আহমেদ, তোমাদের পূর্বদেশীয় ভদ্রতার কথা আমি বইপত্রে পড়েছি। বাস্তবে দেখার সুযোগ আগে হয় নি। আজ দেখলাম। তুমি আমার জন্যে রান্নাবান্না করেছ। হোটেল থেকে আমাকে নিয়ে এসেছ এবং তোমার এ্যাপার্টমেন্টে আমাকে রাতে থাকতে বলছ–আমি খুবই আনন্দ পেয়েছি। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এ ধরনের আদরে আমরা আমেরিকানরা অভ্যস্ত না। আমার খানিকটা অস্বস্তি অবিশ্যি লাগছে। কিন্তু ভালো লাগছে অনেক বেশি। যাই হোক আমি প্রাচীন লিপিবিষয়ক গল্পটা এখন তোমাকে বলব। এবং মূল লিপিটা তোমাকে দেখাব। এই লিপি বিষয়ে আমার এত আগ্রহ কেন তা গল্পটা শুনলেই তুমি ধরতে পারবে। এই গল্পের প্রায় সবটা জুড়েই আছে আর স্ত্রী কেরোলিন। কাজেই এখন আমি যা করব তা হলো কেরোলিনের গল্প বলব।
পৃথিবীর সব দেশেই বন্ধুবান্ধবের কাছে স্ত্রীর গল্প বলা অরুচির পর্যায়ে পড়ে। তারপরেও বাধ্য হয়ে আমাকে তার গল্প করতে হচ্ছে।
আমি কেরোলিনকে বিয়ে করি যখন আমার মাত্র তেইশ। আমেরিকান পুরুষরা দুই ভাগে বিভক্ত, এক ভাগ বিয়ে করে খুব অল্প বয়সে আর এক ভাগ বিয়ে করে মধ্যবয়স পার করে আমি প্রথম দলের।
কেরোলিন ইউনিভার্সিটিতে আমার সঙ্গে পড়ত। আমরা ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা তাকে খুব ভয়ের চোখে দেখতাম। কারণ, সে ছিল ভয়াবহ ধরনের ভালো ছাত্রী। শুধু আমরা ছাত্রছাত্রীরা না, শিক্ষকরাও তাকে খুব সমীহের চোখে দেখতেন। অথচ সে ছিল খুবই বিনয়ী। ক্লাসে এসে শেষের সারির চেয়ারের একটিতে মাথা নিচু করে বসে থাকত। শিক্ষকরা কোনো প্রশ্ন করলে সে কখনো জবাব দেবার জন্যে হাত তুলত না। তাকেও শিক্ষকরা কখনো প্রশ্ন করতেন না, কারণ তাঁরা ধরেই নিয়েছেন, এমন কোনো প্রশ্ন তাকে করা যাবে না যার উত্তর তার জানা নেই।
এ-ধরনের মেয়েদের সঙ্গে আগবাড়িয়ে কেউ কথা বলে না। তাদের সঙ্গে ডেট করা তো অকল্পনীয় ব্যাপার। কেরোলিনের প্রসঙ্গে অনেক রসিকতাও আমাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। যেমন একবার নাকি বাজি ধরে কোনো এক সিনিয়র ছাত্র কেরোলিনকে ডেট-এ নিয়ে গিয়েছিল। চাইনিজ ডিনার। ডিনার শেষে স্পিলবার্গের ছবি। কেরোলিন নাকি পুরো সময়টায় তার ডেটকে শুধু ফিজিক্সের প্রশ্ন করেছে। ডেট একবার শুধু বলেছে–কেরোলিন তোমার চোখ
তো খুব সুন্দর। কালো চোখ।
তার উত্তরে কেরোলিন বলেছে–চোখের কালোটা হয় টিনডেল এফেক্টের জন্যে। তারপরই টিনডেল এফেক্ট এবং টিনডেল ফেনোমেনার ওপর তিন মিনিট বক্তৃতা দিয়েছে।
ডেটের শেষে ছেলেটা বাড়িতে ফিরেছে জ্বর এবং প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে।
কেরোলিনকে আমরা দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। আমেরিকান সোসাইটি অতি স্মার্ট তরুণী পছন্দ করে না। স্মার্ট শব্দটি আমি মেধা অর্থে ব্যবহার করছি।
যাই হোক, একদিন কী হয়েছে বলি। টার্ম পেপার জমা দিতে হবে— আমি পেপার লেখার জন্যে লাইব্রেরিতে গিয়েছি। হঠাৎ দেখি লাইব্রেরির এক কোনায় কেরোলিন মাথা নিচু করে বসে আছে। তার সামনে বেশ কিছু বই। একটা পেপার কাপে কফি। ন্যাপকিনের ওপর একটা স্যান্ডউইচ রাখা। স্যান্ডউইচের পাশে একটা আপেল। তার দুপুরে খাবার। আমি কী মনে করে যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, হ্যালো কেরোলিন। সে চমকে উঠে দাঁড়াল। তার হাতের ধাক্কা লেগে কফির কাপ উল্টে গেল। চারদিকে কফি ছড়িয়ে বিশ্রী অবস্থা! আমি বললাম, তোমাকে চমকে দেয়ার জন্যে দুঃখিত। কেরোনি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ইটস ওকে। ইটস ওকে।
আমি বললাম, তুমি বোধহয় আমাকে চিনছে পারছ না। তুমি তো ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ড ছাড়া কোনোদিকে তাকাও না। আমি যেহেতু ব্ল্যাকবোর্ড না, আমাকে চেনার কথাও না।
কেরোলিন মাথা নিচু করে বলল আমি তোমাকে চিনি। তোমার নাম এরিখ। তুমি গত কাল একটা নীল ব্লেজার পরে ক্লাসে এসেছ। তার আগের দিন ইয়েলো স্ট্রাইপের ফুলহাতা শার্ট পরেছ। তার আগের দিন সাদা জাম্পার…
আমি হতভম্ব হয়ে কেরোলিনের দিকে তাকালাম। নিজের বিস্ময়ের ধাক্কা একটু সামলে নিয়ে বললাম, ক্লাসে কোন ছাত্র কী পরে আসে তা তুমি জানো?
কেরোলিন নরম গলায় বলল, জানি।
পেপার কাপ থেকে কফি গড়িয়ে পড়ে টেবিল নষ্ট করছিল। কেরোলিন টেবিলে রাখা বইপত্র সরাতে গিয়ে সব এলোমেলো করে দিল। তার স্যান্ডউইচ এবং আপেল মেঝেতে পড়ে গেল। আমি বললাম, আমি খুবই দুঃখিত, তোমার লাঞ্চ নষ্ট করে দিয়েছি।
সে আগের মতো বলল, ইটস ওকে। ইটস ওকে।
আমি বললাম, যেহেতু তোমার দুপুরের খাবার আমি নষ্ট করেছি, রাতের ডিনারটা কি আমি কিনে দিতে পারি? Can I ask you for a date?
কেরোলিন চুপ করে রইল। আমি বললাম, তোমার যদি অন্য কোনো পরিকল্পনা না থাকে তাহলে এস রাতে আমরা একসঙ্গে ডিনার করি।
কেরোলিন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
আমি বললাম, ঠিক সাতটায় তুমি কান্ট্রি কিচেন রেস্তরাঁয় চলে এসো। কান্ট্রি কিচেন চেন তো–সাউথ বুলেভার।
কেরোলিন বিড়বিড় করে বলল, আমি চিনি।
তা হলে সন্ধ্যা সাতটায় তোমার সঙ্গে দেখা হবে।
আমি লাইব্রেরি থেকে চলে এলাম এবং সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নিজের ওপর খুব রাগ হতে লাগল। কেন হঠাৎ মাথায় ভূত চাপল? কেন মেয়েটাকে ডেট-এ নিতে চাচ্ছি? যে মেয়ে তার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা কে কবে কোন কাপড় পরছে তা হড়হড় করে বলে দিতে পারে তার কাছ থেকে পাঁচ শ হাত দূরে থাকা দরকার। জেনেশুনে আমি এত বড় ভুল কী করে করলাম? এমন তো না যে আমার ডেট পেতে সমস্যা হচ্ছে।