কল্পনা করা যাক আমগাছের মগডালে একটি পাকা আম। বানর আমটি পাড়তে পারছে না কারণ ডাল অত্যন্ত সরু। ডাল ভেঙে পড়ে সে আহত হবে। বানরের হাতে তখন যদি একটি লাঠি দেওয়া হয়, সে লাঠি দিয়ে আম পাড়ার চেষ্টা করবে। তিনবার চেষ্টা চালিয়ে চতুর্থবার সে ডাল ফেলে চলে যাবে। মানুষ সেটা করবে না। আম না পাড়া পর্যন্ত সে লাঠি দিয়ে চেষ্টা করেই যাবে। লাঠির সঙ্গে আরেক লাঠি যুক্ত করবে। মানুষ রণে ভঙ্গ দেবে না।
অমরত্বের সন্ধানে মানুষ কখনোই রণে ভঙ্গ দেয়নি। তাদের প্রধান চেষ্টা ছিল মৃত্যুর রহস্য ভেদ করা। শুরুতে ভাবা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট বয়সের পরে শারীরিক মৃত্যুঘড়ি বেজে ওঠে; তখন মৃত্যু প্রক্রিয়া শুরু হয়। জরা আমাদের গ্রাস করতে থাকে।
এখন বলা হচ্ছে, মৃত্যুঘণ্টা বা মৃত্যুঘড়ি বলে কিছু নেই। মানবদেহ অতি আদর্শ এক যন্ত্র। যন্ত্রের দিকে খেয়াল রাখলেই জরা আমাদের গ্রাস করবে না। বায়োলজিস্টরা এখন বলছেন, জরার মূল কারণ টেলোমারস (Telomeres) কণিকাগুচ্ছ। এরা DNA-র অংশ, থাকে ক্রমোজমের শেষ প্রান্তে। যখনই কোনো জৈব কোষ ভাঙে, টেলোমার কণিকাগুচ্ছ দৈর্ঘ্যে ছোট হতে থাকে। যখন জৈব কোষের আর কোনো টেলোমার থাকে না তখনই শুরু হয় জরা। আমরা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকি।
বায়োলজিস্টরা পরীক্ষা শুরু করলেন জরাগ্রস্ত ইঁদুর নিয়ে। তাদের দেওয়া হলো টেলমোরজ (Telomerase) এনজাইম। দেখা গেল, তাদের জরা প্রক্রিয়াই শুধু যে বন্ধ হলো তা না, তারা ফিরতে লাগল যৌবনের দিকে।
এই পরীক্ষা মানুষের ওপর করার সময় এসে গেছে। যে-কোনো দিন পত্রিকা খুলে জরা বন্ধ করার খবর পড়া যাবে। গৌতম বুদ্ধ এ সময় থাকলে আনন্দ পেতেন। তিনি জরা এবং মৃত্যু নিয়ে অস্থির ছিলেন। নির্বাণে মানুষ জরা এবং মৃত্যু মুক্ত হবে এটা তাঁর শিক্ষা।
তারপর একি! সত্যি কি মৃত্যুকে ঠেকানো যাচ্ছে? আমার হাতে টাইম পত্রিকার একটি সংখ্যা (ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১১) প্রচ্ছদ কাহিনী ২০৪৫, The year man Becomes Immortal. প্রচ্ছদ কাহিনী পড়ে জানলাম, ২০৪৫ সালে মানুষ অমর হয়ে যাচ্ছে। মানুষের হাতে আসছে নতুন নতুন টেকনোলজি। টেকনোলজির বৃদ্ধি ঘটছে এক্সপোনেনশিয়েলি। ২০৪৫-এর কাছাকাছি মানুষ Singularity-তে পৌঁছাবে। সিঙ্গুলারিটি শব্দটি এসেছে Astro Physics থেকে। এর অর্থ এমন এক বিন্দু, যেখানে পদার্থবিদ্যার সাধারণ সূত্র কাজ করবে না। এর মানেই অমরত্ব। ইচ্ছামৃত্যু ছাড়া মৃত্যু নেই। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ২০৪৫ সাল পর্যন্ত আমি এমনিতেই টিকছি না। অমরত্ব পাওয়া এই জীবনে আর হলো না। পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে। শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে। সেই অপূর্ব অলৌকিক সংগীত শোনার জন্যে আমি থাকব না। কোনো মানে হয়?
অশরীরী সুর
দুই বছর আগের কথা (জানুয়ারি, ২০০৯)। লেখার টেবিলে বসেছি। টেবিলে A4 সাইজের কাগজ আছে, বলপয়েন্ট আছে, চায়ের কাপ এবং কাপের পাশে সিগারেটের প্যাকেট আছে। সবচেয়ে বড় কথা, মাথায় গল্প আছে। লিখতে বসে দেখি, কলম চলছে না। শরীরের যে মাসলগুলো আঙুল চালায়, তারা আড়ষ্ট।
বাসায় রবি নামের একটি কাজের ছেলে আছে, তার দায়িত্ব শাওনের কুকুরের দেখাশোনা করা। আমার অবস্থা দেখে সে কোলের কুকুর ফেলে ছুটে এল। অনেকক্ষণ হাতে ম্যাসাজ করল। আঙুল টেনে দিল। হাতের আড়ষ্ট ভাব দূর হলো না। নিষাদ তার মাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আনন্দিত গলায় বলল, মা! বাবার একটা হাত নষ্ট হয়ে গেছে। একমাত্র শিশুরাই যেকোনো দুর্ঘটনায় আনন্দ পায়।
আমার পাশের ফ্ল্যাটে অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহার থাকে। আমার ডান হাত অচল শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সামনে বইমেলা। অন্যপ্রকাশের এখন কী হবে? মাজহার করিৎকর্মা মানুষ। আমার অবস্থা দেখে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। এক ঘণ্টারও কম সময়ে ফিরে এল। না, ডাক্তার নিয়ে আসেনি। সে এসেছে একটা মিনি ক্যাসেট রেকর্ডার নিয়ে। ক্যাসেট রেকর্ডার চার ঘণ্টা চলবে।
আমি হাতে না লিখে মুখে মুখে বলব। গল্প বা উপন্যাস রেকর্ড হয়ে যাবে। মাজহারের লোকজন ক্যাসেট প্লেয়ার বাজিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখে ফেলবে।
আমি চেষ্টা করলাম। একসময় লক্ষ করলাম, মূল গল্প থেকে সরে আবোলতাবোল কথা বলছি। ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করে দেওয়া হলো। বিকেলে গেলাম ডাক্তারের কাছে। তারা X-Rayসহ অনেক কিছু করল। ডাক্তাররা কিছু বের করতে পারল না।
কিন্তু আমি সমস্যা বের করে ফেললাম। মানসিক কোনো ব্যাপার ঘটেছে। ডান হাত দিয়ে আমি দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালাতে পারছি, কাগজে আঁকিবুঁকি করতে পারছি; কিন্তু লিখতে পারছি না। অর্থাৎ আমার মস্তিষ্ক চাইছে না যে আমি লিখি। মস্তিষ্ক চাইছে না বলেই সে হাতে লেখার কোনো সিগন্যাল পাঠাচ্ছে না। এর চিকিৎসা অত্যন্ত সহজ। মনকে নির্ভার করতে হবে। নুহাশপল্লীতে টানা কয়েক দিন থাকতে হবে। নুহাশপল্লীর বৃক্ষরাজি আমাকে সুস্থ করে তুলবে।
রাত ১২টায় সবাইকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। তার আগে ছোট্ট একটা কাজ করলাম, মাজহারের ক্যাসেট রেকর্ডার চালু করে শোবার ঘরের খাটে রেখে দিলাম। শাওন বলল, এর মানে কী?
আমি বললাম, ক্যাসেট রেকর্ডারটা রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত আশপাশের সব শব্দ রেকর্ড করবে। অশরীরীরা যদি কোনো কথা বলে, তাও রেকর্ড হয়ে যাবে। ভূত-প্রেতের সঙ্গে এই পদ্ধতিতে যোগাযোগ করাকে বলে EVP (Electronic Voice Phenomena).
EVP নিয়ে পৃথিবীজুড়ে মাতামাতির শুরুটা করেন সুইডেনের একজন অপেরা গায়ক, নাম ফ্রেডরিখ জারগেনসন (Fredrich Jurgenson)। তিনি তাঁর স্টকহোমের বাড়ির জানালায় একটা রেকর্ডার বসান। তিনি চাইছিলেন পাখিদের গান রেকর্ড করবেন। গায়কের বাড়িটি গ্রামে। চারদিকে লোকালয় নেই। অতি নির্জন। গায়ক রেকর্ডার বসিয়ে শহরে চলে এলেন। শহরে নানা ব্যস্ততায় সারা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলেন। রেকর্ডার চালালেন। সেখানে প্রচুর পাখির গান আছে, তবে তার সঙ্গে অদ্ভুত ব্যাপারও আছে। একটি পুরুষকণ্ঠ বলছে, ‘পাখিরা রাতে গান করে।’ অপেরা গায়ক হতভম্ব। পুরুষকণ্ঠ কোত্থেকে এল? তিনি দিনের পর দিন রাতের পর রাত শূন্য বাড়িতে ক্যাসেট রেকর্ডারে শব্দ রেকর্ড করতে থাকলেন। পুরুষকণ্ঠ আবারও পাওয়া গেল। সে এবার সরাসরি ফ্রেডরিখ এবং তাঁর কুকুর কেরিনো (carino)-কে উদ্দেশ্য করে কথা বলছে। ফ্রেডরিখ তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখলেন। এই বই পড়ে উৎসাহিত হলেন লেটভিয়ান সাইকোলজিস্ট কনস্টানটিন রোদিভ (Konstantin Ravdive)। তিনি সত্তর হাজারের বেশি ভয়েস রেকর্ড করলেন। একটি বই লিখলেন, নাম Amazing Experiment in Electronic Communication with the dead.
বইটি বেস্ট সেলার হলো। পৃথিবীজুড়েই EVP নিয়ে হৈ চৈ শুরু হলো। নানা EVP সোসাইটি হলো। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সোসাইটিরা যুক্ত হলো একে অন্যের সঙ্গে।
ভূতের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপার ক্যাসেট রেকর্ডারের কারণে অনেক সহজ হয়ে গেল। একটি নির্জন বাড়ি, একটা ক্যাসেট রেকর্ডার।
এখন দেখা যাক বিজ্ঞান EVP নিয়ে কী বলে? EVP-কে সরাসরি ভুয়া বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ ভূতের কথা তো রেকর্ড করা। বিজ্ঞান বলছে-
১. ক্যাসেট রেকর্ডারের রেডিও সিগন্যাল রিসিভার থাকে। রেকর্ডার মাঝেমধ্যে রেডিও সিগন্যাল রিসিভ করে বলে অশরীরী কণ্ঠ শোনা যায়।
২. ক্যাসেট রেকর্ডারের আশপাশে রাখা কোনো বস্তুও বেতারকেন্দ্রের সিগন্যাল ধরতে পারে। রেডিও সিগন্যাল রিসিভ করার যন্ত্র খুব সাধারণ। দুটি ধাতব বস্তু খুব কাছাকাছি এলেই হলো। সেমি কন্ডাকটার মানেই রেডিও সিগন্যাল রিসিভার। অনেকের দাঁতের ফিলিংও রেডিও সিগন্যাল রিসিভার হিসেবে কাজ করে। দাঁতের ভেতর থেকে রেডিও স্টেশনের কার্যক্রম শোনা যায়।
৩. EVP হিসেবে যেসব রেকর্ডিং পাওয়া যায়, তার সবই অর্থহীন হিজিবিজি শব্দ। মানুষ হিজিবিজি আওয়াজে অর্থ খুঁজে পায়। আকাশের মেঘের স্তূপ দেখে মানুষ কল্পনা করে এটা পাখি, এটা হাতি। শব্দের বেলাতেও একই রকম কল্পনা।
৪. পৃথিবীর আয়ানোস্ফেয়ারের অস্বাভাবিকতায় এক জায়গার শব্দ অন্য জায়গায় চলে যেতে পারে। কিছু কিছু EVP-র ক্ষেত্রে তা-ই হয়তো ঘটেছে।
নুহাশপল্লীতে তিন দিন কাটিয়ে আমি ঢাকায় ফিরলাম। হাত সচল হয়েছে। ‘মধ্যাহ্ন’ নামের উপন্যাস শুরু করেছি। ক্লান্তিহীন লেখা চলছে।
পাঠকরা নিশ্চয়ই জানতে আগ্রহী আমার অশরীরী কণ্ঠ রেকর্ড এক্সপেরিমেন্টের কী হলো? আমি বলতে চাইছি না। সব কিছু বলতে নেই।
‘The ghost of Roger Casement
Is beating on the door.’
W. B. yeats
আইনস্টাইন ও ইন্দুবালা
বঙ্গদেশের রানাঘাটে আইনস্টাইন বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। বিষয়বস্তু ‘On the unity and University of Forces.’ দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন রানাঘাটে গিয়েছেন বাংলা সিনেমার নায়িকা, নৃত্যগীতে পটু, অসামান্য রূপবতী ইন্দুবালা দেবী। তিনি স্থানীয় বাণী সিনেমা হলে নৃত্য পরিবেশন করবেন। আইনস্টাইনের বক্তৃতার জায়গা মিউনিসিপ্যালটি হল। যা হওয়ার তা-ই হলো। বাণী সিনেমা হল দর্শকে পরিপূর্ণ। মিউনিসিপ্যালটি হলে আইনস্টাইন এবং গণিতের অধ্যাপক রায়বাহাদুর নীলাম্বর চট্টোপাধ্যায় ছাড়া কেউ নেই। হতাশ নীলাম্বর বাবু আইনস্টাইনকে বাণী সিনেমা হলে ইন্দুবালার নাচ দেখাতে নিয়ে গেলেন। পরদিন পত্রিকায় ছাপা হলো, ‘বিখ্যাত জার্মান বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন গতকল্য দার্জিলিং যাওয়ার পথে রানাঘাট মিউনিসিপ্যাল হলে বক্তৃতা দিতে নামিয়াছিলেন। তাঁহাকেও সেদিন বাণী সিনেমা গৃহে ইন্দুবালার নৃত্যের সময় উপস্থিত থাকিতে দেখা গিয়াছিল।’