প্রথম রাতে একফোঁটা ঘুম হলো না৷ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করি৷ রাত তিনটায় মশারির ভেতর থেকে বের হলাম৷ সঙ্গে সঙ্গে শত শত মশা আমাকে ছেঁকে ধরল৷ আবার মশারির ভেতর ঢুকলাম৷ গরমে টিকতে না পেরে আবার বের হলাম৷ মশাদেরকে বললাম, তোমরা যারা এখানে আছ তারাই আমার রক্ত খাও, বাইরে থেকে কাউকে ডেকে এনো না৷ ঘরটাকে আমার মনে হলো হাজতখানা৷ এই হাজতে সাতটা রাত পার করতে হবে ভেবে খুবই দমে গেলাম৷ এর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় কীভাবে? হঠাৎ করে মনে হলো একটা নদী কল্পনা করলে কেমন হয়?
নদীর পাড়ে একটা গাছের নিচে আমি বসে আছি৷ উথাল পাতাল হাওয়া নদীর উপর দিয়ে উড়ে আসছে৷ এমন হাওয়া যে আমার সামান্য শীত শীত ভাব হচ্ছে৷ আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মশক বানিহীকে সম্পূর্ণ অগ্রহ্য করে নদী কল্পনা শুরু করলাম৷ নদীর একটা সুন্দর নামও দিলাম – ময়ূরাক্ষী৷ যারা আমার লেখা পড়ছেন তারা হয়তো পুরোপুরি বিশ্বাস করবেন না যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার গরম লাগা কমে গেল৷ নদীর প্রবল হাওয়ায় মশারা উড়ে গেল৷ আমার খানিকটা শীত শীতও করতে লাগল৷
এভাবেই তৈরি হলো হিমু, যে যেকোনো অবস্থায় কল্পনার নদী ময়ূরাক্ষীর কাছে চলে যেতে পারে৷ হিমুকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম উপন্যাসটির নাম ময়ূরাক্ষী৷ ময়ূরাক্ষীর হিমু আমি নিজে৷ প্রথম লেখা হিমু বিষয়ক বইয়ে ময়ূরাক্ষী নদী কীভাবে চলে এল, একটু দেখা যাক৷
ছোটবেলার কথা৷ ক্লাস সিক্সে পড়ি৷ জিওগ্রাফি পড়ান মফিজ স্যার৷ তিনি ক্লাসে ঢুকলে চেয়ার-টেবিলগুলো পর্যন্ত ভয়ে কাঁপে৷ স্যার মানুষটা ছোটখাটো, কিন্তু হাতের থাবাটা বিশাল৷ আমাদের ধারণা ছাত্রদের গালে চড় বসাবার জন্য আল্লাহতালা স্পেশালভাবে স্যারের এই হাত তৈরি করে দিয়েছেন৷ স্যারের চড়েরও নানা নাম ছিল – রাম চড়, শ্যাম চড়, যদু চড়, মধু চড়৷
এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন চড় হচ্ছর রাম চড়, সবচেয়ে নরমটা হচ্ছে মধু চড়৷ স্যার সেদিন পড়াচ্ছেন – বাংলাদেশের নদ-নদী৷ ক্লাসে ঢুকেই আমার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, এই একটা নদীর নাম বল তো৷ চট করে বল৷ মফিজ স্যার কোনো প্রশ্ন করলে কিছুক্ষণের জন্য আমার মাথাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যায়৷ কান ভোঁ ভোঁ করতে থাকে৷ মনে হয় মাথার খুলির ভেতর জমে থাকা কিছু বাতাস কানের পর্দা ফাটিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে৷
কী ব্যাপার চুপ করে আছিস কেন? নাম বল৷ আমি ক্ষীণস্বরে বললাম, আড়িয়াল খাঁ৷ স্যার এগিয়ে এসে প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিলেন৷ খুব সম্ভব রাম চড়৷ হুঙ্কার দিয়ে বললেন, এত সুন্দর সুন্দর নাম থাকতে তোর মনে এল আড়িয়াল খাঁ? সব সময় ফাজলামি? কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাক৷ আমি কানে ধরে সারাটা ক্লাস দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ঘন্টা পড়ার মিনিট পাঁচেক আগে পড়ানো শেষ করে স্যার চেয়ারে গিয়ে বসলেন৷ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছে আয়৷
আরেকটি বড় খাবার জন্য আমি ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে এগিয়ে গেলাম৷ তিনি বিষন্ন গলায় বললেন, এখনো কানে ধরে আছিস কেন? হাত নামা৷ আমি হাত নামালাম৷ স্যার ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, তোকে শাস্তি দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে, খুবই অন্যায়৷ তোকে নদীর নাম বলতে বলেছি, তুই বলেছিস৷ আয় আরও কাছে আয়, তোকে আদর করে দেই৷
স্যার এমন ভঙ্গিতে মাথায় এবং পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন যে আমার চোখে পানি এসে গেল৷ স্যার বিব্রত গলায় বললেন, আমি তোর কাছ থেকে সুন্দর একটা নদীর নাম শুনতে চেয়েছিলাম, আর তুই বললি আড়িয়াল খাঁ৷ আমার মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে৷ আচ্ছা এখন সুন্দর একটা নদীর নাম বল৷ আমি শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে বললাম ময়ূরাক্ষী৷
ময়ূরাক্ষী? এই নাম তো শুনিনি৷ কোথাকার নদী?
জানি না স্যার৷
এই নামে আসলেই কি কোনো নদী আছে?
জানি না স্যার৷
স্যার হালকা গলায় বললেন, আচ্ছা থাক৷ না থাকলে নেই৷ এটা হচ্ছে তোর নদী৷ যা জায়গায় গিয়ে বস৷ এমনিতেই তোকে শাস্তি দিয়ে আমার মনটা খারাপ হয়েছে৷ তুই তো দেখি কেঁদে কেঁদে আমার মন খারাপটা বাড়াচ্ছিস৷ আর কাঁদিস না৷
রহস্য
রহস্য জাতীয় ব্যাপারগুলিতে আমার তেমন বিশ্বাস নেই। তবু প্রায়ই এ রকম কিছু গল্প-টল্প শুনতে হয়। গত মাসে ঝিকাতলার এক ভদ্রলোক আমাকে এসে বললেন, তার ঘরে একটি তক্ষক আছে – সেটি রোজ রাত ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকে। আমি বহু কষ্টে হাসি থামালাম। এ রকম সময়নিষ্ঠ তক্ষক আছে নাকি এ যুগে? ভদ্রলোক আমার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে বললেন, কি ভাই বিশ্বাস করলেন না?
জ্বি না।
এক রাত থাকেন আমার বাসায়। নিজের চোখে দেখেন তক্ষকটা। ঘড়ি ধরে বসে থাকবেন। দেখবেন ঠিক ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকবে।
আরে দুর! কি যে বলেন?
ভদ্রলোক মুখ কালো করে উঠে গেলেন। চারদিন পর তার সঙ্গে আবার দেখা। পৃথিবীটা এরকম, যার সঙ্গে দেখা হবার তার সঙ্গে দেখা হয় না। ভুল মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। আমাকে দেখেই ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি কি দৈনিক বাংলার সালেহ সাহেবকে চেনেন?
হ্যাঁ চিনি।
তাকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি নিজের কানে শুনেছেন। বলেছেন একটা নিউজ করবেন।
ভালই তো। নিউজ হবার মতই খবর।
আপনি আসেন না ভাই, থাকেন এক রাত।
আমাকে শোনালে কি হবে?
আরে ভাই আপনারা ইউনিভার্সিটির টিচার। আপনাদের কথার একটা আলাদা দাম।
তাই নাকি?
আপনারা একটা কথা বললে কেউ ফেলবে না।
এই জিনিসটা নিয়ে খুব হৈ-চৈ করছেন মনে হচ্ছে?
না, হৈ-চৈ কোথায়? অনেকেই অবশ্যি শুনে গেছেন। বাংলাদেশ টিভির ক্যামেরাম্যান নাজমুল হুদাকে চেনেন?
জ্বি না।
উনিও এসেছিলেন। খুব মাইডিয়ার লোক। আপনি আসুন না।
আচ্ছা ঠিক আছে, একদিন যাওয়া যাবে।