কান্ট্রি কিচেন রেস্তরাঁয় আমি সাতটার সময় উপস্থিত হলাম। কোনো মেয়েকে ডেটে ডেকে যথাসময়ে উপস্থিত না হওয়া বড় ধরনের অন্যায়। সেই অন্যায় আমি করতে পারি না। আমি ভেবেছিলাম পৌঁছেই দেখব কেরোলিন রেস্টুরেন্টের বাইরে জবুথবু হয়ে খানিকটা কুঁজো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে। মেঝের ডিজাইন জ্যামিতির কোনো সূত্রের সঙ্গে ফেলা যায় কি না তা-ই ভাবছে।
ঘটনা সে রকম হলো না।
আমি কেরোলিনকে দেখে হোঁচটের মতো খেলাম। সে খুবই সেজেগুজে এসেছে। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। সুন্দর করে চুল বাঁধা। লাল স্কার্ট এবং সবুজ টপসে তাকে লাগছে ইন্দ্রাণীর মতো। এই মেয়ে যে সাজতে পারে এবং এতটা সেজে রেস্তরাঁয় আসতে পারে আমি তা কল্পনাও করি নি। আমি বললাম, কেরোলিন তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
কেরোলিন লজ্জা পেয়ে হাসল।
আমি বললাম, তোমাকে এই পোশাকটায় চমৎকার লাগছে।
কেরোলিন ফিস করে বলল, থ্যাংক য়্যু।
ডিনার খেতে সৈতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানলাম। যেমন—
১. কেরোলিন বড় হয়েছে হোমে। তার বাবা-মা কে সে জানে না।
২. আজ যে পোশাক সে পরে এসেছে ওটা আজই কেনা হয়েছে। স্কার্ট টপস এবং জুতা কিনতে লেগেছে তিন শ এগারো ডলার।
৩. আজ সে জীবনের প্রথম ডেটে এসেছে। তাকে কখনো কোনো ছেলে ডেটে আসার জন্যে নিমন্ত্রণ করে নি।
৪. পড়াশোনা করতে তার একেবারেই ভালো লাগে না। কিছু করার নেই বলেই সে পড়াশোনা করে। যদি কিছু করার থাকত তা হলে অবশ্যই পড়াশোনা করত না।
৫. তার সঙ্গে আমার মতো Softly কোনো ছেলে এর আগে কথা বলে নি।
আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। ডিনারের মাঝামাঝি এসে আমার মনে হলো, এই মেয়েটি সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে না থাকলে আমি বাঁচব না। আমি আমার বাকি জীবন এই মেয়েটির লাজুক মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারব। আমি পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী মেয়েটি যেন আমার সামনে বসে আছে। যেন তাকে আমি শুধু আজ রাতের ডিনারের সময়টুকুর জন্যে পেয়েছি। ডিনার শেষ হলে সে চলে যাবে। আর তাকে পাব না।
এরিখ দম নেবার জন্যে থামল। আমি বললাম, এ পৃথিবী একবার পায় তাকে, কোনোদিন পায় নাকো আর।
এরিখ বলল, তার মানে?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোমার অবস্থার কথা ভেবেই হয়তো আমাদের দেশের এক বাঙালি কবি এই লাইনগুলি লিখেছিলেন।
কবির নাম কী?
কবির নাম জীবনানন্দ দাশ।
তুমি অবশ্যই সেই কবিকে আমার এপ্রিসিয়েশন পৌঁছে দেবে।
তিনি জীবিত নেই। কবিতার লাইনগুলি তাঁর জন্যও প্রযোজ্য হয়ে গেছে। যাই হোক তুমি গল্প শেষ করো। আমার ধারণা সেই রাতেই তুমি মেয়েটিকে প্রপোজ কর।
তোমার ধারণা এক শ ভাগ সত্যি। আমেরিকান ছেলেরা মাঝেমধ্যে খুব নাটকীয় কায়দায় প্রপোজ করে। যেমন মেয়েটির সামনে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে। দু হাত মুঠো কয়ে প্রার্থনার ভঙ্গি করে বলে, আমি তোমাকে আমার জীবনসঙ্গিনী হবার জন্যে প্রার্থনা করছি।
তুমি তা-ই করলে?
হ্যাঁ। ডিনার শেষ করেই তা-ই করলাম। কেরোলিনের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। আমাদের চারদিকে লোক জমে গেল। হাততালি পড়তে লাগল। এবং কান্ট্রি কিচেন রেস্তরাঁর মালিক রবার্ট উঁচুগলায় বলল–এই আনন্দময় ঘটনা স্মরণীয় করে রাখার জন্যে কান্ট্রি কিচেনে উপস্থিত সবাই এক গ্লাস করে ফ্রি রেডওয়াইন পাবে। আনন্দের একটা জোয়ার শুরু হয়ে গেল।
তোমরা পরদিন বিয়ে করলে?
আমেরিকায় হুট করে বিয়ে করা যায় না। বিয়ের লাইসেন্স করতে হয়। সেই লাইসেন্সের জন্যে ডাক্তারি পরীক্ষা লাগে। আমরা ঠিক এক মাস দশ দিনের মাথায় বিয়ে করলাম। বিয়ে মানেই বিরাট ঘটনা। আমার জন্যে তা ছিল অস্তিত্ব ভুলিয়ে দেবার মতো ঘটনা। আমার আনন্দের সীমা রইল না। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করত হ্যান্ডমাইক নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি, সবাইকে বলি হ্যালো হ্যালো কেরোলিন নামের মেয়েটি আমার। শুধুই আমার। মাঝে মাঝে রাতে ঘড়িতে এ্যালার্ম দিয়ে রাখতাম। ঘুম ভাঙলে কী করতাম জানো? কেরোলিনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তার ঘুম ভাঙাতাম না। শুধুমাত্র তার দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যে জেগে থাকতাম। আমার পাগলামির গল্প কেমন লাগছে?
ভালো লাগছে। কেরোলিনকে দেখতে ইচ্ছা করছে।
আমার কাছে তার ছবি আছে। গল্পটা শেষ হোক তোমাকে দেখাব।
থ্যাংক য়্যু।
আমার পাগলামি দেখে কেরোলিন খুব হাসলেও সে নিজেও কিন্তু কম পাগলামি করে নি। যেমন ধরো সে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিল। তার মতো ছাত্রী পড়াশোনা ছাড়তে পারে এটা ভাবাই যায় না। তার যুক্তি হচ্ছে পড়াশোনা চালিয়ে গেলে সে আমার দিকে নজর দিতে পারবে না। এটা তার পক্ষে সম্ভব না। তার কাছে আমি ছাড়া পৃথিবীর সবকিছুই গুরুত্বহীন। তার বিষয়ে খুব মজার ব্যাপার আছে। সেটা বলছি। প্লিজ হাসতে পারবে না।
তুমি নিশ্চিত থাকো আমি হাসব না।
ও ঘুমাত খুব অদ্ভুত ভঙ্গিতে। সে তার পা দিয়ে আমায় পা পেঁচিয়ে একটা গিট্টুর মতো করে ফেলত। হা-হা-হা।
মজার তো।
আমি তার নাম দিয়েছিলাম Princess Knot.
বাংলা ভাষায় এটা হবে গিট্টু কুমারী। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে— তোমরা আমেরিকার সবচেয়ে সুখী দম্পতি।
শুধু আমেরিকায় বলছ কেন? আমরা ছিলাম এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী স্বামী-স্ত্রী।