অধ্যাপক হাসিমুখে বললেন, যদিও বলা হয় আইনস্টাইন পৃথিবী নামক গ্রহে জন্মেছেন আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয় আইনস্টাইন একজন এলিয়েন কারণ তাঁর চিন্তার ধারাটাই এলিয়েনদের মতো। আলোর গতি এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল প্রতি সেকেন্ডে। আইনস্টাইন চিন্তা করলেন তিনি নিজেও আলোর গতিতে আলোর পাশাপাশি ছুটে যাচ্ছেন। তখন তিনি কি দেখবেন? এখন আপনারাই বলুন চিন্তার ধারা এলিয়েন নয়?
আমরা প্রবল হাততালি দিলাম। এক ঘণ্টার বক্তৃতা এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিটে শেষ হলো। আমি মন্ত্রমুগ্ধ। বক্তৃতায় আইনস্টাইনের মহান ভুল নিয়ে একটি কথাও বলা হলো না। শ্রোতাদের একজন এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই অধ্যাপক বললেন, আইনস্টাইনের মহান ভুল হচ্ছে তিনি অনেক আগে থিওরি অব রিলেটিভিটি এবং স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। সব পদার্থবিদের মুক্তচিন্তা আটকে দিয়েছেন। আইনস্টাইন পৃথিবীতে না এলে পদার্থবিদরা নানা দিকে অন্ধের মতো হাতড়াতে থাকতেন। এতে অনেক কিছু বের হয়ে আসতো। তাড়াহুড়া করে থিওরি অব রিলেটিভিটি বের করে ফেলাই হলো আইনস্টাইনের মহান ভুল।
আইনস্টাইন তাঁর সারা জীবনে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে গেছেন। একটি উল্লেখ করি।
“সময় মানুষ তার নিজের সুবিধার জন্য কল্পনা করেছে কারণ মানুষ কখনোই চায়নি তার জীবনের সব ঘটনা একসঙ্গে ঘটে যাক।”
কথাগুলো অস্পষ্ট হেয়ালির মতো লাগছে না? আইনস্টাইন অনেক হেয়ালি কথা বলে গেছেন যদিও তিনি বিশ্বাস করেছেন বিজ্ঞান সমস্ত হেয়ালির ঊর্ধ্বে। তাঁর বিখ্যাত উক্তি_ঈশ্বর পাশা খেলেন না। (God does not play dice.)
পাদটিকা
আইনস্টাইনকে নিয়ে পৃথিবীজুড়েই নানা গল্পগাথা প্রচলিত। এর মধ্যে একটি উল্লেখ করছি।
বালক আইনস্টাইন ছিলেন হাবাগোবা। চার বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কোনো কথা বলেননি। তাঁর বাবা-মা ধরে নিলেন আইনস্টাইন বাকপ্রতিবন্ধী। এক দুপুরে লাঞ্চ খেতে বসে আইনস্টাইন প্রথম কথা বললেন। স্যুপের বাটি সরিয়ে তিনি বললেন, স্যুপটি ঠাণ্ডা।
আইনস্টাইনের মা হতভম্ব গলায় বললেন, তুমি কথা বলতে পার?
আইনস্টাইন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। তার মা বললেন, এতদিন কথা বলনি কেন?
আইনস্টাইন বলেন, এতদিন স্যুপ ঠাণ্ডা ছিল না। কথা বলার প্রয়োজন হয়নি।
ঈর্ষা ও ভালোবাসা
পবিত্র কোরআন শরিফের একটি আয়াতে আল্লাহপাক বলছেন, ‘এবং বেহেশতে তোমরা প্রবেশ করবে ঈর্ষামুক্ত অবস্থায়।’
এর সরল অর্থ-শুধু বেহেশতেই মানুষ ঈর্ষামুক্ত, ধুলা-কাদার পৃথিবীতে নয়। বিস্ময়কর হলেও সত্যি, ঈর্ষা এক অর্থে আমাদের চালিকাশক্তি। মানবসভ্যতার বিকাশের জন্য ঈর্ষার প্রয়োজন আছে। বেহেশতে যেহেতু সভ্যতা বিকাশের কিছু নেই, ঈর্ষারও প্রয়োজন নেই।
আমি নিজেকে ঈর্ষামুক্ত একজন মানুষ ভাবতে পছন্দ করি; যদিও জানি, এই মানবিক দুর্বলতামুক্ত হওয়া মহাপুরুষদের পক্ষেও সম্ভব নয়। একজন মহাপুরুষও ঈর্ষা করবেন আরেকজন মহাপুরুষকে। এটাই নিপাতনে সিদ্ধ।
যা-ই হোক, এক শ্রাবণ মাসের মেঘলা দুপুরে কলকাতার দেশ পত্রিকা খুলে হিংসা নামের সর্পের ছোবল অনুভব করলাম। পত্রিকায় একটি উপন্যাসের সমালোচনা ছাপা হয়েছে। সমালোচক বলছেন, এই উপন্যাসের লেখক বিভূতিভূষণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি। উপন্যাসটির নাম ‘নূরজাহান’। লেখকের নাম
ইমদাদুল হক মিলন। দেশ পত্রিকায় এমন নির্ভেজাল প্রশংসা আমি আর কোনো লেখার হতে দেখিনি।
নূরজাহানের গল্প শেষ করতে মিলন প্রায় তেরো শ পৃষ্ঠা লিখেছেন। বাংলাদেশে এটিই মনে হয় সর্ববৃহৎ উপন্যাস। লেখক হিসেবে জানি একটি গল্পকে তেরো শ পৃষ্ঠা পর্যন্ত টানার অর্থ দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনীর পরিশ্রম, রাত্রি জাগরণ, ক্লান্তি ও হতাশা। হতাশার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি, যেকোনো রচনাতেই লেখকের নানান হতাশা থাকে। গল্পটা যেমন দাঁড় করানো দরকার সে রকম করা গেল না। বিশেষ কোনো চরিত্র আরো স্পষ্ট হওয়া উচিত, তা হলো না, এইসব।
হতাশার সঙ্গে আসে আনন্দ। গল্প শেষ করার আনন্দ। নিজের কথা বলি, মিসির আলি বিষয়ক মাত্র চলি্লশ পৃষ্ঠার একটি বড় গল্প (বৃহল্ললা) শেষ করে আমি গল্প শেষ হওয়ার আনন্দে অভিভূত হয়েছিলাম। নূরজাহান শেষ করে মিলনের আনন্দ নিশ্চয়ই আমার চেয়ে চৌত্রিশ গুণ বেশি হয়েছে। নূরজাহান বৃহল্ললার চেয়ে চৌত্রিশ গুণ বড়। সব লেখকই চান তাঁর নিজের আনন্দের ছায়া পাঠকের মধ্যে পড়ুক। লেখক যেন বুঝতে পারেন তাঁর কষ্ট জলে ভেসে চলে যায়নি।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাংলাদেশে মিলনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কেন জানি ঘটছে না। উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করি। এখন দৈনিক পত্রিকাগুলোর ফ্যাশন হলো সাহিত্য বিচারকের ভূমিকায় অভিনয় করা। এরা বর্ষসেরা উপন্যাস, মননশীল লেখার তালিকা তৈরি করে এবং পাঠকদের ভাবতে বাধ্য করে, এসব রচনাই শ্রেষ্ঠ, বাকি সব আবর্জনা।
কালের কণ্ঠ দশটি সেরা উপন্যাসের তালিকা তৈরি করল, মিলনের নূরজাহান সে তালিকায় নেই। আমি ভাবলাম, মিলন এই পত্রিকায় কাজ করে বলেই হয়তো তার নাম নেই। লোকে না ভেবে বসে তারা নেপোটিজম করছে।
প্রথম আলোর সেরা দশেও মিলন নেই। এতে মিলনের মন খারাপ হয়েছে কি না জানি না, আমি বিরক্ত হয়েছি। মিলনকে ডেকে বলেছি, দৈনিক পত্রিকার সেরা দশের পুরো আয়োজনই ভুয়া। এই সেরা কারা নির্বাচন করেন? তাঁরা কি বছরে প্রকাশিত সব লেখা পড়েন?