আমি রাগ দেখিয়ে বললাম, খুবই ভালো কথা। তোমাদের আরও আগেই যাওয়া উচিত ছিল। হু কেয়ারস? গো টু হেল।
গো টু হেল গালিটা তখন নতুন শিখেছি। যখন-তখন ব্যবহার করি এবং অত্যন্ত ভালো লাগে। বাংলা ভাষায় জাহান্নামে যাও–এর চেয়েও লাগসই মনে হয়।
ব্যাচেলর জীবন হচ্ছে সর্বোত্তম। এই জীবনে আছে মুক্তির আনন্দ— এ ধরনের অতি উচ্চ ভাব নিয়ে প্রথম রাতটা কাটল। দ্বিতীয় রাত আর কাটতে চায় না। আমি সময় কাটাবার জন্যে রাত এগারোটায় এরিথ স্যামসনকে টেলিফোন করলাম।
হ্যালো এরিখ।
ইয়েস। মে আই নো, হু ইজ স্পিকিং?
আমি নাম বললাম। আমার মনে হলো অপর প্রান্তে এরিখ আনন্দের আতিশয্যে শূন্যে লাফ দিল। যেন দীর্ঘদিনের অদর্শনের পর হারানো বন্ধুকে ফিরে পেয়েছে। উচ্ছ্বাস বাঁধ মানছে না। আমেরিকানদের এ ধরনের উচ্ছ্বাসের সবটাই সাধারণত মেকি হয়ে থাকে। আমার মতো বোকা বিদেশীরা এতে বিভ্রান্ত হয়। যাই হোক আমাদের কথাবার্তা যা হলো তা মোটামুটি এ রকম—
আহমেদ তুমি কেমন আছ?
খুবই ভালো আছি। তবে এই মুহূর্তে মনটা একটু খারাপ।
কেন জানতে পারি কী? যদি কোনো অসুবিধা না থাকে।
কোনো অসুবিধা নেই। রাগ করে আমার স্ত্রী নিউইয়র্কে চলে গেছে। যাবার আগে জানিয়েছে দু মাসের ভেতর সে ফিরবে না।
তুমি নিশ্চিত থাক দিন তিনেকের ভেতরই তোমার স্ত্রী ফিরে আসবে। মন খারাপের কারণেই তুমি আমাকে টেলিফোন করেছ নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
তোমার প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধারের কিছু হয়েছে কি না জানার আগ্রহ হচ্ছে।
এখনো কিছু হয় নি।
চেষ্টা নিশ্চয়ই চালিয়ে যাচ্ছ?
সাঙ্কেতিক কোড ভাঙতে পামেন একটা সফটওয়্যারের সন্ধান পেয়েছি। দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে কিনতে পারছি না। তবে মনে হয় কিনে ফেলব। তোমার কি ধারণা কেনা উচিত?
তুমি যদি পুরোপুরি নিশ্চিত হও যে সফটওয়্যার তোমার লিপির পাঠোদ্ধার করবে তা হলে কিনে ফেলো। আর যদি সন্দেহ থাকে তা হলে কেনা ঠিক হবে না। কারণ, এই সফটওয়্যারের তখন আর কোনো উপযোগিতা নেই।
আমিও তা-ই ভাবছি। তোমাকে তোমার মূল্যবান মতামতের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
এই পর্যন্ত কথাবার্তার পর আমি টেলিফোন রেখে ঘুমাতে গেলাম। তার পাঁচ মিনিটের মাথায় এরিখের টেলিফোন পেলাম।
হ্যালো আহমেদ।
হ্যাঁ বলো।
তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি বলে দুঃখিত। কথাটা হচ্ছে আমি সিয়াটলে যাব। ফার্গো সিটি পার হয়ে যেতে হবে। তোমার হাতে যদি অবসর থাকে তা হলে ভাবছি এক রাত থাকব ফার্গো সিটিতে। তোমার সঙ্গে গল্প করা হবে এবং তুমি প্রাচীন লিপিটা ইচ্ছা করলে দেখতেও পারো।
আমি বললাম, প্রাচীন লিপি দেখার জন্যে আমি ছটফট করছি।
কথাটা আমেরিকানদের মতো বললাম। আমেরিকানরা অতিরিক্ত উৎসাহ দেখানোটা ভদ্রতার অংশ বলে মনে করে। কোনো আমেরিকান মা যদি বলে আমার বাচ্চাটা এবারে ভালো গ্রেড পেয়েছে তখন যাকে এই কথাটা বলা হবে তার দায়িত্ব হবে বিকট চিৎকার দিয়ে বলা, ওয়ান্ডারফুল! হোয়াট এ গ্রেট নিউজ।
সত্যি কথাটা হলো প্রাচীন লিপি বিষয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। আজ পর্যন্ত এমন কোনো প্রাচীন লিপি পাওয়া যায় নি যেখানে রাজাদের যুদ্ধজয়ের কাহিনী এবং পুরোহিতদের মন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু লেখা। রাজা-বাদশা এবং পুরোহিতদের বিষয়ে আগ্রহী হবার কোনো কারণ থাকার কথা না।
এরিখ স্যামসনের সঙ্গে ফার্গো হোটেলে দেখা হলো। তার গলার স্বর শুনে মনে হয়েছিল যুবক মানুষ। এখন দেখি প্রৌঢ়। আমেরিকান প্রৌঢ়দের বয়স বোঝা মুশকিল, ৫০ থেকে ৭০ হতে পারে। বেশিও হতে পারে।
সে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমেরিকান কায়দায় অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল। গিফট র্যাপে মুড়ে সে আমার জন্যে একটা গিফটও নিয়ে এসেছে। আমি সেই গিফট নিলাম। চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরি। আমি সেই গিফট হাতে নিয়ে আমেরিকান কায়দায় অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলাম। এ-রকম একটা ডায়েরি আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছিলাম। কয়েক বার দোকানে দেখেছি কিন্তু কেন জানি শেষ পর্যন্ত কেনা হয় নি। এ-ধরনের রুটিন কথাবার্তা বললাম।
আমার অতিথি সেই হিসেবে আমি তাকে রাতে আমার এ্যাপার্টমেন্টে খেতে নিয়ে গেলাম। এবং বললাম তুমি খাওয়াদাওয়া করো। তারপর আমরা গল্পগুজব করব। সবচেয়ে ভালো হয় রাতে তুমি যদি হোটেলে ফিরে না যাও। আমার এ্যাপার্টমেন্ট পুরো খালি। তুমি রাতে থেকে যাবে। প্রয়োজনে সারারাত আমরা গল্প করতে পারব।
বাঙালিরা হোটেল পছন্দ করে না–তারা যেখানেই যায় বন্ধুবান্ধব খুঁজে বেড়ায়, বন্ধুবান্ধব না পেলে দেশের মানুষ খোঁজে। হোটেল খোঁজে না। আমেরিকানদের স্বভাব উল্টো, তারা প্রথমেই খোঁজে হোটেল। তার পরেও এরিখ স্যামসন আমার ঘরে থাকতে রাজি হয়ে গেল। আমার রাঁধা অখাদ্য ডাল-ভাত এবং ডিম ভাজা তৃপ্তি করে খেল। ডাল খেয়ে বলল, এত চমৎকার স্যুপ সে অনেকদিন খায় নি। তাকে যেন এই স্যুপের রেসিপি দেয়া হয়।
খাওয়া শেষ করে আমরা গল্প করতে গেলাম। কথক এরিখ স্যামসন, আমি শ্রোতা। আমেরিকানরা গল্প ভালো বলতে পারে না। কিন্তু এরিখ দেখলাম ভালোই গল্প করে। সাউথের উচ্চারণে তার ইংরেজি বুঝতে মাঝে মাঝে সমস্যা হচ্ছে। আমাকে প্রায়ই বলতে হচ্ছে— Please say it again. তারপরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি— কোনো আমেরিকানের মধ্যে আমি গল্প বলার এমন স্টাইল দেখি নি।