স্যার, আমার স্বপ্ন এ-রকম না। অন্য রকম।
ঠিক আছে, গুছিয়ে বল। শুনে দেখি কী রকম।
ছেলেটি সঙ্গে-সঙ্গে কথা শুরু করল। মুখস্থ বলে যাবার মতো বলে যেতে লাগল! মনে হয় আগে থেকে ঠিকঠাক করে এসেছে এবং অনেক বার রিহার্সেল দিয়েছে।
কথা বলার সময় একবারও আমার চোখের দিকে তাকাল না। যখন প্রশ্ন করলাম তখনো না।
প্রথম স্বপ্নটা দেখি বুধবার রাতে। এগারটার দিকে ঘুমুতে গেছি! আমার ঘুমের কোনো সমস্যা নেই! শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়তে পারি। সে-রাতেও তাই হল! বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়েছি। সঙ্গে-সঙ্গেই স্বপ্নটা দেখেছি।
কী করে বুঝলে শোয়ামাত্র স্বপ্ন দেখেছ?
জেগে উঠে ঘড়ি দেখেছি, এগারটা দশ।
স্বপ্নটা বল।
আমি দেখলাম খোলামেলা একটা মাঠের মতো জায়গা। খুব বাতাস বইছে। শোশোঁ শব্দ হচ্ছে। রীতিমতো শীত লাগছে। আমার চারদিকে অনেক মানুষ, কিন্তু ওদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না! ওদের কথা শুনতে পাচ্ছি। হাসির শব্দ শুনছি? একটা বাচ্চা ছেলে কাঁদছে-তাও শুনছি। বুড়োমতো একটা লোকের কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কাউকে আবছাভাবেও দেখতে পাচ্ছি না। একবার মনে হল আমি বোধহয় অন্ধ হয়ে গেছি। চারদিকে খুব তীক্ষ্ণ চোখে তোকালাম–মাঠ দেখতে পাচ্ছি, কুয়াশা দেখতে পাচ্ছি-কিন্তু মানুষজন দেখছি না, অথচ তাদের কথা শুনছি। হঠাৎ ওদের কথাবার্তা সব থেমে গেল। বাতাসের শো-শোঁ শব্দও বন্ধ হয়ে গেল! মনে হল কেউ যেন এসেছে। তার ভয়ে সবাই চুপ করে গেছে। আমার নিজেরও প্রচণ্ড ভয় লাগল। একধরনের অন্ধ ভয়।
তখন শ্লেষ্মাজড়িত মোটা গলায় একজন বলল, ছেলেটি তো দেখি এসেছে। মেয়েটা কোথায়?
কেউ জবাব দিল না। খানিকক্ষণের জন্যে বাচ্চা ছেলেটির কান্না শোনা গেল, সঙ্গেসঙ্গে থেমেও গেল। মনে হল কেউ যেন তার মুখে হাত চাপা দিয়ে কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করছে। ভারি গলার লোকটা আবার কথা বলল, মেয়েটা দেরি করছে কেন? কেন এত দেরি? ছেলেটিকে তো বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। এর ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে। ও জেগে যাবে।
হঠাৎ চারদিকে সাড়া পড়ে গেল। একসঙ্গে সবাই বলে উঠল, এসেছে, এসেছে, মেয়েটা এসেছে। আমি চমকে উঠে দেখলাম আমার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব রোগা একটা মেয়ে। অসম্ভব ফরাসা, বয়স আঠার-উনিশ। এলোমেলোভাবে শাড়ি পরা। লম্বা চুল! চুলগুলি ছেড়ে দেওয়া, বাতাসে উড়ছে। মেয়েটা ভয়ে থারথার করে কাঁপছে। আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি। সে অসংকোচে আমার হাত ধরে কাপা গলায় বলল, আমার ভয় করছে। আমার ভয় করছে!
আমি বললাম, আপনি কে?
সে বলল, আমার নাম নাগিন্স। আপনি যা দেখছেন তা স্বপ্ন। ভয়ংকর স্বপ্ন! একটু পরই বুঝবেন। আগে এই স্বপ্নটা শুধু আমি একা দেখতাম। এখন মনে হয় আপনিও দেখবেন।
মেয়েটা কাঁদতে শুরু করল। আতঙ্কে অস্থির হয়ে আমার গা ঘেষে দাঁড়াল। কাঁদতেকাঁদতেই বলল, আপনি কিছু মনে করবেন না, আমার ভয় লাগছে বলেই আমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছি। এরা প্রতি মাসে একবার করে আমাকে এই স্বপ্নটা দেখায়।
আমি বললাম, এরা কারা?
জানি না। কিছু জানি না। আপনি থাকায় কেন জানি একটু ভরসা পাচ্ছি। যদিও জানি আপনি কিছুই করতে পারবেন না। কিছুই না, কিছুই না, কিছুই না।
মেয়েটি হাঁপাতে শুরু করল আর তখন সেই ভারি এবং শ্লেষ্মাজড়ানো কণ্ঠ চিৎকার করে বলল, সময় শেষ। দৌড়াও, দৌড়াও, দৌড়াও!
সেই চিৎকারের মধ্যে ভয়ংকর পৈশাচিক কিছু ছিল। আমার শরীরের প্রতিটি স্নায়ু থরথর করে কাঁপতে লাগল। চোখের সামনে কুয়াশা কেটে যেতে লাগল-চারদিকে তীব্র আলো! এত তীব্র যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যাদের কথা শুনছিলাম। অথচ দেখতে পাচ্ছিলাম না, এই আলোয় সবাইকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম-এ।রা এরা এরা…
এরা কী?
এরা মানুষ না, অন্য কিছু-লম্বাটে পশুর মতো মুখ, হাত-পা মানুষের মতো। সবাই নগ্ন। এরা অদ্ভুত একধরনের শব্দ করতে লাগল! আমার কানে বাজতে লাগল-দৌড়াও দৌড়াও … আমরা দৌড়াতে শুরু করলাম। আমাদের পিছনে সেই জন্তুর মতো মানুষগুলিও দৌড়াচ্ছে।
আমরা ছুটছি মাঠের ওপর দিয়ে। সেই মাঠে কোনো ঘাস নেই। সমস্ত মাঠময় অযুত নিযুত লক্ষ কোটি ধারাল ব্লেড সারি-সারি সাজান। সেই ব্লেডে আমার পা কেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে-তীব্র তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। চিৎকার করে উঠলাম, আর তখনই ঘুম ভেঙে গেল। দেখি ঘামে সমস্ত বিছানা ভিজে গেছে!
এই তোমার স্বপ্ন?
জ্বি।
দ্বিতীয় স্বপ্ন কখন দেখলে?
ঠিক একমাস পর।
সেই মেয়েটিও কি দ্বিতীয় স্বপ্নে তোমার সঙ্গে ছিল?
জ্বি।
একই স্বপ্ন, না একটু অন্য রকম?
একই স্বপ্ন।
মায় বারও কিছুই মেটের হাত ধরে দৌড়ালে।
জ্বি।
প্রথম বার যেমন তার সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল, দ্বিতীয় বারও হল?
জ্বি।
দ্বিতীয় বারও কি মেয়েটি পরে এসেছে? তুমি আগে এসে অপেক্ষা করছিলে?
জ্বি-না।–দ্বিতীয় বারে মেয়েটি আগে এসেছিল, আমি পরে এসেছি।
দ্বিতীয় বারের স্বপ্ন তুমি রাত কটায় দেখেছ?
ঠিক বলতে পারব না, তবে শেষরাতের দিকে। ঘুম ভাঙার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আজান হল।
দ্বিতীয় বারও স্বল্প মোটা গলার লোক কথা কাল।
জ্বি।
লোকমান ফকির রুমালে কপালের ঘাম মুছতে লাগল। সে অসম্ভব ঘামছে। আমি বললাম, পানি খাবে? পানি এনে দেব?
জ্বি স্যার, দিন।
আমি পানি এনে দিলাম, সে এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করে ফেলল। আমি বললাম, স্বপ্ন ভাঙার পর তুমি দেখলে, তোমরা দুটি পা-ই ব্লেডে কেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে।–তাই না?