পাদটীকা
এক চৈত্র মাসে আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি। রোদের তাপে প্রকৃতি ঝলসে যাচ্ছে। মাটি ফেটে চৌচির, আকাশ পিঙ্গল। হঠাৎ দেখি একটা শিমুলগাছ। গাঢ় লাল রঙের ফুল এমনভাবে ফুটেছে যে মনে হয় রোদের তাপে গাছে আগুন লেগে গেছে। আমি মুগ্ধ হয়ে গাছের নিচে দাঁড়ালাম। অবাক হয়ে শুনি, পটকা ফোটার মতো শব্দ হচ্ছে। শিমুল ফুলগুলোর মতো শব্দ করে ফাটে এবং বীজ থেকে বের হয়ে ছোট্ট মেঘের মতো তুলা বাতাসে উড়তে থাকে। এই দৃশ্য প্রথম দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হলাম। বসন্ত! তোমাকে অভিবাদন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ০৮, ২০১১
বালক হিমু
পাঁচ-ছয় বছর আগে আমি অতি দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম৷ একা একা থাকি দখিন হাওয়ার এক ফ্ল্যাটে৷ নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন৷ মাঝে মধ্যে নুহাশ আসে৷ হোটেল থেকে খাবার এনে দুজন মিলে খাই৷ সে কিছুক্ষণ থাকে৷ দুজন নানা বিষয়ে গল্প করি৷ একদিন সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে উপস্থিত৷ আমি বললাম, বাবা পাঞ্জাবিটা সুন্দর তো!
সে খুশি খুশি গলায় বলল, মেজপা (শীলা) নিজের হাতে বানিয়েছে৷
আমি বললাম, ভালো বানিয়েছে৷
নুহাশ বলল, বাবা এটা হিমু পাঞ্জাবি৷ আমি হিমু হয়েছি৷
আমি হিমুর পিঠে হাত রাখলাম৷ তাকিয়ে থাকলাম জানালার দিকে৷ কারণ চোখে পানি এসে যাচ্ছে৷ আমি চাচ্ছি না বালক হিমু পিতার চোখের পানি দেখুক৷
দিন পনেরো আগের কথা৷ লেখালেখি করছি৷ হঠাৎ ধুপ করে আমার কোলে কী যেন পড়ল৷ তাকিয়ে দেখি, সর্বকনিষ্ঠ পুত্র নিষাদ হুমায়ূন৷ বয়স দুই মাস৷ তার মা তাকে সাজিয়ে এনে আমার কোলে ছেড়ে দিয়েছে৷ শাওন বলল, ছেলেকে দেখে কিছু কি বোঝা যাচ্ছে?
আমি বললাম, না৷
ভালো করে তাকিয়ে দেখ৷
আমি ভালো করে দেখলাম, কপালে কাজলের ফোঁটা ছাড়া আলাদা কিছু পেলাম না৷
শাওন বলল, সে যে হিমু হয়েছে, এটা বুঝতে পারছ না? হলুদ পাঞ্জাবি, খালি পা৷
আমি বললাম, আরে তাই তো!
দুই মাসের শিশু হিমু মহানন্দে হাত-পা ছুড়ছে৷ তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, রাস্তায় ছেড়ে দিলেই সে হাঁটতে শুরু করবে৷ একবারও পেছন ফিরে তাকাবে না৷ হিমুরা কখনো পেছনে তাকায় না৷ হিমু আইনে পেছনে ফিরে তাকানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ তারা তাকিয়ে থাকবে ভবিষ্যতের দিকে৷
ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি৷ লেকচারার থেকে অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর হয়েছি৷ বেতন বাড়েনি, যন্ত্রণা বেড়েছে৷ আমাকে দূর-দূরান্তরে পরীক্ষা নিতে পাঠানো হচ্ছে৷ পটুয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর৷ কলেজগুলোতে পড়াশোনা হয় না বললেই চলে৷ প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের সুযোগ-সুবিধাও নেই৷ ছাত্ররা কিছুই পারে না৷ অতি সহজ প্রশ্নে মাথা চুলকায়, ঘাড় চুলকায়৷ মাথা এবং ঘাড় থেকে প্রশ্নের উত্তর আসে না৷
অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছে এমন ছেলেকে যখন জিজ্ঞেস করি, পানির ফর্মূলা কী? সে আমতা আমতা করে বলে, H2O৷ যেন তার সন্দেহ আছে আসলেই H2O কিনা৷ তারপর জিজ্ঞেস করি, D2O কী? যারা কেমিস্ট্রি জানেন না তাদের বলছি, D2O হচ্ছে হেভি ওয়াটার৷ হাইড্রোজেন অ্যাটমে প্রটোন থাকে একটা, এখানে দুটা৷ D হলো হাইড্রোজেনের একটা Isotope৷ অতি সহজ এই প্রশ্নে পরীক্ষার্থী পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে বলে, স্যার হচ্ছে D2O ঢাকার পানি৷ তাহলে রাজশাহীর পানির ফর্মূলাটা কী? স্যার R2O৷ বরিশালের পানি? স্যার B2O৷ বরগুনার পানি? এইবার ছাত্র উৎসাহী৷ সে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে৷ সে হাসিমুখে জবাব দেয়, বরগুনার পানিরও স্যার একই ফর্মূলা B2O৷
আমি হতাশ চোখে পরীক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে থাকি৷ ইন্টারনাল একজামিনার হাত কচলাতে কচলাতে বলেন, পাস করিয়ে দিতে হবে স্যার৷ গরিবের ছেলে৷ কষ্ট করে লেখাপড়া করছে৷ ভাবটা এ রকম যে, ধনীর ছেলেমেয়েদের কেমিস্ট্রি জেনে পাস করতে হবে৷ গরিবের ছেলের পাসটা প্রয়োজন৷ কেমিস্ট্রি জানা প্রয়োজন না৷
বাইরে পরীক্ষা নিতে গেলে ভাইভা বিষয়ক অতি ক্লান্তিকর অবস্থার ভেতর যেতে হয়৷ ছাত্রদের ফেল করাতে ইচ্ছা করে না, আবার পাস করাতেও ইচ্ছা করে না৷ ভাইভা নিতে কষ্ট৷ থাকা-খাওয়াতেও কষ্ট৷
এক্সটারনাল শিক্ষকদের থাকার জায়গা হয় সাধারণত ল্যাবরেটরির লাগোয়া ঘরে৷ উদাহরণ বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ৷ সেখানে পরীক্ষা নিতে গিয়ে ওই ঘরে অনেকদিন থেকেছি৷ একবার ভূতও দেখেছিলাম৷ যেসব কলেজে এ রকম কোনো ঘর নেই সেখানে থাকার ব্যবস্থা হয় কোনো শিক্ষকের বাসায়৷ ভদ্রলোক হয়তো পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করছেন, সেখানে মূর্তিমান উপদ্রবের মতো অচেনা অজানা একজন মানুষ থাকতে আসেন৷ যাকে আপন করে নেওয়া যায় না, আবার দূরেও ঢেলে রাখা যায় না৷
এক্সটারনাল ভদ্রলোক ইচ্ছা করলেই ভাইভায় প্রচুর ফেল করিয়ে ঝামেলা করতে পারেন৷ একবার কেমিস্ট্রির এক শিক্ষকের বাসায় আমার থাকার জায়গা হলো৷ ভদ্রলোকের বাসায় একটা বাথরুম৷ সেই বাথরুম স্বামী-স্ত্রীর শোবার ঘরের সঙ্গে এটাচড৷ আমার আবার রাতে কয়েক দফা বাথরুমে যেতে হয়৷ ভদ্রলোক অবশ্য খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, আমার শোবার ঘরের দরজা খোলা থাকবে৷ আপনার যতবার ইচ্ছা বাথরুমে যাবেন৷ কোনো সমস্যা নেই৷
দীর্ঘ ভূমিকা দিলাম, এখন মূল গল্পে আসি৷ আমি পরীক্ষা নিতে গেছি পটুয়াখালীতে৷ ল্যাবরেটরির পাশের টিচার্স রুমে খাট পেতে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ গরমকাল৷ বেশির ভাগ সময় ইলেকট্রিসিটি নেই৷ ফ্যান চলে না৷