান্তই ভালমানুষ।
জগতের সমস্ত ভালোমানুষরা সরল ধরনের হয়ে থাকেন। ইয়াকুব সাহেব একটু বেশিমাত্রায় সরল। তার মাথায় স্বাস্থ্যরক্ষা অর্থাৎ ব্যায়াম ছাড়া কিছুই ঢুকে না। তিনি দুটি বই লিখেছেন–হাসতে হাসতে ব্যায়াম শিক্ষা এবং ছোটদের সহজ ব্যায়াম। টাকার অভাবে বই দুটি ছাপাতে পারছেন না।
তার বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এঁদের কোনো ছবি নেই। তিনটি বাঁধানো ছবি আছে–একটি গামা পালোয়ানের, একটি শ্যামাকান্তের, অন্যটি ভীম ভবানীর। এ ছাড়াও তার শোবার ঘরে একটা সূচিকর্ম আছে। চারদিকে লতা, ফুল, পাতা, মাঝখানে লেখা, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। সূচিকর্ম তার স্ত্রীর করা। বিয়ের দ্বিতীয় বছরে ভদ্রমহিলা মারা যান। ইয়াকুব সাহেব দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেন নি।
ড্রিল ক্লাসে তিনি ছাত্রদের ব্যায়াম করান কবিতায়। এইসব কবিতা তাঁর নিজের লেখা। গানের মতো সুরে তিন মাত্রায় পড়তে হয়, সেই সঙ্গে ব্যায়াম করতে হয়। একেক ক্লাসের জন্য একেক ধরনের কবিতা। প্রাইমারি সেকশনের জন্য লেখা তার ব্যায়াম কবিতাটা এই রকম,
বায়ু বহে ভীম বেগে শব্দ শন শন।
এইবার দাও দেখি পাঁচ বুক ডন।।
[এইখানে ছাত্ররা পাঁচটা বুক ডন দেবে। বুক ডন শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলবে–]
দেখো দেখো উড়ে যায় সাদা সাদা বক
এইবার দাও দেখি দশ বৈঠক।।
[দশটা বৈঠক দিতে হবে। অতি দ্রুত।]
পাল তুলে চেয়ে দেখ চলে ছোট নাও।
কোমরে হাত রেখে সোজা দৌড়াও।।
[দৌড়ে স্কুলের মাঠে দুটা চক্কর দিতে হবে।]
ইয়াকুব আলি সাহেব নিতান্তই দরিদ্র ব্যক্তি। ড্রিল টিচার হিসেবে স্কুল থেকে সামান্যই বেতন পান। একা মানুষ বলে কষ্টেসৃষ্টে কোনোরকমে চলে যায়। শারীরিক কষ্ট। তার গায়ে লাগে না। তবে কেউ যখন ব্যায়াম বিষয়ে আজেবাজে কথা বলে তখন তার মনটা খুব খারাপ হয়।
আজ তাঁর মনটা খারাপ। শুধু খারাপ বললে কম বলা হবে, খুবই খারাপ। কারণ নীলগঞ্জ স্কুলের হেড স্যার ব্যায়াম নিয়ে তাকে কিছু কটু কথা বলেছেন। অথচ কটু কথা বলার মতো কিছুই তিনি করেন নি। ব্যাপারটা এরকম–তিনি টিচার্স কমন রুমে বসে লিখছিলেন। হেড স্যার ঘরে ঢুকে বললেন, ইয়াকুব সাহেব কি করছেন?
তিনি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, লিখছি স্যার।
কি লিখছেন?
স্যার, একটা গ্রন্থ রচনা করছি–ব্যায়ামের অ আ ক খ।।
হেডস্যার সঙ্গে সঙ্গে মুখ এমন করলেন যেন ব্যায়ামের অ আ ক খ লেখা খুব অন্যায়। তিনি খড়খড়ে গলায় বললেন, ক্লাস থ্রিতে একটু যান তো। ওদের অংক স্যার আসেন নি। ছাত্ররা খুব হৈচৈ করছে। গোটা কয়েক ভাগ অংক দিয়ে বসিয়ে দিন। পারবেন তো?
অবশ্যই পারব, স্যার।
ইয়াকুব সাহেব ক্লাসে গেলেন। রোল কল করে বোর্ডের কাছে চলে গেলেন। বোর্ডে বড় বড় করে লিখলেন–অংক। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, অংক জিনিসটা কি বলো তো?