দুটি পঞ্চাশ টাকার নোট বের হল। নীলু কোনো কথা বলল না।
তুমি এত গম্ভীর কেন নীলু?
তোমার মতো শুধু-শুধু হাসতে পারি না। বাসায় যাব, এখন চা-টা খাব না।
প্লিজ নীলু, এরকম কর কেন তুমি?
রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই বড়-বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল। রঞ্জু ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে বলল, বেশ হয়েছে। যতক্ষণ বৃষ্টি না থামবে ততক্ষণ বন্দি।
সে এবার আরাম করে আরেকটি সিগারেট ধরাল। নীলু বলল, এই নিয়ে কটি সিগারেট খেলে?
এটা হচ্ছে ফিফথ।
সত্যি?
হুঁ।
গা ছুঁয়ে বল।
আহ কী সব মেয়েলি ব্যাপার। গা ছুঁয়ে বললে কী হয়?
হোক না হোক তুমি বল।
রঞ্জু ইতস্তত করে বলল, আর সিগারেট খাব না। ওয়ার্ড অব অনার। মরদক বাত হান্তিকা দাঁত।
তারা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরুল সন্ধ্যার ঠিক আগে-আগে। বৃষ্টি নেই। নিয়ন আলোয় ভেজা রাস্তা চিকমিক করছে।
রঞ্জু বলল, রিকশা করে একটু ঘুরবে নীলু?
উঁহু।
বেশ। চল রিকশী করে তোমাকে ঝিকাতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
হ্যাঁ, পরে কেউ দেখুক।
সন্ধ্যাবেলা কে আর দেখবে? একটা রিকশা ডাকি?
আচ্ছা ডাকো।
রিকশায় উঠতে গিয়ে রঞ্জু দেখল নীলুর চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
সে দারুণ অবাক হয়ে গেল।
কী ব্যাপার নীলু?
খুব খারাপ লাগছে। কাল যদি ওরা আমাকে পছন্দ করে ফেলে?
রঞ্জু দরাজ গলায় হেসে উঠল— করুক না পছন্দ, আমরা কোর্টে বিয়ে করে ফেলব।
তারপর আমাকে তুলবে কোথায়, খাওয়াবে কী? দুটি টিউশনি ছাড়া আর কী আছে তোমার?
এম.এ. ডিগ্রিটা আছে। সাহস আছে। আর …
আর কী?
আর আছে ভালোবাসা।
নীলু এবং রঞ্জু দুজনেই এবার একত্রে হেসে উঠল। রঞ্জু অত্যন্ত উৎফুল্ল ভঙ্গিতে আরেকটি সিগারেট ধরাল। নীলু মৃদুস্বরে বলল, এই তোমার সিগারেট ছেড়ে দেয়া? ফেল এক্ষুনি।
এটাই লাস্ট ওয়ান।
উহুঁ।
রঞ্জু সিগারেট ছুড়ে ফেলল রাস্তায়।
পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে সন্ধ্যাবেলা কিন্তু তোড়জোড় শুরু হল সকাল থেকে। নীলুর বড়ভাই এই উপলক্ষে অফিসে গেলেন না। নীলুর ছোটবোন বিলুও স্কুলে গেল না। এই বিয়ের যিনি উদ্যোক্তা— নীলুর বড়মামা, তিনিও সাতসকালে এসে হাজির। নীলু তার এই মামাকে খুব পছন্দ করে কিন্তু আজ যখন তিনি হাসিমুখে বললেন, কী রে নীলু বিবি, কী খবর? তখন নীলু শুকনো মুখে বলল, ভালো।
মুখটা এমন হাঁড়ির মতো করে রেখেছিস কেন? তোর জন্যে একটা শাড়ি এনেছি। দেখতে পছন্দ হয় কি না।
শাড়ি কীজন্যে মামা?
আনলাম একটা ভালো শাড়ি। এই শাড়ি পরে সন্ধ্যাবেলা যখন যাবি ওদের সামনে …।
নীলু নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে এল।
রান্নাঘরে নীলুর ভাবী রেহানা মাছ কুটছিল। কলেজ যেদিন ছুটি থাকে সেদিন নীলু রান্নায় সাহায্য করার নামে বসে-বসে গল্প করে। আজ নীলু দেখল রেহানা ভাবীর মুখ গম্ভীর। নীলু পাশে এসে বসতেই সে বলল, তোমার ভাই কাল রাতে আমাকে একটা চড় মেরেছে। তোমার বিশ্বাস হয় নীলু?
নীলু স্তম্ভিত হয়ে গেল। রেহানা বলল, তুমি বিয়ে হয়ে চলে গেলে আমার কেমন করে যে দিন কাটবে।
নীলু বলল, দাদাটা একটা অমানুষ। অভাবে-অভাবে এরকম হয়েছে ভাবী। তুমি কিছু মনে করো না।
না, মনে করব কী? আমার এত রাগটাগ নেই।
দুজনে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। রেহানা একসময় বলল, তোমার ভাই পাঁচ টাকা মানত করেছে। তোমাকে যদি ওদের পছন্দ হয় তবে পাঁচ টাকা ফকিরকে দিবে।
নীলু কিছু বলল না। রেহানা বলল, পছন্দ তো হবেই। তোমাকে পছন্দ না করলে কাকে করবে? তুমি কি আর আমার মতো? কত মানুষ যে আমাকে দেখল নীলু, কেউ পছন্দ করে না। শেষকালে তোমার ভাই পছন্দ করল। সুন্দরটুন্দর তো সে বুঝে না।
নীলু হেসে উঠল। রেহানা বলল, চা খাবে?
নীলু জবাব দিল না।
তোমাকে চা খাওয়াবার সুযোগ কি আর হবে? বড়লোকের বউ হবে। মামা বলেছিলেন ওদের নাকি দুটি গাড়ি। একটা ছেলেরা ব্যবহার করে, একটা বাড়ির মেয়েরা।
নীলু চুপ করে রইল। রেহানা বলল, ছেলের এক চাচা হাইকোর্টের জজ।
হাইকোর্টের জজ দিয়ে আমি কী করব ভাবী?
তুমি যে কী কথা বল নীলু, হাসি লাগে।
দুপুর থেকে নীলুর দাদা গম্ভীর হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তাঁকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হল। নীলু ভেবে পেল না এই সামান্য ব্যাপারে দাদা এত চিন্তিত হয়ে পড়েছে কেন। একটি ছেলে মোটা মাইনের একটা চাকরি করলে এবং ঢাকা শহরে তার ঘরবাড়ি থাকলেই এরকম করতে হয় নাকি?
অকারণে রেহানা নীলুর দাদার কাছে ধমক খেতে লাগল।
বললাম একটা ফুলদানিতে ফুল এনে রাখতে।
এই বুঝি ঘর পরিষ্কারের নমুনা?
টেবিলক্লথটাও ইস্ত্রি করিয়ে রাখতে পার নি?
নীলুর বড়মামা অনেকবার তাকে বুঝালেন কী করে সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। নম্র ভঙ্গিতে চা এগিয়ে দিতে হবে। কিছু জিজ্ঞেস করলে খুব কম কথায় উত্তর দিতে হবে। নীলুর রীতিমতো কান্না পেতে লাগল। সাজগোজ করাবার জন্যে মামি এলেন বিকেলবেলা। সন্ধ্যা হবার আগেই নীলু সেজেগুজে বসে রইল।
সমস্ত ব্যাপারটি যেরকম ভয়াবহ মনে হয়েছিল সেরকম কিছুই হল না। ছেলের বাবা খুব নরম গলায় বললেন, কী নাম মা তোমার?
নীলাঞ্জনা।
খুব কাব্যিক নাম। কে রেখেছে?
বাবা।
তিনি আর কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। দেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে নীলুর মামার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। ছেলে নিজেও এসেছিল। নীলু তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারল না। চা-পর্ব শেষ হবার পর নীলু যখন চলে আসছে তখন শুনল একজন ভদ্রমহিলা বলছেন, খুব পছন্দ হয়েছে আমাদের। আগস্ট মাসে বিয়ে দিতে আপনাদের কোনো অসুবিধা আছে?