ড. আহমেদ,
আমি জেনেছি তুমি লুপ্ত প্রাচীন ভাষার বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। আমার কাছে লুপ্ত ভাষায় লেখা একটি কাগজ আছে। তুমি যদি ভাষার পাঠোদ্ধারে আমাকে সাহায্য করো আমি খুশি হব। তুমি দয়া করে নিম্নলিখিত পোস্ট বক্স নাম্বারে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করো। ভালো কথা, তোমার পরিশ্রমের জন্যে যথাযোগ্য পারিশ্রমিক দেয়া হবে।
বলাই বাহুল্য, এটা একটা জাংক চিঠি। পোস্ট বক্সের ঠিকানায় উত্তর দিলেই ধরা খেতে হবে। প্রাচীন ভাষাবিষয়ক কোলে সোসাইটির সদস্য হতে হবে যার জন্যে মাসিক চাঁদা বিশ ডলার বা এই জাতীয় কিছু। চিঠি আমি ফেলেই দিতাম কিন্তু আমার নামের আগে ড. পদবিটি আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিল। তখনও ডক্টর ডিগ্রি পাইনি। পাব পাব ভাব। কিউমিলিটিভ একজাম পাস করেছি। থিসিস লিখছি। এই সময় কেউ যদি ড. লিখে চিঠি পাঠায় মন দুর্বল হতে বাধ্য। কাজেই আমি চিঠির জবাব পাঠালাম। আমি লিখলাম—
জনাব,
আপনার চিঠি পেয়েছি। প্রাচীন লুপ্ত ভাষা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না আমার পড়াশোনার বিষয় পলিমার রসায়ন। আপনাকে সাহায্য করতে পারছি না বলে দুঃখিত। আমি প্রাচীন ভাষা জানি এই তথ্য কোথায় পেলেন জানালে খুশি হব।
বিনীত
হুমায়ুন আহমেদ
পুনশ্চ ১ : আমি এখনো Ph. D. ডিগ্রি পাই নি। আপনার এই তথ্যটিও ভুল।
পুনশ্চ ২ : আপনার চিঠিটি যদি জাংক মেইল জাতীয় হয় তা হলে জবাব দিবেন না।
আমি এই চিঠির জবাব আশা করি নি। কিন্তু সাত দিনের মাথায় জবাব পেলাম। জবাবটা হুবহু তুলে দিলাম—
প্রিয় আহমেদ,
আমার চিঠিটি জাংক মেইল নয়, সে কারণেই জবাব দিচ্ছি। তুমি প্রাচীন লুপ্ত ভাষা নিয়ে গবেষণা করো এই তথ্য তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান আমাকে জানিয়েছে।
আমি আমেরিকার প্রায় সব বড় লাইব্রেরিকে একটি আবেদন পাঠিয়েছিলাম। সেখানে জানতে চেয়েছি লাইব্রেরির পাঠকদের মাঝে এমন কেউ কি আছেন যারা প্রাচীন ভাষা নিয়ে পড়াশোনা বা গবেষণা করেন?
তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি তোমার নাম পাঠিয়েছে এবং তোমার নামের আগে ড. পদবি তারাই দিয়ে দিয়েছে।
তুমি লিখেছ তোমার বিষয় পলিমার রসায়ন। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে পলিমার রসায়ন তোমার বিষয় হলে তুমি লুপ্ত প্রাচীন ভাষা বিষয়ে আগ্রহী। তা না হলে তুমি আমার চিঠি জবাব দিতে না। তুমি কি দয়া করে একটি প্রাচীন ভাষা উদ্ধারে আমাকে সাহায্য করবে? লিপিটির পাঠোদ্ধার করা সামোয় খুবই প্রয়েজন।
বিনীত
এরিখ স্যামসন
সিনোসিটা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি আমার নাম কেন পাঠিয়েছে ভেবে বের করতে গিয়ে মনে পড়ল— গত সামারে লাইব্রেরি থেকে রোসেটা স্টোনের উপর একটি বই আমি ইস্যু করেছিলাম।
প্রাচীন মিশরীয় হিরোলোগ্রাফির পাঠোদ্ধারে রোসেটা স্টোন বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। ঘটনাটা কী জানার জন্যে বইটি পড়া। বইটি পড়ে আরেকটি বই ইস্যু করি অশোকের শিলালিপি। অশোকের শিলালিপি অনেক দিন ধরে পাঠোদ্ধার করা যাচ্ছিল না— এক ইংরেজ সাহেব শিলালিপির পাঠোদ্ধার করেন। এই দুটি বই পড়ার পর আমি মায়াদের ভাষা পাঠোদ্ধারের চেষ্টাবিষয়ক আরেকটি বই ইস্যু করি। এই থেকেই কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ানের ধারণা হয়েছে আমি প্রাচীন ভাষার একজন গবেষক?
আমি যদি প্রাচীন ভাষার গবেষক হইও বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান আমার অনুমতি ছাড়া আমার নাম-ঠিকানা কাউকে দিতে পারে না। এসব বিষয়ে আমেরিকায় নিয়মকানুন খুব কঠিন। আমি ঠিক করলাম লাইব্রেরিয়ানকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করব।
জিজ্ঞেস করা হলো না। কারণ, আমি তখন খুবই ব্যস্ত। মানুষ তার এক জীবনে নানান ধরনের ব্যস্ততায় জড়িয়ে যায়। পিএইচ.ডি. থিসিস প্রস্তুতকালীন ব্যস্ততার সঙ্গে অন্য কোনো ব্যস্ততার তুলনা চলে বলে আমি মনে করি না। একটা চ্যাপ্টার লিখে প্রফেসরকে দেখাই, তিনি পুরোটা কেটে দেন। আবার লিখে নিয়ে যাই, আবারও কেটে দেন। আমি ল্যাবরেটরি রেজাল্টের যে ব্যাখ্যা দেই সেগুলি তার পছন্দ হয় না। তিনি যেসব ব্যাখ্যা দেন তা আমার পছন্দ হয় না। চলতে থাকে ধারাবাহিক কাটাকুটি খেলা।
মাঝে মাঝে রাগারাগিও হয়। যেমন, একদিন আমার প্রফেসর বললেন, আহমেদ, তোমাকে তো বেশ বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবেই জানতাম। এখন তোমার থিসিস পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছে তোমার আই কিউ এবং মিডিয়াম সাইজের কড মাছের আই কিউ কাছাকাছি। মাছেরটা বরং কিছু বেশি হতে পারে।
প্রফেসরের এই ধরনের কথাবার্তায় খুবই মন খারাপ হয়। এ্যাপার্টমেন্টে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করি। ভাত না খেয়ে থালা-বাসন ছুঁড়ে মারি। থিসিস লেখার সময় পিএইচ.ডি, স্টুডেন্টদের এই আচরণ খুবই স্বাভাবিক। আমেরিকার ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের এই বিষয়ে একটি স্টার্টির্সটিকসও আছে। তারা দেখিয়েছে–বিবাহিত ছাত্রদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার পিএইচ. ডি. করার সময়ে সবচেয়ে বেশি— শতকরা ৫৩। এই ৫৩-এর ভেতর ৯৭% বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে যখন ছাত্ররা তাদের থিসিস লেখা শুরু করে।
প্রতিদিন যে হারে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হচ্ছে তাতে মনে হয় আমি ওই স্টেজে দ্রুত চলে এসেছি। একদিন ঝগড়া চরমে উঠল। আমার কন্যার মাতা আমাকে হতভম্ব করে কন্যার হাত ধরে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হলো। সে নাকি নিউইয়র্কের দুটো টিকিট কাটিয়ে রেখেছে। আসছে দু মাস সে নিউইয়র্কে তার মামার কাছে থাকবে। আমার থিসিস লেখা শেষ হবার পর ফিরবে। যদি কোনো কারণে থিসিস লেখা শেষ না হয় তা হলে আর ফিরবে না।