আমার কাছে কোনো খবরাখবর নেই চাচা।
না থাকলে বানিয়ে-বানিয়ে বল। বর্তমানে চালু গুজব কী?
আমি বসলাম তার পাশে। এশার বাবার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। মাঝে-মাঝে এ-বাড়িতে এসে শুনি এশা নেই— মামার বাড়ি গেছে। রাতে ফিরবে না। তার মামার বাড়ি ধানমণ্ডিতে। প্রায়ই সে সেখানে যায়। আমার খানিকটা মন-খারাপ হয়। কিন্তু এশার বাবার সঙ্গে কথা বললে আমার মন-খারাপ ভাবটা কেটে যায়।
এই যে এখন বসলাম উনার পাশে এখন যদি শুনি এশা বাসায় নেই, মামার বাড়ি গিয়েছে— আমার খুব খারাপ লাগবে না।
তারপর রঞ্জু নতুন কোনো গুজবের কথা তাহলে জানো না?
জি না।
বল কী তুমি? শহর ভর্তি পুজব। আমি তো ঘরে বসে কত কী শুনি। চা খাবে?
জি না।
খাও এক কাপ। তোমার সঙ্গে আমিও খাব। তুমি আরাম করে বসো। আমি চায়ের কথা বলে আসি।
আপনাকে বলতে হবে না, আমি বলে আসছি। এশা কি বাসায় নেই?
আছে। বাসাতেই আছে।
বলেই তিনি চায়ের কথা বলতে উঠে গেলেন। কী চমৎকার তার এই ভদ্রতা। আমি কে? কেউ না। অতি সামান্য একজন। একটা এ্যাড ফার্মে কাজ করি। অল্প যে কটা টাকা পাই তার প্রতিটির হিসাব আমার আছে। আর এঁরা? আমার ধারণা, এদের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান আমার চেয়ে বেশি টাকা পায়। নিতান্ত ভাগ্যক্রমে এঁদের এক আত্মীয়ের সঙ্গে এ-বাড়িতে এসেছিলাম। প্রথমদিনেই এশার কী সহজ সুন্দর ব্যবহার যেন সে অনেকদিন থেকেই আমাকে চেনে। সেদিন কেমন হাসিমুখে বলল, আপনি তো বেশ লম্বা। আসুন একটা কাজ করে দিন। চেয়ারে দাঁড়ান দাঁড়িয়ে খুব উঁচুতে একটা পেরেক লাগিয়ে দিন। আমি বললাম, এত উঁচুতে পেরেক দিয়ে কী করবেন?
আজ বলব না। আরেকদিন এসে দেখে যাবেন।
দ্বিতীয়বার এ বাড়িতে আসার কী চমৎক্তার অজুহাত তৈরি হল। অথচ অজুহাতের কোনো প্রয়েজন ছিল না। এদের বাড়ি— দুয়ারখোলা বাড়ি। যে-কেউ যে-কোনো সময় আসতে পারে। কোনো বাধা নেই। অথচ মনে আছে দ্বিতীয়বার কত ভয়ে-ভয়ে এসেছি। গেট খুলে ভেতরে ঢোকার সাহস হয় নি। যদি আমাকে কেউ চিনতে না পারে। যদি এশা বিস্মিত হয়ে বলে, আপনি কাকে চান?
সে রকম কিছুই হল না। এশার বাবা আমাকে দেখে হাসিমুখে বললেন, কী বাপার রঞ্জ, গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আস, ভেতরে আস।
আমি খানিকটা বিব্রত ভঙ্গিতেই ঢুকলাম। তিনি হাসিমুখে বললেন, দেশের খবরা-খবর বল। নতুন কী গুজব শুনলে?
এশা বোধহয় বাইরে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, বেছে বেছে আজকের দিনটিতেই আপনি এলেন? এখন বেরুচ্ছি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারব না। চট করে আসুন তো, পেরেকটা কী কাজে লাগছে দেখে যান।
আমি ইতস্তত করছি। এশার বাবার সামনে থেকে উঠে যাব, উনি কী মনে করেন কে জানে। উনি কিছুই মনে করলেন না। সুখী-সুখী গলায় বললেন, যাও দেখে আস। জিনিসটা ইন্টারেস্টিং।
পেরেক থেকে হলুদ দড়ির মতো একটা জিনিস মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। এশা বাতি নিভিয়ে একটা সুইচ টিপতেই অদ্ভুত ব্যাপার হল। হলুদ দড়ি আলোয় ঝিকমিক করতে লাগল। সেই আলো স্থির নয়। যেন পড়িয়ে-গড়িয়ে নিচে নামছে। আলোর ঝরনা।
অপূর্ব।
কী, অবাক হয়েছেন তো?
হ্যাঁ, হয়েছি।
এ অদ্ভুত জিনিস এর আগে কখনো দেখছেন?
জি না।
আমার বড়বোন পাঠিয়েছেন। নেদারল্যান্ড থাকেন যিনি, তিনি। এখন যান। বসে বসে বাবার গল্প শুনুন। বাবা কি আপনাকে তার কচ্ছপের গল্পটা বলেছে?
জি না।
তাহলে হয়তো আজ বলবে। বাবার গল্প বলার একটা প্যাটার্ন আছে। কোটির পর কোন্ গল্প আসবে আমি জানি।
এশা হাসল। কী সুন্দর হাসি। আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম— না জানি কোন্ ভাগ্যবান পুরুষ এই মেয়েটিকে সারাজীবন তার পাশে পাবে।
এশার বাবা সেদিন কচ্ছপের গল্প বললেন না। পরের বার যেদিন গেলাম সেদিন বললেন। কচ্ছপ কোথায় ডিম পাড়ে জানো তো রঞ্জু? ডাঙায়। সে নিজে থাকে কিন্তু পানিতে। চলাফেরা, জীবনযাত্রা সবই পানিতে অথচ তার মন পড়ে থাকে তার ডিমের কাছে ডাঙায়। ঠিক না?
জি ঠিক।
বুড়ো বয়সে মানুষেরও এই অবস্থা হয়। সে বাস করে পৃথিবীতে কিন্তু তার মন পড়ে থাকে পরকালে। আমার হয়েছে এই দশা।
এই পরিবারটির সঙ্গে পরিচয় হবার পর আমার মধ্যে বড় ধরনের কিছু পরিবর্তন হল। আগে বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে চমৎকার লাগত। এখন আর লাগে না। একসময় মেয়েদের নিয়ে কেউ কোনো কুৎসিত কথা বললে বেশ মজা পেতাম। এখন ভয়ংকর রাগ লাগে। মনে হয় এই কুৎসিত কথাটি কোনো-না-কোনো ভাবে এশাকে স্পর্শ করছে। যে খুপরি ঘরটায় থাকি সেই ঘর আমার আর এখন ভালো লাগে না। দম বন্ধ হয়ে আসে। নোনাধরা বিশ্রী দেয়াল। একটি ছোট জানালা যা দিয়ে আলো-বাতাস আসে না, রাতের বেলা শুধু মশা ঢুকে। চৈত্র মাসের গরমে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি। নানান রকম কল্পনা মাথায় আসে। কল্পনায় আমার এই ঘর হয়ে যায় পদ্মানদীর নৌকায় একটা ঘর। জানালা খুললেই নদী দেখা যায়। সেই নদীতে জোছনা হয়েছে। চাঁদের আলো ভেঙে-ভেঙে পড়ছে। ঘরের দরজায় টোকা পড়ে। আমি জানি কে টোকা দিচ্ছে। তবু কাঁপা গলায় বলি, কে? এশা বলে, কে আবার? আমি। এরকম চমৎকার রাতে আপনি ঘরটর বন্ধ করে বসে আছেন। পাগল নাকি? আসুন তো।
কোথায় যাব?
কোথায় আবার, নৌকার ছাদে বসে থাকব।
আমরা নৌকার ছাদে গিয়ে বসি। মাঝি নৌকা ছেড়ে দেয়। এশা গুনগুন করে গায়ঃ যদি আমায় পড়ে তাহার মনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে। অজি জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।