বলেই মোবারক হোসেন মেয়েটির দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। কারণ, তাঁর ভয় হতে লাগল মেয়েটি বলে বসবে আমি মানুষ না, অন্য কিছু। এখন তাঁর মনে হচ্ছে ভূতপ্রেতের হাতে টর্চলাইট থাকতেও পারে। এটা বিচিত্র কিছু না। একবার তিনি একটা গল্প শুনেছেন, রাতে এক ভূত সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে সাইকেলের চাকা রাস্তায় ছিল না। রাস্তা থেকে আধা ফুটের মতো উপরে। ছিল। ভূত যদি সাইকেল চালাতে পারে তা হলে টর্চলাইটও হাতে নিতে পারে। চোখে রোদচশমাও পরতে পারে। চিৎকার মতো কিচকিচও করতে পারে।
আমার নাম এলা। আপনি কি আমার কথা এখন বুঝতে পারছেন?
মোবারক হোসেন আবারও বিড়বিড় করে বললেন, জি।
পরিষ্কার বুঝতে পারছেন?
জি। বাংলা ভাষায় কথা বলছেন বুঝব না কেন?
না, আমি বাংলা ভাষায় কথা বলছি না। আমি আসলে কোনো ভাষাতেই কথা বলছি না। আমার চিন্তাগুলো সরাসরি আপনার মাথায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি যে ভাষায় কথা বলছেন সেই ভাষাও আমি বুঝতে পারছি না, তবে আপনার মস্তিষ্কের চিন্তা বুঝতে পারছি।
মোবারক হোসেন ক্ষীণ স্বরে বললেন, জি আচ্ছা। ধন্যবাদ।
আপনি এই ক্ষমতাকে দয়া করে কোনো টেলিপ্যাথিক বিদ্যা ভাববেন না। এই ক্ষমতা আমার নেই। আমি এই কাজটার জন্যে ছোট্ট একটি যন্ত্র ব্যবহার করছি। যন্ত্রটার নাম এল জি ৯০০০।
মোবারক হোসেন আবার যন্ত্রের মতো বললেন, জি আচ্ছা, ধন্যবাদ।
আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?
জি না।
আয়াতুল কুরসি ব্যাপারটা কী? আপনি মনে মনে সারাক্ষণ আয়াতুল কুরসির কথা ভাবসেন। সে কে?
এটা একটা দোয়া। আল্লাহ্পাকের পাক কালাম। এই দোয়া পাঠ করলে মন থেকে ভয় দূর হয়। জিন-ভূতের আশ্রয় থেকে আল্লাহপাক মানব জাতিকে রক্ষা করেন।
তার মানে আপনি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?
মোবারক হোসেন শুকনো গলায় বললেন, জি না।
ভয় না পেলে ভয় কাটানোর দোয়া পড়ছেন কেন?
মোবারক হোসেন কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। তিনি ভয় পাচ্ছেন এবং বেশ ভালো ভয় পাচ্ছেন। মেয়েটা কথা বলছে, কিন্তু তার ঠোট নড়ছে না। ভয় পাবার জন্যে এইটাই যথেষ্ট। তার উপর এমন রূপবতী মেয়েও তিনি তাঁর জীবনে দেখেন নি। পরীস্থানের কোনো পরী না তো? নির্জন রাতে পরীরা মাঝে মাঝে পুরুষদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে পরীস্থানে নিয়ে যায়। নানান কুকর্ম করে পুরুষদের ছিবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেয়। এই জাতীয় গল্প তিনি অনেক শুনেছেন। তবে পরীরা যুবক এবং সুদর্শন অবিবাহিত ছেলেদেরই নিয়ে যায়। তার মতো আধবুড়োকে নেয় না। তাকে ছিবড়া বানাবার কিছু নেই। তিনি ছিবড়া হয়েই আছেন।
মোবারক হোসেন।
জি।
আমি আপনাকে আমাদের দেশে নিতে পারব না। ইচ্ছা থাকলেও পারব না। আমার সেই ক্ষমতা নেই। আমি এসেছি ভবিষ্যত পৃথিবী থেকে, পরীস্থান থেকে নয়। আপনাকে ছিবড়া বানানোরও কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
সিস্টার আপনার কথা শুনে খুব ভালো লেগেছে। থ্যাংক য়্যু।
আজকের তারিখ কত দয়া করে বলবেন?
মাঘ মাসের ১২ তারিখ।
ইংরেজিটা বলুন, কোন সন?
জানুয়ারির ৩, ১৯৯৭।
আমি আসছি ৩০০১ সন দেখে।
আসার জন্যে ধন্যবাদ। সিস্টার ভিতরে এসে বসুন। দরজা বন্ধ করে দেই। বাইরে অত্যধিক ঠাণ্ডা।
মেয়েটি ভেতরে এসে দাঁড়াল। মোবারক হোসেন দরজা বন্ধ করলেন। তারপর মনে হলো কাজটা ঠিক হয় নি। দরজা খোলা রাখা দরকার ছিল, যাতে প্রয়েজনে খোলা দরজা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারেন। মনোয়ারার সঙ্গে রাগ করে বাড়ি থেকে বের হওয়াটাই ভুল হয়েছে।
দরজা বন্ধ করার পর এলা টেবিলের দিকে এগিয়ে এল। মোবারক হোসেন চেয়ার এগিয়ে দিলেন। এলা বসতে বসতে বলল, মনোয়ারা কে? আপনি সারাক্ষণ এই নামটি মনে করছেন।
জি, আমার স্ত্রী।
এলা বিস্মিত হয়ে বলল, স্ত্রী! আপনার স্ত্রী আছে! কী আশ্চর্য!
মোবারক হোসেন তাকিয়ে আছেন। তার স্ত্রী থাকা এমন কী বিস্ময়কর ঘটনা যে মেয়েটা চোখ কপালে তুলল। রাস্তায় ভিক্ষা করে যে ফকির, তারও একটা ফকিরণী থাকে। তিনি রেলে কাজ করেন। ছোট চাকরি হলেও সরকারি চাকরি। কোয়ার্টার আছে।
স্ত্রীর উপর কি কোনো কারণে আপনি বিরক্ত হয়ে আছেন?
ইয়েস সিস্টার। তার ওপর রাগ করেছি বলেই স্টেশনে এসে একা একা বসে আছি।
খুবই ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট, এল জি ৯০০০ এই পয়েন্ট নোট করছে। বিজ্ঞান কাউন্সিলে আমরা আপনার কথা বলব। র্যানডম সেম্পলের আপনি সদস্য হচ্ছেন। আশা করি আপনার বা আপনার স্ত্রীর এই বিষয়ে কোনো আপত্তি হবে না।
কোনো কিছু না বুঝেই মোবারক হোসেন খুবই বিনীত গলায় বললেন, জি না ম্যাডাম।
এতক্ষণ সিস্টার বলছিলেন এখন ম্যাডাম বলা শুরু করলেন।
সিস্টার ডেকে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। সিস্টার ডাকের মধ্যে হাসপাতালের গন্ধ আছে। হাসপাতাল মানেই অসুখবিসুখ। সেই তুলনায় ম্যাডাম ডাকটা ভালো।
স্ত্রীর ওপর যখন রাগ করেন তখন আপনি স্টেশনে থাকার জন্যে চলে আসেন। আর যখন স্টেশনে আসেন না তখন স্ত্রীর প্রতি থাকে আপনার ভালবাসা?
জি না। রাগ করেও অনেক সময় বাসায় থাকি। গত কাল রাগ করেছিলাম, তার পরেও বাসায় ছিলাম।
কী কারণে রাগ করেছেন বলতে কি কোনো বাধা আছে?
জি না ম্যাডাম। বলতে বাধা নেই।
তা হলে বলুন।
আজ রাগ করেছি—কারণ, আজ সে ফুলকপি আর শিম একসঙ্গে দিয়ে কৈ মাছের ঝোল রান্না করেছে।