আমি বললাম, অবশ্যই শুনতে পাচ্ছি। আমার সামনে দিয়েই তো সে বাথরুমে ঢুকল।
তাহলে দরজা খুলছিলে না কেন?
আমি বললাম, তোমার পুত্রের ধারণা এ বাসার সবাই সারাক্ষণ তাকে দেখে রাখছে। তার প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখছে। সত্যিকার পৃথিবী এমন না। সেখানে বিপদ আছে। সমস্যা আছে। আমি তাকে সমস্যার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম।
দয়া করে তুমি তাকে কোনো কিছুর সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দেবে না। একটা অবোধ শিশু ভয় পেয়ে এতক্ষণ ধরে কাঁদছে, আর তুমি থিওরি কপচাচ্ছ!
আমি থিওরি ফলানো বন্ধ করে এখন শুধুই তার বড় হওয়া দেখছি।
তেলাপোকা দেখে একবার তাকে ভয়ে চিৎকার দিতে দেখলাম। আমি খুশি, ভয় নামক অনুভূতির সঙ্গে তার পরিচয় হলো।
পাশের বাসার তার সমবয়েসী অন্বয়কে একদিন সে ধাক্কা দিয়ে ফেলে খামচে ধরল। আমি খুশি, রাগ নামক বিষয়টি তৈরি হচ্ছে। ভেজিটেবল হয়ে কঠিন পৃথিবীতে সে টিকতে পারবে না।
ছোট্ট একটা মেয়ে বাসায় বেড়াতে এসেছে। মেয়েটির হাতে চকলেট। নিষাদ ছুটে গিয়ে মেয়েটির চকলেট কেড়ে নিয়ে মুখে দিয়ে ফেলল। পরের ধন আত্মসাৎ। এর প্রয়োজন কি আছে? বড় হয়ে নিষাদ যদি রাজনীতি করার কথা ভাবে তাহলে অবশ্যই প্রয়োজন আছে। আমি চাচ্ছি না সে ঐ পথে যাক। কাজেই তাকে হা করিয়ে মুখ থেকে চকলেট বের করে বলা হলো- ঘড়, ঘড়, ঘড়.
ছোট শিশু এবং কুকুর ছানাকে ‘না’ বলা হয় ইংরেজিতে। এর কারণ কী কে জানে।
একবার পুত্র নিষাদ আমাকে বড় ধরনের একটা শিক্ষা দিয়েছিল। সেই গল্প বলে ব্যক্তিগত উপাখ্যান শেষ করি।
আমি সিলেট থেকে মাইক্রোবাসে করে ফিরছি। সায়েদাবাদে এসে বিশাল জটে পড়ে গেলাম। সেটা কোনো সমস্যা না। ঘণ্টার পর ঘন্টা এক জায়গায় বসে থাকার অভ্যাস আমার আছে। সমস্যা অন্যখানে। নিষাদের দুধ শেষ। সে ক্ষুধার যন্ত্রণায় শুরু করেছে কান্না। বাসায় না পৌঁছানো পর্যন্ত তাকে দুধ দেয়া যাচ্ছে না। ক্ষুধার্ত শিশুর কান্না বাবা-মা’র বুকে কীভাবে লাগে সেদিন প্রথম বুঝলাম। তার কান্না আমার কলিজার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। বুক ধড়ফড় করছে।
আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম।
ঠিক এই সময় হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, ছোট্ট নিষাদ বাসায় গেলেই খাবার পাবে। তার খাবারের অভাব হবে না। কিন্তু এই দেশের অসংখ্য শিশু ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদে। তাদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের কান্না দেখে কেমন লাগে তাদের বাবা-মা’র?
নিষাদের কথা না, ক্ষুধার্ত শিশুদের বাবা-মা’র কথা ভেবে হঠাৎ করেই আমার চোখে পানি এসে গেল। তাতে কী যায় আসে! ক্ষুধার্ত শিশুদের কাছে একজন মানুষের সাময়িক অশ্রুর মূল্য কী?
বসন্ত বিলাপ
তখন চিটগং কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ি। ক্লাসটিচার বড়ুয়া স্যার আমাদের বাংলা পড়ান। স্যার একদিন ক্লাসে এসে বললেন, ‘রচনা লেখো “আমার প্রিয় ঋতু”।’ এই বলেই চেয়ারে পা তুলে তিনি ঘুমের প্রস্তুতি নিলেন। আমাদের সময়ে ক্লাসওয়ার্ক দিয়ে শিক্ষকদের ঘুমানো এবং ঝিমানো স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। এটাকে কেউ দোষের ধরত না। ছাত্ররা তো ক্লাসওয়ার্ক করছেই।
খাতা খুলে বসে আছি, আমার প্রিয় ঋতু কী বুঝতে পারছি না। শীত হওয়ার সম্ভাবনা কি আছে? শীতের সময় আমরা নানাবাড়ি মোহনগঞ্জে যাই। তখন লেপ নামানো হয়। লেপের ভেতর হুটোপুটি। রাতের উঠানে আগুন জ্বেলে চারদিকে গোল হয়ে বসে ভূতের গল্পের আসর। দিনের বেলা ডোবা সেঁচে মাছ ধরা।
প্রিয় ঋতু ‘শীত’ নিয়ে রচনা লেখা শেষ হলো। ক্লাস শেষ হয়ে গেছে, এক্ষনি ঘণ্টা পড়বে। এ অবস্থায় কারোর রচনাই স্যারের পড়ার সময় নেই। আমরা আনন্দিত। হঠাৎ স্যার আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘দেখি কী লিখেছিস?’
আমি ভয়ে ভয়ে খাতা দিলাম। স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, ‘প্রিয় ঋতু হবে ঋতুরাজ বসন্ত। তুই লিখেছিস শীত। গাধা, কানে ধর।’
আমি কানে ধরতেই ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ল। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় রচনা ছিল ‘তোমার প্রিয় ঋতু’। এইবার আর ভুল হলো না, লিখলাম ঋতুরাজ বসন্ত। রচনার ফাঁকে ফাঁকে কোটেশন ঢুকিয়ে দেওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। কোটেশন দেওয়া মানেই ছাঁকা নম্বর।
ঋতুরাজ বসন্ত নিয়ে লেখা কারও কোনো কবিতা মনে না পড়ায় নিজেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলাম। লিখলাম—ঋতুরাজ বসন্তের রূপে মুগ্ধ হইয়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘কত অপূর্ব পুষ্পরাজি ঋতুরাজ বসন্তে ফুটিয়াছে।’
বালক বয়সে কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বসন্তবিষয়ক একটি উদ্ধৃতি (আমার অতি প্রিয়) এখন দিচ্ছি—
‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়।’
তিনটি মাত্র লাইনে বসন্ত উপস্থিত। বাঁশি বাজার শব্দও কানে আসা শুরু হয়েছে। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ঋতু কি বসন্ত? তাঁর বসন্তবিলাস দেখে আমি অবাকই হই। এই ব্যাকুলতার কারণ কী? বঙ্গদেশে শীত প্রায় নেই বলেই বসন্তও নেই। আমাদের অল্প কিছু পাতাঝরা বৃক্ষ, পত্রহীন গাছে বসন্তকালে নতুন পাতা আসার ব্যাপারটা সে জন্যই অনুপস্থিত বলতে হবে। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন শালবনের ভেতর। শালবনে বসন্তকালে নতুন পাতা আসে—এই দৃশ্য অবশ্যই সুন্দর। তখন কিন্তু পুরোনো পাতা ঝরতে থাকে। এই দৃশ্য অতি বিরক্তিকর।
এমন কি হতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের বসন্তবিলাসের পরোক্ষ কারণ পশ্চিমের দেশ? যৌবনে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমের দেশে কাটিয়েছেন। তিনি দেখেছেন ভয়ংকর শীতের পর আনন্দময়ী বসন্তের আগমনের সর্বজনীন উচ্ছ্বাস। এই থিওরি বাতিল। রবীন্দ্রসাহিত্য পশ্চিমের প্রভাবমুক্ত। অবশ্যি সমালোচকেরা বলেন, ছোটগল্প লেখার প্রেরণা তিনি পেয়েছেন পশ্চিমা ছোটগল্প পড়ে। তাঁর প্রিয় ছোটগল্পকার এডগার এলেন পো।
সমালোচকেরা কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে কোনো লেখকের ওপর অন্যের প্রভাব প্রমাণ করতে পারলে বিমলানন্দ উপভোগ করেন। আমি সমালোচক নই বলেই কারও লেখার ওপরই অন্যের প্রভাব পাই না। আর রবীন্দ্রনাথ তো সবার ঊর্ধ্বে। তাঁর কত কবিতায় বৃষ্টির বন্দনা আছে। তিনি অসংখ্যবার পশ্চিম দেশের অপূর্ব তুষারপাত দেখেও এই নিয়ে কাব্য রচনা করেননি।
অন্যদিকে আমাদের জীবনানন্দ দাশের পশ্চিমা সাহিত্যের মুগ্ধতা চলে এসেছে তাঁর কাব্যে। তিনি হয়ে গেছেন হেমন্তের কবি। তাঁর হেমন্ত বঙ্গদেশের হেমন্তও না, পশ্চিমা হেমন্ত। ফুল ও পাখির বসন্ত জীবনানন্দকে ছুঁয়ে যেতে পারেনি।
বসন্ত এসেছে—এই খবর আমি পাই নুহাশপল্লীতে। খবরটা আমাকে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। নুহাশপল্লীতে তাঁর অতিপ্রিয় ফুল নীলমণিলতা ফোটে বসন্তকালে। নীলমণিলতা নাম রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। বোটানিক্যাল নাম Patraea volobilis. নুহাশপল্লীতে বাগানবিলাস বসন্তেই হেসে ওঠে। বাগানবিলাস রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম। অন্য নাম Bougain Villea. রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা মাধুরীর নামে একটি লতানো গাছের নাম রেখেছেন মাধুরীলতা। এই গাছে ফুল বর্ষাকালে আসে কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে নুহাশপল্লীতে বসন্তকালে মাধুরীলতা ফুলে ফুলে ভরে যেতে দেখেছি। মাধুরীলতার ইংরেজি নাম Quisquallis Indica.
বসন্ত মানেই পাখির গান (‘এত পাখি গায়’), মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতো করে ডাকে বউ কথা কও পাখি। এক্ষুনি বউ কথা না বললে সে মারা যাবে অবস্থা। এ কারণেই ‘বউ কথা কও’ পাখির আরেক নাম ব্রেইন ফিভার বার্ড। নজরুলের গানে এই পাখি বারবার এসেছে। বউ কথা কও নামে না, পাপিয়া নামে। বসন্তকালেই শিস দিতে শুরু করে কুটুম পাখি। বনফুল বলেন, ‘খোকা হোক পাখি।’ শ্যামা পাখির গান গাওয়ার সময়ও বসন্তকাল। কোকিল ও দোয়েলের কথা তো বলাই হলো না। এরাও বসন্তের পাখি। (যেসব পাঠক বসন্তের পাখি সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে চান, তাঁরা পক্ষীবিশারদ সাদত সেলিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট, ঢাকা ক্লাব। বসন্তকালে তিনি পাখির গান শোনার জন্য ক্যাসেট রেকর্ডার নিয়ে বনে-জঙ্গলে ঘোরেন।)
নুহাশপল্লীতে বসন্তের দিন হলো পাখিদের জলসার দিন। কাঠঠোকরা পাখি যে ঠকঠক শব্দের বাইরে গানও করতে পারে, তা আমি নুহাশপল্লীতে এক বসন্তে প্রথম শুনি। এই পাখি দেখতে যেমন সুন্দর, তার গানের গলাও অদ্ভুত। কাক বসন্তকালে চুপ করে যায়। কা কা কম করে। মনে হয় অন্য পাখিদের বিশেষ করে তার চিরশত্রু কোকিলের হইচইয়ে বিরক্ত হয়ে চুপ করে যায়। বসন্তে কাকের নীরবতার তথ্যটা মজার না?
রবীন্দ্রনাথকে যদি তাঁর প্রিয় ঋতু নিয়ে রচনা লিখতে বলা হতো, তিনি কি বসন্ত নিয়ে লিখতেন? বসন্ত নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস দেখে এ রকম মনে হওয়া স্বাভাবিক। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, বঙ্গদেশের প্রতিটি ঋতুর প্রতিই ছিল তাঁর সীমাহীন উচ্ছ্বাস। যিনি লেখেন, ‘বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান’, তাঁর প্রিয় ঋতু তো বর্ষা। বর্ষার বর্ণনায় তিনি সেই সব পাখির নাম নিয়েছেন, যারা জলচর এবং শুধু বর্ষাতেই গান করে (ডাহুক, মাছরাঙা, সারস, বকপক্ষী)। তাঁর তীক্ষ পর্যবেক্ষণের বাইরে যাওয়ার উপায় এ দেশের প্রকৃতির ছিল না, আর ছিল না বলেই তিনি লিখতে পেরেছেন, “ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।”