এমন ঘটনা বাস্তবে ঘটেনি। মহান কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্পের সারাংশ বলা হলো। গল্পটি ‘উপলখণ্ড’ গল্প সংকলনে আছে। পৃথিবীর কোনো দেশের লেখকরাই বিজ্ঞানীদের বিষয়ে উৎসাহিত বোধ করেননি। একমাত্র আইনস্টাইনের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল সবার কৌতূহলে নাড়া জাগানোর।
সেদিন তেজগাঁও থেকে মালিবাগে যাচ্ছি। চোখে পড়ল বিশাল বিলবোর্ড। সেখানে রিয়েলএস্টেটের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে আইনস্টাইনের ছবি। ছবির নিচে লেখা ‘জমি কিনতে বুদ্ধিমান হোন’ জাতীয় কথা। বুদ্ধিমান হিসেবে আইনস্টাইনের ছবি ছাপা হয়েছে।
আমার শৈশবে আইনস্টাইনকে নিয়ে একটি লেখা পাঠ্য তালিকাভুক্ত ছিল। সচিত্র লেখা। আইনস্টাইন বেহালার বাঙ্ নিয়ে ট্রেন থেকে নেমেছেন এমন ছবি। কাহিনীর বিষয়বস্তু ছিল বেলজিয়ামের রানির আমন্ত্রণে তিনি ট্রেনে করে বেলজিয়াম গিয়েছেন। ট্রেন থেকে নেমে দেখেন তাঁকে নিতে কেউ আসেনি। তিনি একাই হেঁটে হেঁটে রওনা হলেন। বেলজিয়ামের রানি আইনস্টাইনকে নিতে দলবল পাঠিয়েছিলেন ঠিকই। তারা প্রথম শ্রেণীর কামরা খুঁজেছে। তারা কেউ ভাবেনি আইনস্টাইন সাধারণ শ্রেণীতে চলে আসবেন।
আমাদের শৈশবে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের নিয়ম ছিল দেয়ালে মহাপুরুষদের ছবি টানানো। বালক-বালিকারা যেন অল্প বয়সেই মহাপুরুষদের সঙ্গে পরিচিত হয়। তাঁদের মতো হওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের সিলেটের মীরাবাজারের বাসায় মহাপুরুষদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ছাড়া আর যে দুজন ছিলেন তাঁদের একজন আইনস্টাইন অন্যজন জর্জ বার্নড শ। আইনস্টাইনের ছবি আমাকে আকর্ষণ করেনি তবে জর্জ বার্নড শ’র ছবিটি মুগ্ধ করেছিল। ছবিতে বৃদ্ধ এক বুড়োকে লাঠি হাতে তেড়ে আসতে দেখা যাচ্ছিল।
আইনস্টাইনের প্রথম পরিচয় পাই আমার বয়স যখন আঠারো, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রের ছাত্র। অধ্যাপক আলি নওয়াব ক্লাসে পড়াচ্ছেন ভিসকোসিটি। একপর্যায়ে ভিসকোসিটির ইকোয়েশন বোর্ডে লিখে বললেন, এটা আইনস্টাইন ইকোয়েশন। উনি বের করেছেন। আমি অবাক! যে মহা বিজ্ঞানী রিলেটিভিটি বের করেছেন তিনি সামান্য ভিসকোসিটি সমীকরণও বের করেছেন।
পরের বছর পড়লাম আইনস্টাইনের ফটো ইলেকট্রিক অ্যাফেক্ট। এই আবিষ্কারের জন্য তাঁকে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
ফটো ইলেকট্রিক অ্যাফেক্ট বুঝতে আমাদের কোনো সমস্যা হলো না। সূত্রটি জটিল অঙ্কে মোড়ানো না। আলোর কণিকা ধর্ম কিছুটা এলোমেলো ঠেকলেও ছাত্র হিসেবে আমরা আলোর দ্বৈত সত্তার বিষয়টা ততদিনে জানি।
আমার প্রধান আগ্রহ তখন আইনস্টাইনের ভুবন কাঁপানো থিওরি অব রিলেটিভিটি বিষয়ে জানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার কোনো শিক্ষক কি বিষয়টি বোঝাতে পারবেন? একজন নিশ্চিতভাবে পারতেন, অধ্যাপক সত্যেন বসু। তিনি তো বেঁচে নেই। পদার্থবিদ্যার ছাত্র আমার অতি ঘনিষ্ঠজন আনিস সাবেত আমাকে জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্তি্বক পদার্থবিদ্যার মাত্র একজন শিক্ষক থিওরি অব রিলেটিভিটি বোঝেন তাঁর নাম এ এম হারুন-অর-রশিদ। আনিস ভাই আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন, থিওরি অব রিলেটিভিটি বুঝতে চাও কেন?
আমি মাথা চুলকালাম। আসলেই তো কেন বুঝতে চাই? থিওরি অব রিলেটিভিটি বুঝে আমি কি করব?
স্যার বললেন, খুব সাধারণভাবে বিষয়টা বোঝানো যায়। মনে কর তুমি তোমার বান্ধবীর সঙ্গে দুই ঘণ্টা কাটিয়েছ। তোমার কাছে মনে হবে মাত্র দুই মিনিট কাটিয়েছ। আবার অতি বিরক্তির এক বৃদ্ধের সঙ্গে দুই মিনিট কাটালে তোমার কাছে মনে হবে দুই ঘণ্টা কাটিয়েছে। তবে এইসব ব্যাখ্যা কোনো কাজের ব্যাখ্যা না। এইসব হচ্ছে মানসিক ঘটনা। থিওরি অব রিলেটিভিটি কোনো মানসিক ব্যাপার না। প্রকৃত বিজ্ঞান। তুমি পরে এসো আমার কাছে আমি চেষ্টা করব তোমাকে বিষয়টা বোঝাতে। তোমার আগ্রহ দেখে আমি নিজেও আগ্রহ বোধ করছি এই বিষয়ে বাংলায় একটা বই লেখার জন্যে।
তাঁর কাছে পরে আমার আর যাওয়া হয়নি। আমি তাঁকে আমার লেখা একটা সায়েন্স ফিকশন উৎসর্গ করে (ফিহা সমীকরণ) আমেরিকার নর্থ ডাকোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলাম।
পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপে আমি তখন দিশাহারা। মাথা থেকে আইনস্টাইনের ভূত নেমে গেছে। সহজ বাংলায়, ‘কেঁথা পুড়ি থিওরি অব রিলেটিভিটির, আগে কোর্স ওয়ার্ক সামলাই। এমন অবস্থায় নোটিশ বোর্ডে দেখি পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পাওয়া এক বিজ্ঞানী আসছেন নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। তিনি এক ঘণ্টা বক্তৃতা দেবেন। বিষয়বস্তু মহান আইনস্টাইনের মহান ভুল (Great Einestines Great Mistake)। আমি বক্তৃতা শুনতে অডিটরিয়ামে উপস্থিত হলাম। (দুঃখিত আমি অধ্যাপকের নাম ভুলে গেছি। আলজেমিয়ার্স মনে হয় হয়েই যাচ্ছে।)
অতীত অভিজ্ঞতায় দেখেছি বেশি জ্ঞানী মানুষদের বক্তৃতা ভালো হয় না। তাঁরা শ্রোতাদের তাঁদের মতোই ধীমান মনে করেন। এমন বক্তৃতা দেন যা শ্রোতাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। শুধু চুল স্পর্শ করে। মস্তিষ্কে ঢুকতে পারে না।
এই অধ্যাপক গল্প বলার মতো করে বক্তৃতা শুরু করলেন। প্রথমেই প্রজেক্টরে পৃথিবী নামক গ্রহের ছবি দেখানো হলো। সেখানে একটি সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে লেখা–এই গ্রহে আইনস্টাইন জন্মেছিলেন।