ছিলাম মানে? কেরোলিন কোথায়?
বিয়ের দু বছরের মাথায় সে মারা যায়।
আই অ্যাম সরি।
বিয়ের এক বছর আট মাসের দিন তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। খারাপ ধরনের স্নায়ুতন্ত্রের ক্যান্সার। কী কষ্ট যে সে করেছে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না! শেষের দিকে এমন হলো আমি চার্চে গিয়ে বলতে বাধ্য হলাম, হে ঈশ্বর তুমি কেরোলিনের প্রতি করুণা করো। যেখানে থেকে সে এই পৃথিবীতে এসেছে তাকে সেখানে নিয়ে যাও। রোগযন্ত্রণা থেকে তাকে মুক্তি দাও। রোগটা তার মস্তিষ্কে ছড়িয়ে গেল। সে কাউকে চিনতে পারত না। আমাকেও না। তার কাছে গিয়ে কেরোলিন কেরোলিন বলে ডাকলে সে শুধু চোখ তুলে তাকাত, সেই দৃষ্টিতে পরিচয়ের আভাস মাত্র থাকত না।
এরিখ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আহমেদ আমার গল্প শেষ হয়েছে। এখন ভালো করে কফি বানাও। কফি খেয়ে শুয়ে পড়ব। ঘুম পাচ্ছে।
আমি বললাম, লুপ্ত প্রাচীন লিপির ব্যাপারটা কিন্তু এখনো আসে নি।
এরিখ বলল, যে লিপির কথা বলছি ওটা কেরোলিনের লেখা। মৃত্যুর দুদিন আগে ইশারায় জানালো সে কিছু লিখতে চায়। আমি তাকে কাগজ-কলম দিলাম। সে সারা দিন শুয়ে শুয়ে লিখল। সন্ধ্যাবেলা লেখা শেষ হলো। আমাকে লেখা কাগজটা দিয়ে কোথায় চলে গেল। তার দুদিন পর তার মৃত্যু হয়।
সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখা কোনো চিঠি?
হ্যাঁ।
সাঙ্কেতিক ভাষায় লেখার দরকার পড়ল কেন?
আহমেদ সে-ই তো আমি বলতে পারব না। ক্যান্সারের আক্রমণে তার মস্তিষ্ক এ্যাফেকটেড হয়েছিল, তার কারণে হতে পারে। কিংবা অন্য কিছুও হতে পারে। লিপির পাঠোদ্ধার করা গেলেই ব্যাপারটা জানা যাবে। কিংবা এমনও হতে পারে যে, এটা আসলে কোনো লিপিটিপি নয়। কাগজে আঁকাবুকি কাটা। কেরোলিন আমাকে দিয়ে গেছে যেন এই লেখার রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে আমার জীবন কেটে যায়। আমি তাকে হারানোর কষ্ট ভুলে থাকতে পারি। কেরোলিন মারা গেছে একুশ বছর আগে। এই একুশ বছর ধরে আমি চিঠিটার রহস্য উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। মানুষ ক্লান্ত হয়, আমি ক্লান্ত হই না। কেন ক্লান্ত হই না বলো তো?
বলতে পারছি না।
ক্লান্ত হই না। কারণ, আমার মনে হয় কেরোলিন একটু দূরে দাঁড়িয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখছে আমি তার রহস্য ভাঙ্গার চেষ্টা করছি কি না। হাল ছেড়ে দিচ্ছি কি না।
তুমি আর বিয়ে করো নি?
না, বিয়ে করি নি
আমি বললাম, যদি কখনো তুমি এই সাঙ্কেতিক লিপির অর্থ বের করতে পারো তা হলে কি আমাকে জানাবে? কী লেখা আছে আমি জানতে চাচ্ছি না, আমি শুধু জানতে চাই তোমার সাধনা সফল হয়েছে। তুমি সঙ্কেতের অর্থ ধরতে পেরেছ।
এরিখ বলল, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তুমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকো আমি যদি পাঠোদ্ধার করতে পারি তুমি তা জানবে।
পিএইচ. ডি. ডিগ্রি নিয়ে আমি দেশে ফিরি ১৯৮৪ সালে। দশ বছর একনাগাড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করি। লেখালেখির ব্যস্ততা খুব বেড়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করি। ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। ইউনিভার্সিটির ঠিকানায় চিঠিপত্র জমা হয়— আমি আনতে যাই না। গত ফেব্রুয়ারি মাসে পেনশনসংক্রান্ত জটিলতার জন্যে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছি। দেখি কয়েক বছরের চার-পাঁচ শ চিঠি। বিদেশ থেকে আসা চিঠিগুলি আলাদা করে বাসায় নিয়ে এলাম। একটি চিঠি এসেছে এরিখ স্যামসনের আইনজীবীর কাছ থেকে। আইনজীবী জানাচ্ছেন— তাঁর ক্লায়েন্ট এরিখ স্যামসন নিউমোনিয়ায় মারা গেছেন। ক্লায়েন্টের নির্দেশমতো আমাকে জানাচ্ছেন যে, এরিখ স্যামসন মৃত্যুশয্যায় লিপির পাঠোদ্ধার করেছেন।
শঙ্খমালা
অনেক রাতে খেতে বসেছি, মা ধরা গলায় বললেন, খবর শুনেছিস ছোটন?
কী খবর?
পরী এসেছে।
আমি অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। মা থেমে-থেমে বললেন, পরীর একটা মেয়ে হয়েছে।
মায়ের চোখে এইবার দেখা গেল জল। আমি বললাম, ছিঃ মা, কাঁদেন কেন?
মা সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, না কাঁদি না তো; আর দুটি ভাত নিবি?
আমি দেখলাম মার চোখ ছাপিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। মায়েরা বড় দুঃখ পুষে রাখে।
ছবছর আগের পরী আপাকে ভেবে আজ কি আর কাঁদতে আছে? হাত ধুতে বাইরে এসে দেখি ফুটফুটে জোছনা নেমেছে। চারদিকে কী চমৎকার আলো। উঠোনের লেবু গাছের লম্বা কোমল ছায়া সে আলোয় ভাসছে। কতদিনের চেনা ঘরবাড়ি কেমন অচেনা লাগছে আজ।
বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন আমার অন্ধ বাবা। তার পাশে একটি শূন্য টুল। ঘরের সমস্ত কাজ সেরে আমার মা এসে বসলেন সেখানে। ফিসফিস করে কিছু কথা হবে। দুজনেই তাকিয়ে থাকবেন বাইরে। একজন দেখবেন উথাল-পাথাল জোছনা, অন্যজন অন্ধকার।
বাবা মৃদু স্বরে ডাকলেন, ছোটন, ও ছোটন!
আমি তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি তাঁর অন্ধ চোখে তাকালেন আমার দিকে। অস্পষ্ট স্বরে বললেন, পরী এসেছে শুনেছিস?
শুনেছি।
আচ্ছা যা।
আজ আমাদের বড় দুঃখের দিন। পরী আজ এসেছেন। কাল খুব ভোরে তাদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই হয়তো দেখা যাবে তিনি হাসি-হাসি মুখে শিমুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। শিমুল তুলো উড়ে এসে পড়ছে তার চোখেমুখে। আমাকে দেখে হয়তো খুশি হবেন। হয়তো বা হবেন না। পরী আপাকে বড় দেখতে ইচ্ছে করে।
আমরা খুব দুঃখ পুষে রাখি। হঠাৎ-হঠাৎ এক-একদিন আমাদের কত পুরনো কথা মনে পড়ে। বুকের ভেতর আচমকা ধাক্কা লাগে। চোখে জল এসে পড়ে। এমন কেন আমরা?