আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমার দুটি ছেলে মারা গেছে। সেই জন্যই যে আমি এটা করছি, তা ঠিক না। আমার ছেলে মারা গেছে যুদ্ধে। ওদের মৃত্যুর জন্য আমি কোনো বিচার চাই না। আমি বিচার চাই তাদের জন্য, যাদের ওরা ঘরে থেকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। আমার কথা বুঝতে পারছেন?’
:পারছি।
:জানি পারবেন। আপনে জ্ঞানী-গুণী মানুষ। অনেকেই পারে না। বুঝলেন ভাই, অনেকে মানবতার দোহাই দেয়। বলে, বাদ দেন। ক্ষমা করে দেন। ক্ষমা এত সস্তা? অ্যাঁ, বলেন সস্তা?
আমি কিছু বললাম না। জলিল সাহেব পানের কৌটা বের করে পান সাজাতে বসলেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘আপনি কি মনে করেছেন, আমি ছেড়ে দেব? ছাড়ব না। আমার দুই ছেলে ফাইট দিয়েছে। আমিও দেব। মৃত্যু পর্যন্ত ফাইট দেব। দরকার হলে বাংলাদেশে প্রতিটি মানুষের সিগনেচার জোগাড় করব। ত্রিশ লক্ষ লোক মরে গেল, আর কেউ কোনো শব্দ করল না? আমরা মানুষ না অন্য কিছু, বলেন দেখি?’
আমি সিগনেচার ফাইল উল্টে দেখতে লাগলাম। খুব গোছানো কাজ-কর্ম। সিগনেচারের পাশে বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা। স্বাধীনতাযুদ্ধে নিহত আত্মীয়-স্বজনের নাম-ঠিকানা।
:অনেকেই মনে করে, আমার মাথা ঠিক নাই। এক পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলাম, সম্পাদক সাহেব দেখাই করলেন না। ছোকরা মতো একটা ছেলে বলল, ‘কেন পুরোনো কাসুন্দি ঘাটছেন? বাদ দেন, ভাই।’ আমি তার দাদার বয়সী লোক, আর আমাকে বলে ‘ভাই’।
:আপনি কী বললেন?
:আমি বললাম, তুমি চাও না এদের বিচার হোক? ছেলেটি কিছু বলে না। সরাসরি না বলারও সাহস নাই। অথচ এই ছেলেরা কত সাহসে সাথে যুদ্ধ করেছে। করে নাই?
:জি, করেছে।
:আপনার বাড়িওয়ালার কথাই ধরেন। তার এক শালাকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে। অথচ এই লোক সিগচেনার করেনি। ত্রিশ লক্ষ লোক মরে গেল। কোনো বিচার হলো না। মনে হলেই বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যথা হয়। আমি অত্যন্ত অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভদ্রলোক দ্বিতীয় একটি পান মুখে পুরে বললেন, ‘সরকারি লোকজনদের সাথে দেখা করেছি। তারা আমি কী বলতে চাই, সেটাই ভালো করে শুনতে চায় না। একজন আমাকে বলে, আপনি একটা পরিত্যক্ত বাড়ির জন্য দরখাস্ত করেন। আপনার দুটি ছেলে মারা গেছে। বাড়ি পাওয়ার হক আছে আপনার।’
:আপনি কী বললেন?
:আমি আবার কী বলব? বাড়ির জন্য পিটিশন করেছি নাকি? বাড়ি দিয়ে আমি করবটা কী? আমার দুই ছেলের জীবন কি সস্তা? একটা বাড়ি দিয়ে দাম দিতে চায়? কত বড় স্পর্ধা, চিন্তা করেন। আমি চাই—একটা বিচার হবে। একটা বিচার চাই। আর কিছুই না। সভ্য সমাজের নিয়মমতো বিচার হবে। বুঝলেন?
:জি, বুঝলাম।
:আপনারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ। আপনাদের বুঝতে কষ্ট হয় না। অন্যরা কেউ বুঝতে চায় না। একেকটা সিগনেচারের জন্য তিনবার করে যেতে হয়। তাতে অসুবিধা নাই। আমি ছাড়বার লোক না।
আমার সিগনেচার নিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন। তারপর অনেক দিন তাঁর সাথে দেখা হলো না। একটা কৌতূহল জেগে রইল। রাস্তাঘাটে দেখা হলে জিজ্ঞেস করেছি, কী ভাই, কত দূর কী করলেন?
:চালিয়ে যাচ্ছি, প্রফেসার সাহেব। দোয়া রাখবেন।
:লোকজন দস্তখত দিচ্ছে তো?
:সবাই দেয় না। ভয় পায়।
:কিসের ভয়?
:ভয়ের কি কোনো মা-বাপ আছে? ভয় পাওয়া যাদের স্বভাব, তারা ভয় পাবেই। বুঝলেন না, আমি আছি লেগে। আদালতে হাজির করে ছাড়ব। কী বলেন, প্রফেসর সাব?
:তা তো ঠিকই।
:ডিস্টিক্টে ভাগ করে ফেলছি। এখন সব ডিস্টিক্টে যাব। কষ্ট হবে, উপায় তো নাই। আপনি কী বলেন?
:ভালোই তো।
তা ছাড়া শুধু দস্তখত জোগাড় করলেও হবে না। কেইস চালানোর মতো এভিডেন্স থাকতে হবে। বিনা কারণে নিরাপরাধ লোকজন ধরে ধরে মেরেছে, এটা প্রমাণ করতে হবে না? ওরা ঘাগু ঘাগু সব ল-ইয়ার দেবে। দেবে না?
:তা তো দেবেই।
: আপনার জানা মতে কোনো ভালো ল-ইয়ার আছে?
:আমি খোঁজ করব।
:তা তো করবেনই। আপনি তো অন্ধ না। অন্যায়টা বুঝতে পারছেন। বেশির ভাগ লোকই পারে না। মূর্খের দেশ।
অনেক দিন আর জলিল সাহেবের দেখা পাই নাই। হয়তো সত্যি সত্যি জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছেন। বগলে ভারী ভারী ফাইল। দস্তখতের সংখ্যা হয়তো বাড়ছে। বারো হাজার থেকে পনের হাজার। পনের থেকে বিশ। এমনকি, সত্যি সত্যি হতে পারে যে চল্লিশ পঞ্চাশ লাখ দস্তখত জোগাড় করে ফেলবেন তিনি। পঞ্চাশ লক্ষ লোকের দাবি অত্যন্ত জোরালো দাবি।
বর্ষার শুরুতে খবর পেলাম, জলিল সাহেব অসুখে পড়েছেন। হাঁপানি, সেই সঙ্গে রিউমেটিক ফিবার। বাড়িঅলা বললেন, ‘পাগলা মানুষ। শরীরের যত্ন তো আর কোনো দিন করে নাই। এ যাত্রা টিকবে না।’
:বলেন কী?
:হ্যাঁ, গ্রিন ফার্মেসির ডাক্তার সাহেব বললেন। আমি নিজেও গিয়েছিলাম দেখতে।
:অবস্থা কি বেশি খারাপ?
:বর্ষাটা টিকে কি না…
:বলেন কী?
:খুবই খারাপ অবস্থা।
বর্ষাটা অবশ্যি টিকে গেলেন। ফাইলপত্র বগলে দিয়ে ঘুরতে বেরোলেন। আমার সঙ্গে দেখা হলো দুপুরে। আমি চিনতেই পারি না, এমন অবস্থা। তিনি এগিয়ে এলেন, ‘প্রফেসার সাহেব না?’
:আরে, কী ব্যাপার ভাই? একি অবস্থা আপনার?
: বাঁচব না বেশি দিন।
: না বাঁচলে চলবে? এত বড় একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন।
:ওইটার জন্য টিকে আছি।
: সিগনেচার কত দূর জোগাড় হয়েছে?
:পনের হাজার। মাসে তিন-চার শয়ের বেশি পারি না। বয়স হয়েছে তো। তবে ছাড়ার লোক না আমি।
: না, ছাড়বেন কেন?
: কাঠগড়ায় দাঁড় করাব শালাদের। ইহুদিরা পেরেছে, আমরা পারব না কেন? কী বলেন?
: তা তো ঠিকই।
:ত্রিশ লাখ লোক মেরেছে বুঝলেন, একটা-দুইটা না। বাংলাদেশের মানুষ সস্তা না? মজা টের পাইয়ে দেব।