আমি তার চেয়েও কঠিন গলায় বললাম, যাব না।
পুলিশে খবর দিচ্ছি। পুলিশ এসে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।
কোন অসুবিধা নেই, খবর দিন।
ইউ রাস্কেল, মাতলামি করার জায়গা পাও না?
গালাগালি করছেন কেন? আমিতো আপনাকে গালি দিচ্ছি না।
ভদ্রলোক রাগে জ্বলতে জ্বলতে বাড়ীর ভেতর চলে গেলেন। তার পরপরই শুরু হল বৃষ্টি। ঢালাও বর্ষণ। আমি ভিজছি নির্বিকার ভঙ্গিতে। সঙ্গে-সঙ্গে বুঝছি যে জ্বর এসে যাচ্ছে। সারাদিন রোদে পোড়ার পড়ে এই ঠাণ্ডা বৃষ্টি সহ্য হবে না। তখন একটা বেপরোয়া ভাব চলে এসেছে- যা হওয়ার হবে। ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে শরীর অবসন্ন। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।
ইতোমধ্যে আমি আশেপাশের মানুষদের কৌতূহলী দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছি। বেশ কয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? এখানে দাঁড়িয়ে ভিজছেন কেন? আমি তাদের সবাইকে বলেছি, আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আমি একজন পাগল মানুষ।
মেয়েটির বাড়ি থেকেও হয়ত টেলিফনে এই ঘটনার কথা কাউকে কাউকে জানানো হয়েছে। তিনটি গাড়ি তাদের বাড়িতে এল। গাড়ির আরোহীরা রাগি ভঙ্গিতে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলেন।
রাত ন’টা বাজল বৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও থামল না। জ্বরে আমার গা পুড়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। দারোয়ান এসে আমাকে ফিসফিস করে বলল, সাহেব পুলিশ আনতে চাইতেছেন, বড় আফা রাজি না। বড় আফা আপনের অবস্থা দেইখ্যা খুব কানতাছেন। টাইট হইয়া বইসা থাকেন।
আমি টাইট হয়ে বসে রইলাম।
রাত এগারটা বাজল। ওদের বারান্দায় বাতি জ্বলে উঠল। বসার ঘরের দরজা খুলে মেয়েটি বের হয়ে এল। মেয়েটির পেছন-পেছন ওদের বাড়ীর সব ক’জন মানুষ। ওরা কেউ বারান্দায় নামল না। মেয়েটি একা এগিয়ে এল। আমার সামনে এসে দাঁড়াল এবং অসম্ভব কোমল গলায় বলল, কেন এমন পাগলামি করছেন?
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কারন এই মেয়ে সেই মেয়ে নয়। অন্য একটি মেয়ে। একে আমি কোনদিন দেখি নি। মরিস মাইনর গাড়ির দ্রাইভার আমাকে ভুল ঠিকানা দিয়েছে। হয়ত ইচ্ছে করেই দিয়েছে।
মেয়েটি নরম গলায় বলল, আসুন, ভেতরে আসুন। টেবিলে খাবে দেয়া হয়েছে। আসুন তো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। বলতে চেষ্টা করলাম, কিছু মনে করবেন না। আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনি সেই মেয়ে নন। আপনি অন্য একজন। মেয়েটির মমতায় ডুবানো চোখের দিকে তাকিয়ে এই কথা বলা সম্ভব হল না। এত মমতা নিয়ে কোন নারী আমার দিকে তাকায় নি।
জ্বরের ঘোরে আমি ঠিকমতো পা ফেলতে পারছিলাম না। মেয়েটি বলল, আপনার বোধয় শরীর খারাপ। আপনি আমার হাত ধরে হাঁটুন। কোন অসুবিধা নেই।
বাসার সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে কঠিন চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের সবার কঠিন দৃষ্টি উপেক্ষা করে মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিল। যে গভীর ভালোবাসায় হাত বাড়াল সে গভীর ভালোবাসা উপেক্ষা করার ক্ষমতা ঈশ্বর মানুষকে দেন নি। আমি তার হাত ধরলাম। এই কুড়ি বছর ধরে ধরেই আছি। মাঝে-মাঝে একধরনের অস্থিরতা বোধ করি। ভ্রান্তির এই গল্প আমার স্ত্রীকে বলতে ইচ্ছে করে। বলতে পারি না। তখন আপনার মতো অপরিচিত কাউকে খুঁজে বের করি। গল্পটা বলি। কারন আমি জানি- এই গল্প কোন দিন আমার স্ত্রীর কানে পৌঁছাবে না। আচ্ছা ভাই, উঠি। আমার ট্রেন এসে গেল।”
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। দূরে ট্রেনের আলো আলো দেখা যাচ্ছে। রেললাইনের ঘড়ঘড় শব্দ উঠছে। ট্রেন সত্যি-সত্যি এসে গেল।
লিপি
জাংক মেইল বলে একটা ব্যাপার আছে যা চরিত্রগত দিক দিয়ে ১০০ ভাগ আমেরিকান। একমাত্র আমেরিকাতেই মেইল বক্স খুললে হাতভর্তি চিঠিপত্র পাওয়া যায়। যার ভেতর একটা বা দুটো কাজের চিঠি, বাকি সবই অকাজের বা আমেরিকান ভাষায়— জাংক মেইল।
জাংক চিঠিগুলি চট করে আলাদা করাও মুশকিল। খাম দেখে মনে হবে খুব জরুরি কিছু চিঠি। চিঠি শেষ পর্যন্ত পড়লে ভুল ভাঙবে। একটা নমুনা দেই—
প্রিয় হুমায়ুন,
তুমি কি জানো তুমি একজন অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ব্যক্তি? টেলিফোন ডাইরেক্টরি থেকে এক মিলিয়ন র্যানডম নাম্বার নিয়ে একটি সুইপস্টেক করা হয়েছে। যার বিশ জন ফাইন্যালিস্টের মধ্যে তুমি এক জন। প্রথম পুরস্কার এক সপ্তাহ বিশ্বভ্রমণের জন্যে দুটি প্রথম শ্রেণীর বিমানের টিকিট। দ্বিতীয় পুরস্কার চার দিনের জন্যে ফ্লোরিডা প্যাকেজ।
আমাদের নিয়মানুসারে বিশ জন ফাইন্যালিস্টকে আমাদের কোম্পানির একটি করে প্রোডাক্ট কিনতে হবে। আমরা ক্যাটালগ পাঠালাম তুমি কোনটি কিনতে চাও তাতে টিক মার্ক দিয়ে সেই পরিমাণ ডলার আমাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে।
আশা করি তুমি এই সুযোগ হারাবে না। তোমাকে সুইপস্টেকের ফাইন্যালিস্টদের একজন হবার জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ।
…..
জাংক মেইলগুলি প্রথম লাইন পড়ে ফেলে দেয়াই নিয়ম। আমি তা করি। কেন জানি খুব আগ্রহ নিয়ে প্রতিটি চিঠি শেষ পর্যন্ত পড়ি। যা বলে তা বিশ্বাসও করি। আমেরিকানরা চিঠি লিখে মিথ্যা কথা বলবে এটা ভাবতেও আমার কাছে খারাপ লাগে। এই গল্পটি জাংক মেইল নিয়ে। প্রস্তাবনা অংশ শেষ হয়েছে, এখন মূল গল্পে আসি।
১৯৮০ সালের জুন-জুলাই মাসের ঘটনা। আমি তখন নর্থডেকোটায়। স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছি। হঠাৎ একদিন মেইল বক্সে একটা চিঠি পেলাম। চিঠিটা এ রকম—