অ্যাটর্নি জেনারেল বললেন, আপনি কিন্তু বিপদে পড়বেন৷
আমি বললাম, কী আর করা৷ না হয় একটু বিপদে পড়লাম৷
মামলা শুরু হলো৷ আমি হাইকোর্টে যাই৷ সঙ্গে আমার তিন কন্যা এবং তাদের মা৷ তারা ভয়ে অস্থির, এই বুঝি আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে৷ মামলার এক পর্যায়ে তিন বিচারক নিয়ে গঠিত বেঞ্চের একজন বললেন, তিনি বিব্রত৷ মামলায় থাকবেন না৷ কিছুদিন পর আরেকটি বেঞ্চ তৈরি হলো৷
সেই বেঞ্চের এক বিচারকও বললেন তিনি বিব্রত৷ পনেরো ষোল বছর তো হয়েই গেল, বিচারকরা আমার বিষয়ে বিব্রত রয়েই গেলেন৷ আমার খুব ইচ্ছা করে মামলাটা শেষ পর্যন্ত দেখতে৷ মামলায় আমি যদি জিতে যাই তাহলে প্রমাণ হবে জজ সাহেবরা সাধারণ লোভ লালসার ঊর্ধ্বে না৷ আর যদি হেরে জেলে যাই ততেও ক্ষতি নেই৷
অতীতে এই পৃথিবীতে লেখার মাধ্যমে মত প্রকাশের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে৷ আমি না হয় কিছুদিন জেলে থাকলাম৷ আমাকে জেলখানার মেঝেতে শুয়ে থাকতে হবে না৷ একুশে পদক পাওয়ার কারণে ডিভিশন দেওয়া হবে৷ বিছানায় ঘুমাব৷ ভাগ্য ভালো হলে মাথার উপর ফ্যান ঘুরবে৷ ফ্যান না ঘুরলেও ক্ষতি নেই, চোখ বন্ধ করে ময়ূরাক্ষী নদীকে জেলের ভেতর নিয়ে আসা কঠিন কোনো কাজ না৷
পুত্র নিষাদ
আমার বয়স ষাট। আমার পুত্র নিষাদের বয়স ষোল মাস। আমি ষাটটা বর্ষা দেখেছি, সে মাত্র দু’টি দেখেছে। জীবনের দু’প্রান্তে দু’জন দাঁড়িয়ে আছি। আমি শুনছি বিদায় সঙ্গীত, সে শুনছে আগমনী সঙ্গীত।
একজন লেখকের প্রধান কাজই হচ্ছে বিশেষভাবে দেখা। সেই দেখার বস্তু যদি নিজের পুত্র হয়, তাহলে তো পুরো ব্যাপারটা আরো বিশেষ হয় দাঁড়ায়। নিষাদের মা তার ছেলের জন্যে একটা বেবি বুক কিনেছে। সেখানে শিশুর বড় হওয়ার বিভিন্ন পর্ব লেখার ব্যবস্থা আছে। যেমন-
শিশুর প্রথম গড়াগড়ি খাওয়া
প্রথম নিজে নিজে উঠে বসা
প্রথম হামাগুড়ি
প্রথম দাঁড়ানো
সব মায়েরাই এই ধরনের বই কেনেন। শুরুর দিকে প্রতিটি ঘটনা আগ্রহ নিয়ে লেখেন। ছয় মাসের মধ্যে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। শিশু বুকে নতুন কিছু যুক্ত হয় না। আমি যেহেতু সবকিছু স্মৃতিতে ধরে রাখি, মাথার ভেতর আমার লেখা চলতেই থাকে। আমি গভীর আগ্রহে নিষাদকে দেখি। তার অনেক কর্মকাণ্ড আমার গল্প-উপন্যাসে চলে আসে। উদাহরণ দেই-
নিষাদ কথা বলতে শিখে প্রথম শব্দটা বলল- ‘কাক!’ এত শব্দ থাকতে ‘কাক’ কেন? রহস্য উদ্ধার হলো। সে কান্নাকাটি করলেই কাজের মেয়ে তাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় যায় এবং ‘কাক’ দেখিয়ে বলে।। ‘কাক! কাক!’ কাকরা উড়াউড়ি করে। শিশু মহানন্দ পায়। সে প্রথম শব্দ ‘কাক’ শিখবে এটাই তো স্বাভাবিক।
অন্যদিন পত্রিকায় ‘কাকারু’ নামে একটা গল্প লিখলাম। গল্পের শুরুটা-
আশরাফুদ্দিন কাঁটাবন পাখির দোকানে গিয়েছেন কাক কিনতে। তাঁর মেয়ে সুমির জন্মদিনে তিনি একটা ‘কাক’ উপহার দেবেন।
আশরাফুদ্দিন তাঁর মেয়েকে কাক উপহার দিতে চাচ্ছেন, কারণটা হলো আমার পুত্র নিষাদ। সুমিও নিষাদের মতো প্রথম শব্দ বলতে শেখে কাক।
নিষাদের আগেও আমার চারটি সন্তান চোখের সামনেই বড় হয়েছে। তবে তাদেরকে সেভাবে দেখা হয়নি। তখন শিক্ষকতা করি। টাকা-পয়সার বিরাট ঝামেলা। যখনই সময় পাই লেখালেখি করি। বাড়তি কিছু রোজগারের চেষ্টা। মাথা গুঁজে পরীক্ষার খাতা দেখি। সন্তানদের দিকে তাকাবার সময় কোথায়?
আজ আমার অনেক অবসর। ঘরকুনো গর্তজীবী টাইপ মানুষ বলেই ঘর থেকে বের হই না। নিষাদকে সব সময়ই চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখি। একটি শিশুর মানসিকতা তৈরি হবার প্রক্রিয়াটি দেখি। তার মানসিকতা গঠনের প্রক্রিয়ায় আমার ভূমিকা কি ঠিক আছে তা নিয়ে ভাবি। যে ভাবনা আমি অন্য সন্তানদের সময় ভাবতে পারিনি।
ভাবনার নমুনাটা বলি। নিষাদ কোথাও পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে ঐ জায়গাটাকে চড়-থাপ্পড় দিলে তার মুখে হাসি ফোটে। সে নিজেও চড়-থাপ্পড় দেয় এবং বলে- মার! মার!
একদিন মনে হলো, এটা কি ঠিক হচ্ছে? আমরা কি ছেলেকে প্রতিশোধপরায়ণ হতে শেখাচ্ছি? সে যখন বড় হবে কেউ তাকে ব্যথা দিলে, সে কি শৈশবের শিক্ষা থেকে তাকে ব্যথা দিতে চাইবে? সেটা কি ঠিক হবে?
কেউ ব্যথা দিলেই প্রতিশোধ নেয়া যাবে না- এই তথ্য শেখালে সে যদি বড় হয়ে ভ্যাবদা টাইপ হয় তখন? মার খাবে, কিন্তু প্রতিবাদ করবে না। এটা তো আরো খারাপ।
কী করব বুঝতে না পেরে অস্থির লাগে।
প্রকৃতির সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়েও ঝামেলা। একদিন ঝুম বৃষ্টিতে তাকে ঘাড়ে নিয়ে ছাদে গেলাম। বৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মহানন্দে সে বৃষ্টিতে ভিজল। তার ফল হলো ভয়াবহ। প্রচণ্ড জ্বর, কাশি। ডাক্তার-হাসপাতাল ছোটাছুটি। নিষাদের মা ঘোষণা করল।। আমি শিশু পালনে অক্ষম। আমার কাছে কখনোই নিষাদকে ছাড়া যাবে না।
নিষাদের যে সব কর্মকাণ্ডে আমি আনন্দ পাই, তার মা পায় না। বরং সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়। একদিন দেখি, সে আমার সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছে। হাতে দেয়াশলাই-এর বাক্স। আমি হো হো করে হাসছি। তার মা রেগে অস্থির। সে কঠিন গলায় বলল, ঘরে সিগারেটের প্যাকেট থাকতে পারবে না। সিগারেট খাওয়া জন্মের মতো ছাড়তে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
একদিন শোবার ঘরে লেখালেখি করছি, হঠাৎ দেখি নিষাদ টয়লেটের দিকে রওনা হয়েছে। টয়লেটে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে শুরু করল কান্না। কিছুতেই সে দরজা খুলতে পারছে না। সে কাঁদছে, আমি কান্না শুনছি। নিজে উঠে গিয়ে দরজা খুলছি না। কান্না শুনে এক সময় তার মা এসে দরজা খুলে তাকে বের করল। আমাকে বলল, তুমি ওর কান্না শুনতে পাচ্ছিলে না?