এশার বাবা নিজেই দুকাপ চা নিয়ে ঢুকলেন। আমার বড় লজ্জা লাগল। আমি বললাম, ছিঃ ছিঃ আপনি কেন?
তিনি হেসে বললেন, তাতে কী হয়েছে। খাও, চা খাও। চিনি হয়েছে কিনা বল।
হয়েছে।
গুড। চিনি আমি নিজেই দিয়ে এনেছি। কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই ব্যস্ত।
কোনো উৎসব নাকি?
না, উৎসব কিছু না। মেয়েলি ব্যাপার। এশার বিয়ে ঠিক হল। ওরা দিন পাকা করতে আসবে। রাত আটটায় আসবে। এখনো তিন ঘণ্টা দেরি অথচ ভাব দেখে মনে হচ্ছে …।
আমি নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিতে লাগলাম। এশার বাবা বললেন, ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ সাহেবের ছেলে। তুমি চিনবে নিশ্চয়ই। ইমতিয়াজ চৌধুরী, জিয়ার আমলে হেলথ মিনিস্টার ছিলেন। ছেলেটা খুব ভালো পেয়েছি। জার্মানি থেকে পিএইচ. ডি. করেছে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। এখন দেশে কী সব ইন্ডাস্ট্রি দেবে। রঙ তৈরি করবে। আমি ঠিক বুঝিও না।
চা শেষ করবার পরও আমি খানিকক্ষণ বসে রইলাম। যাবার আগে এশা বেরিয়ে এল। কী চমক্কার করেই না আজ তাকে সাজিয়েছে। তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হয়। এশা হাসিমুখে বলল, বেছে বেছে আপনি ঝামেলার দিনগুলিতে আসেন কেন বলুন তো?
আমি ফিরে যাচ্ছি আমার খুপরি ঘরে। অন্যসব রাতের মতো আজ রাতেও হয়তো ঘুম হবে না। বালিশের নিচ থেকে নীল বোতাম বের করে আজো নিশ্চয়ই দেখব। এই পরিবারটির কাছ থেকে একটা নীল বোতামের বেশি পাওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না। এই সহজ সত্যটি আজ রাতেও আমার মাথায় ঢুকবে না। আজ রাতেও বোতামটিকে মনে হবে একটি অপরাজিতা ফুল।
কল্যাণীয়াসু
ট্রেটয়াকভ আর্ট গ্যালারিতে ছবি দেখতে গিয়েছিলাম। পুরনো দিনের মহান সব শিল্পীদের আঁকা ছবি। দেখতে-দেখতে এগুচ্ছি। হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হল। সঙ্গের রাশিয়ান গাইড বলল, কী হয়েছে?
আমি হাত উঁচিয়ে একটি পেইনটিং দেখালাম। প্রিন্সেস তারাকনোভার পেইনটিং। অপূর্ব ছবি!
জরী, ছবিটি দেখে তোমার কথা মনে পড়ল। গাইড বলল, সেন্ট পিটার্সবার্গ জেলে প্রিন্সেসের শেষ দিনগুলি কেটেছে। ঐ দেখ সেল-এর অন্ধকূপে কী করে বন্যার পানি ঢুকছে। দেখ, প্রিন্সেসের চোখে-মুখে কী গভীর বিষাদ। প্রগাঢ় বেদনা।
আমি কথা বললাম না। অভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। গাইড বলল, এস পাশের কামরায় যাই।
আমি নড়লাম না। মৃদু গলায় বললাম, মি. যোখভ আজ আর কিছু দেখব না। চল, কোথাও বসে চা খাওয়া যাক।
দুজনে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম। ভীষণ শীত বাইরে। রাস্তাঘাট ফাঁকা-ফাঁকা। ঠা কনকনে হাওয়া মোটা ওভারকোট ভেদ করে শরীরে বিধছে। আমার সঙ্গী হঠাৎ জানতে চাইল, তোমার কি শরীর খারাপ করছে?
না।
আর্ট গ্যালারি কেমন দেখলে?
চমৎকার। অপূর্ব!
আমি চায়ে চিনি মেশাতে-মেশাতে বললাম, তোমাদের প্রিন্সেস তারাকনোভাকে দেখে আমার এক পরিচিত মহিলার কথা খুব মনে পড়ছে।
গাইড কৌতূহলী হয়ে বলল, কে সে? নাম জানতে পারি?
জরী তার নাম।
যোখভ বিস্মিত হয়ে তাকাল আমার দিকে। আমি মনে মনে বললাম, প্রিন্সেস জরী। প্রিন্সেস জরী।
জরী, রাজকুমারীর ছবি দেখে আজ বড় অভিভূত হয়েছি। হঠাৎ করে তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছা করছে। বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে মন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে। ক্রমাগতই নস্টালজিক হয়ে পড়ছি। ঘুম কমে গেছে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি। ঘনঘন কফি খাই। চুরুটের গন্ধে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। শেষরাতের দিকে ঘুমুতে গিয়ে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি। পরশু রাত্রে কী স্বপ্ন দেখলাম জানো? দেখলাম, আমাদের নীলগঞ্জে যেন খুব বড় একটা মেলা বসেছে। বাবার হাত ধরে মেলা দেখতে গিয়েছি (ইশ! কতদিন পর বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম)। বাবা বললেন, খোকা নাগরদোলায় চড়বি? আমি যতই না করি তিনি ততই জোর করেন। তারপর দেখলাম, ভয়ে আমি থরথর করে কাপছি আর শী-শা শব্দে নাগরদোলা উড়ে চলছে। চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারকা ছাড়িয়ে দূরে-দূরে আরো দূরে। ঘুম ভেঙে দেখি চোখের জলে বালিশ ভিজে গেছে। চল্লিশ বছর বয়সে কেউ কি এমন করে কাঁদে?
আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি জরী। আজকাল খুব নীলগঞ্জে চলে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে আগের মতো সন্ধ্যাবেলা পুকুরঘাটে বসে জোনাকি পোকার আলো জ্বালা দেখি।
মস্কোতে আজ আমার শেষ রাত। আগামীকাল ভোর চারটায় রওনা হব রুমানিয়ায়। খুব কষ্ট করে এক মাসের ভিসা জোগাড় করেছি। এই এক মাস খুব ঘুরে বেড়াব। তারপর ফিরে যাব মন্ট্রিলে নিজ আস্তানায়। বেশ একটা গতির জীবন বেছে নিয়েছি, তাই না? অথচ ছোটবেলায় এই আমিই হোস্টেলে যাবার সময় হলে কী মন খারাপ করতাম। হাসু চাচা আমাকে ট্রেনে তুলে দিতে এসে লাল গামছায় ঘনঘন চোখ মুছত। ধরা গলায় বলত, বড় মিয়া চিঠি দিয়েন গো।
আমার মনে হত—দুর ছাই, কী হবে পড়াশুনা করে। বাবা, হাসু চাচা এদের ছেড়ে কিছুতেই থাকতে পারব না।
প্রবল ঘরমুখো টান ছিল বলেই আজ হয়তো যাযাবর বৃত্তি বেছে নিতে হয়েছে। তাই হয়। তোমার জন্য প্রবল তৃষ্ণা পুষেছিলাম বলেই কি তোমাকে পাই নি? টেনটেলাসের গল্প জানো তো? তার চারদিকে পানির থইথই সমুদ্র অথচ তাকেই কিনা আজীবন তৃষ্ণার্ত থাকতে হল।
জরী, তোমার কি মনে আছে বিয়ের পরদিন তোমাকে নিয়ে যখন নীলগঞ্জে আসি তুমি ট্রেনের জানালায় মুখ রেখে খুব কেঁদেছিলে। তখন কার্তিকের শুরু। ধানীরঙের রোদে ঝলমল করছে চারদিক। হালকা হিমেল বাতাস। মনে আছে সেসব কথা আমি বলেছিলাম, মাথাটা ভেতরে টেনে নাও জরী। কয়লার গুঁড়ো এসে চোখে পড়বে। তুমি বললে, পড়ক।