কামরায় আমরা দুটি মাত্র প্রাণী। বরযাত্রীরা আমাদের একা থাকবার সুযোগ দিয়ে অন্য কামরায় উঠেছে। ট্রেন ছুটে চলেছে ঝিকঝিক করে। বাতাসে তোমার লালচে চুল উড়ছে।
কী-একটা সেন্ট মেখেছ। চারপাশে তার চাপা সৌরভ। আমি গাঢ় স্বরে বলেছিলাম, ছিঃ জরী এত কাঁদছ কেন? কথা বল। আমার কথায় তুমি কী মনে করেছিলে কে জানে। লজ্জা পেয়ে দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেললে। সেইদিন কী গভীর আনন্দ আমাকে অভিভূত করেছিল। মনে হয়েছিল রহস্যমণ্ডিত এই রমণীটিকে পেয়েছি।
গৌরীপুরে গাড়ি অনেকক্ষণ হল্ট করল। একজন অন্ধ ভিখারি একতারা বাজিয়ে আমাদের কামরার সামনে খুব গান গাইতে লাগল, ও মনা এই কথাটি না জানলে প্রাণে বাঁচতাম না।
তুমি অবাক হয়ে বললে, কী সুন্দর গান। তারপর দুটি টাকা বের করে দিলে। ট্রেন ছাড়তেই জানালা দিয়ে অনেকখানি মাথা বের করে বললে, দেখুন দেখুন, কতগুলি বক একসঙ্গে উড়ে যাচ্ছে।
বক নয়। শীতের শুরুতে ঝাঁক বেঁধে বালিহাস উড়ে আসছিল। আগে দেখ নি কখনো, তাই খুব অবাক হয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, বক নয় জরী। ওগুলি বালিহাঁস। আর শোন, আপনি আপনি করছ কেন? আমাকে তুমি করে বলবে।
ঐ হাঁসগুলি কোথায় যাচ্ছে?
বিলের দিকে।
আপনাদের নীলগঞ্জে বিল আছে?
আবার আপনি?
তুমি হেসে বললে, নীলগঞ্জে বিল আছে?
আমি বললাম, বল, তোমাদের নীলগঞ্জে বিল আছে?
তুমি মুখ ফিরিয়ে হাসতে শুরু করলে। আমার মনে হল সুখ কোনো অলীক বস্তু নয়। এর জন্যে জীবনব্যাপী কোনো সাধনারও প্রয়েজন নেই। প্রভাতের সূর্যকিরণ বা রাতের জোছনার মতোই এও আপনাতেই আসে।
কিন্তু প্রিন্সেস তারাকনোভার ছবি দেখতে গিয়ে উল্টো কথা মনে হল। মনে হল সুখটুখ বলে কিছু নেই। নিরবচ্ছিন্ন দুঃখ নিয়ে আমাদের কারবার। চোখের সামনে যেন দেখতে পেলাম হতাশ রাজকুমারী পিটার্সবার্গের নির্জন সেলে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন। হু-হু করে বন্যার জল ঢুকছে ঘরে। রাজকুমারীর ঠোটের কোনায় কান্নার মতো অদ্ভুত এক হাসি ফুটে রয়েছে।
ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় মনে হল রাজকুমারীকে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। জরীর মুখের আদল আসছে নাকি? পরমুহর্তেই ভুল ভাঙল।, জরীর সঙ্গে এ মুখের কোনো মিল নাই। জরীর মুখ গোলগাল। একটু আদুরে ভাব আছে। আর রাজকুমারীর মুখটি লম্বাটে ও বিষণ্ণ। মনে আছে জরী, একবার তোমার একটি পোট্রেট করেছিলাম। কিছুতেই মন ভরে না। ব্রাশ ঘসি আবার চাকু দিয়ে চেঁছে রঙ তুলে ফেলি। দু-মাসের মতো সময় লাগল ছবি শেষ হতে। পোট্রেট দেখে তুমি হতভম্ব। অবাক হয়ে বললে, ও আল্লা চোখে সবুজ রঙ দিয়েছ কেন? আমার চোখ বুঝি সবুজ? আমি বললাম, একটু দূর থেকে দেখ।
তুমি অনেকটা দূরে সরে গেলে এবং চেঁচিয়ে বললে, কী সুন্দর! কী সুন্দর!
ছবি আঁকিয়ে হিসেবে জীবনে বহু পুরষ্কার পেয়েছি। কিন্তু সেদিনকার সেই মুগ্ধ কণ্ঠ এখনো কানে বাজে।
সেই পোট্রেটটি অনেকদিন আমার কাছে ছিল। তারপর বিক্রি করে দিলাম। ছবি দিয়ে কী হয় বল? তার উপর সেবার খুব টাকার প্রয়েজন হল। মিলানে গিয়েছি বন্ধুর নিমন্ত্রণে। গিয়ে দেখি বন্ধুর কোনো হদিশ নেই। কদিন আগেই নাকি বিছানাপত্র নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে। কী করি, কী করি! সঙ্গে সম্বলের মধ্যে আছে ত্রিশটি আমেরিকান ডলার আর মনট্রিলে ফিরে যাবার একটি টুরিস্ট টিকিট। এর মধ্যে আবার আমার পুরানো অসুখ বুকে ব্যথা শুরু হল। শস্তা দরের এক হোটেলে উঠলাম। তবুও দুদিন যেতেই টাকাপয়সা সব শেষ। ছবি বিক্রি ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
এক সন্ধ্যায় বড় রাস্তার মোড়ে ছবি টাঙিয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে লাগলাম। কারোর যদি পছন্দ হয় কিনবে। ছবির মধ্যে আছে দুটি ওয়াটার কালার আর তেলরঙা আঁকা তোমার পোট্রেট। ছবিগুলির মধ্যে নীলগঞ্জের জোছনা নামের অপূর্ব একটি ওয়াটার কালার ছিল। আমাদের বাড়ির পেছনে চার-পাঁচটা নারকেল গাছ। দেখ নি তুমি? ঐ যে পুকুরপাড়ে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়েছিল। এক জোছনা রাত্রিতে পুকুরের কালো জলে তাদের ছায়া পড়েছিল— তারই ছবি। চোখ ফেরানো যায় না এমন। অথচ বিক্রি হল শুধু তোমার পোট্রেটটি। এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা কিনলেন। তিনি হৃষ্টচিত্তে বললেন, কেন এই পোট্রেটটা কিনলাম জানো?
না ম্যাডাম।
আমি যখন কিশোরী ছিলাম তখন এই ছবিটিতে যে মেয়েটিকে তুমি এঁকেছ তার মতো সুন্দর ছিলাম, তাই কিনলাম।
আমি হেসে বললাম, আপনি এখনো সুন্দর।
ভদ্রমহিলা বললেন, এসো না আমার ঘরে। কফি করে খাওয়াব। এমন কফি সারা মিলান শহরে খুঁজেও পাবে না।
ভদ্রমহিলা আশাতীত দাম দিলেন ছবির। শুধু কফি নয়, রাতের খাবার খাওয়ালেন। তার অল্পবয়সী নানান ছবি দেখালেন। সবশেষে পিয়ানো বাজিয়ে খুব করুণ একটি গান গাইলেন যার ভাব হচ্ছে— হে প্রিয়তম, বসন্তের দিন শেষ হয়েছে। ভালোবাসাবাসি দিয়ে সে দিনকে দূরে রাখা গেল না।
নিজের হাতে তোমার ছবি টানালাম। কোথাকার ইটালির মিলান শহরের এক বৃদ্ধা মহিলা, তার ঘরে তোমার হাসিমুখের ছবি ঝুলতে লাগল। কেমন অবাক লাগে ভাবতে।
একশ বছর পর এই ছবিটি অবিকৃতই থাকবে। বৃদ্ধার নাতি-নাতনিরা ভাববে, এইটি কার পোট্রেট? এখানে কীভাবে এসেছে?
ফেরার পথে বৃদ্ধার হাতে চুমু খেলাম। মনে-মনে বললাম, আমার জরী যেন তোমার কাছে সুখে থাকে।
আমরা সবসময় সুখে থাকার কথা বলি। যতবার নীলগঞ্জ থেকে ঢাকার হোস্টেলে যেতাম— বাবা বলতেন, সুখে থাকো। তুমি যখন লাল বেনারসীতে মুখ ঢেকে ট্রেনে উঠলে তোমার মা কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, সুখে থাকো।