মোবারক হোসেন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, খাঁটি কথা বলেছেন। ধর্ষণ, এ্যাসিড মারা, নাবালিকা হত্যা— পত্রিকা খুললেই এই জিনিস। আল্লাহপাক দয়া করেছেন, এখানে পত্রিকা আসে না।
এলা বলল, মানুষকে এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেবার জন্যে বিজ্ঞান কাউন্সিল একটা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে পৃথিবীতে পুরুষ এবং মহিলা বলে দু ধরনের মানব সম্প্রদায় থাকবে না। হয় থাকবে শুধু পুরুষ অথবা শুধু মহিলা। যুক্তিসঙ্গত কারণেই শুধু মহিলা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কারণ, মহিলাদের ভেতরই দু রকমের ক্রমোজোম x এবং y আছে। বুঝতে পারছেন তো?
কিছু না বুঝেই মোবারক হোসেন বললেন, জি। আপনার কথাবার্তা পানির মতো পরিষ্কার। দুধের শিশুও বুঝবে।
বংশবৃদ্ধির জন্যে একসময় পুরুষ এবং রমণীর প্রয়েজন ছিল। এখন সেই প্রয়েজন নেই। মানব সম্প্রদায়ের বংশবৃদ্ধি এখন মাতৃগর্ভে হচ্ছে না। ল্যাবরেটরিতে হচ্ছে। শিশুপালনের যন্ত্রণা থেকেও মানব সম্প্রদায়কে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
ও।
এলা বলল, বর্তমান পৃথিবী সুন্দরভাবে চলছে। সমস্যাহীন জীবনযাত্রা। তারপরেও বিজ্ঞান কাউন্সিলে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন ওঠে–পুরুষশূন্য পৃথিবীর এই ধারণায় কোনো ত্রুটি আছে কি না। তখনই তথ্য সংগ্রহের জন্যে প্রাচীন পৃথিবীতে স্কাউট পাঠানো হয়। আমরা তথ্য সংগ্রহ করি। আমাদের পাঠানো তথ্য দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে—পুরুষশূন্য পৃথিবী আদর্শ পৃথিবী।
মোবারক হোসেন ভয়ে ভয়ে বললেন আমরা পুরুষরা কি খারাপ?
আলাদাভাবে খারাপ না, তবে পুরুষ যখন মহিলার পাশে থাকে তখন খারাপ।
সবুজ আলো আবারও চোখ ধাঁধিয়ে দিল। আলো নিভে যাবার পরেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত মোবারক হোসেন চোখে কিছু দেখতে পেলেন না। অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার পর তিনি দেখলেন–ঘরে আর কেউ নেই। তিনি একা। মোবারক হোসেন সিগারেট ধরালেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চিত হলেন এতক্ষণ যা দেখেছেন সবাই চোখের ধান্দা। মন মেজাজ ছিল খারাপ, শীতও পড়েছে। ভয়াবহ। সব মিলিয়ে চোখে ধান্দা দেখেছেন। একা একা স্টেশনে থাকা ঠিক না। আবার চোখে ধান্দা লাগতে পারে। স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করে বের হয়ে এসে আবার ফিরে যাওয়াটাও অত্যন্ত অপমানকর। কিন্তু কী আর করা। মানুষ হয়ে জন্ম নিলে বারবার অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বাসায় ফিরে গেলেও খাওয়াদাওয়া করা যাবে না। কিছুটা রাগ তাতে দেখানো হবে।
মোবারক হোসেন বাড়িতে ফিরলেন। মনোয়ারা বলমাত্র হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলেন। মনোেয়ারা এর মধ্যেই ফুলকপি দিয়ে কৈ মাছের ঝোল করেছেন। এবং সেই ঝোল এত সুস্বাদু হয়েছে যা বলার না! রান্নাবান্নার কোনো ইতিহাসের বই থাকলে কৈ মাছের এই ঝোলের কথা স্বর্ণাক্ষরে সেই বইয়ে লেখা থাকার কথা। মোবারক হোসেনের খুব ইচ্ছা করছে এই কথাটা স্ত্রীকে বলা। শুনলে বেচারি খুশি হবে। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। কারণ, মনোয়ারার চোখ লাল এবং ফোলা। সে এতক্ষণ কাঁদছিল। মোবারক হোসেন যতবারই রাগ করে বাইরে চলে যান ততবারই মনোয়ারা কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেন। এই তথ্যটা মোবারক হোসেনের মনে থাকে না। মোবারক হোসেন নরম গলায় বললেন, বউ ভাত খেয়েছ?
মনোয়ারা ভেজা গলায় বললেন, না।
মোবারক হোসেন ভাত মাখিয়ে নলা করে স্ত্রীর মুখের দিকে এগিয়ে বললেন, দেখি হাঁ করো তো।
মনোয়ারা বললেন, ঢং করবে না তো। তোমার ঢং অসহ্য লাগে।
অসহ্য লাগলেও এ-ধরনের ঢং মোবারক হোসেন প্রায়ই করেন। এলা নামের মেয়েটাকে এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলা হয় নি।
মোবারক হোসেন মনোয়ারার দিকে তাকিয়ে বল নকই খাও! ভাত হাতে কতক্ষণ বসে থাকব!
মনোয়ারা বললেন, বুড়ো বয়সে মুখে ভাত! ছিঃ!
ছিঃ বললেও তিনি এগিয়ে এলেন। তাঁবু খর্তি লজ্জামাখা হাসি।
মোবারক হোসেন ভাত খেতে বসে তরকারির বাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা কী? তাঁর গলার স্বরে দূরবর্তী ঝড়ের আভাস। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যাবে।
মনোয়ারা দূরবর্তী ঝড়ের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে স্বাভাবিক গলায় বললেন, কী হয়েছে?
এটা কীসের তরকারি?
কৈ মাছের ঝোল।
কৈ মাছের ঝোলে তরকারি কী?
চোখে দেখতে পাচ্ছ না কী দিয়েছি! ফুলকপি, শিম।
তোমাকে কতবার বলেছি—ফুলকপির সঙ্গে শিম দেবে না। ফুলকপির এক স্বাদ, শিমের আলাদা স্বাদ। আমার তো দুটা জিভ না যে একটায় শিম খাব আর অন্যটায় ফুলকপি?
মনোয়ারা হাই তুলতে তুলতে বললেন, যে তরকারি খেতে ইচ্ছা করে সেটা নিয়ে খেলেই হয়। খেতে বসে খামাখা চিৎকার করছ কেন?
এই তরকারি তো আমি মরে গেলেও খাব না।
না খেলে না খেয়ো। ডাল আছে ডাল খাও।
শুধু ডাল দিয়ে খাব?
মনোয়ারা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এটা তো হোটেল না যে চৌদ্দ পদের রান্না আছে।
মোবারক হোসেনের প্রচণ্ড ইচ্ছা হচ্ছে তরকারির বাটি ছুঁড়ে মেঝেয় ফেলে দিতে। এই কাজটা করতে পারলে রাগটা ভালো দেখানো হয়। এতটা বাড়াবাড়ি করতে সাহসে কুলাচ্ছে না। মনোয়ারা সহজ পাত্রী না। তার চীনামাটির বাটি ভাঙবে আর সে চুপ করে থাকবে এটা হবার না। মোবারক হোসেন কৈ মাছের ঝোলের বাটি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ধাক্কাটা হিসাব করে দিলেন, যেন তরকারি পড়ে যায় আবার বাটিটাও না ভাঙ্গে।
মনোয়ারা বললেন, কী হলো? খাবে না?