ইন্টারে পড়ার সময় গিয়েছিলাম— পরে আর পড়াশোনা হয় নাই। চেষ্টাও করি নাই। ঐ সব দেশে পড়াশোনা না-জানা লোকের চাকরির সুবিধা বেশি। পড়াশোনা জানা লোক তো আর অড জব করতে পারবে না। লজ্জা লাগবে। ঠিক বলেছি না?
মিলি জবাব দিল না। লোকটা মিলির জবাবের জন্যে অপেক্ষা করল না। এক গাদা খাবারের অর্ডার দিল। মিলি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কুস্তিগীর চেহারার একজন মানুষ। কুস্তিগীরদের যেমন শরীরের তুলনায় মাথা ছোট হয়। এরও সে-রকম। সবচেয়ে কুৎসিত হচ্ছে লোকাটার ছোট ছোট কান। কানভর্তি লোম শজারুর কাঁটার মতো বড় হয়ে আছে। মিলির কি লোকটাকে বলা উচিত— আপনি পরের বার যখন চুল কাটাতে যাবেন তখন অবশ্যই দয়া করে কানের চুলগুলোও কাটাবেন। লোকটা এখন দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে দাঁত খুঁচাচ্ছে। দাঁত থেকে ময়লা কেরে ন্যাপকিনে মুছছে। মিলির কি উচিত না উঠে চলে আসা?
মিলি বলল, আপনাকে কি উচিত না দাঁত খুঁচানো বন্ধ রাখা? দৃশ্যটা দেখতে ভালো না। দাঁত খুঁছনো, দাঁত ব্রাশ এই কাজগুলা আমারা বাথরুমে করি। সেইটাই শোভন।
সুজাত আলি এই কথায় লজ্জা পেল কি-না তা বুঝা গেল না। তবে সে দাঁত খুঁচানো বন্ধ করল। সে আরেকটা সিগারেট বের করেছে। মনে হয় খাবার আসার আগে আগে সে আরেকটা সিগারেট খাবে। সে মিলির দিকে ঝুঁকে এসে বলল, বাংলাদেশের এই এক মজা রেস্টুরেন্টে সিগারেট খেতে দেয়। আমেরিকায় অসম্ভব।
মিলি বলল, বাংলাদেশে অনেক কিছুই সম্ভব যেটা বাইরে সম্ভব না। এই যে আপনি মনের আনন্দে বিয়ের জন্যে একের পর এক মেয়ে দেখে যাচ্ছেন, এই কাজটা কি অন্য কোথাও পারবেন?
সুজাত জবাব দিল না। খাবার চলে এসেছে। সে মনের আনন্দে নিজেই হাত বাড়িয়ে খাবার নিচ্ছে। এখন আবার প্রতিটি খাবার নিচু হয়ে এঁকে শুকে দেখছে। মিলির গা গুলিয়ে উঠছে। সে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, দ্বিতীয় যে মেয়েটাকে দেখলেন তার অবস্থা কী?
সুজাত বলল, খুব ভালো মেয়ে। যেমন চেহারা তেমন স্মার্ট। ফড়ফড় করে ইংরেজি বলে, নাম সীমা। লম্বা চুল। মেয়েও লম্বা।
তাকে বিয়ে করলেন না কেন?
সে রাজি হলো না। কথাবর্তা অনেক দূর এগিয়েছিল। তাকে ডায়মন্ডের আংটিও দিয়েছিলাম। আংটি সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। বিদেশে ডায়মন্ড সস্তা। মাঝে মাঝে সেল হয়। আমি সেল থেকে হাফ প্রাইসে কিনেছিলাম। দুইশ পঁচিশ ডলার।
বিয়ে ভাঙার পর আংটি ফেরত পেয়েছেন?
জি। আমার সঙ্গেই আছে। দেখবে?
না।
আমি শুরু করে দিলাম। তুমি সত্যি খাবে না? চিকেনের একটা ড্রামস্টিক খাও?
আপনি খান। আমি আপনার খাওয়া দেখি।
মিলি সত্যি সত্যি আগ্রহ নিয়ে খাওয়া দেখছে।
লোকটা খাবারের উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মুখ থেকে হুম হাম জাতীয় শব্দও হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাড় ভাঙার কড়মড় শব্দ। মিলি বলল, এদের রান্না কি ভালো?
হুঁ। আমার কাছে কানো রান্নাই খারাপ লাগে না। আমি সবই খাই। শুধু তিতা করলা খাই না। তুমি খাও?
হ্যাঁ খাই।
তোমার সাথে এই একটা অমিল হয়ে গেল।
তাই তো দেখছি। পাত্রী হিসেবে কি আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে?
হুঁ। তুমি খুবই সুন্দর।
শায়লা, সীমা ওদের চেয়েও?
হুঁ। শুধু একটা সমস্যা।
বলুন কী সমস্যা।
তোমার পিতা-মাতা নাই। তারা তোমার অল্প বয়সে গত হয়েছে। তুমি বড় হয়েছে তোমার খালার কাছে। তোমাকে বিবাহ করলে শ্বশুর-শাশুড়ির আদর পাব না। আমি আবার আদরের কাঙাল।
আপনি আদরের কাঙাল?
হুঁ। আমার পিতা-মাতাও তোমার মতো আমি ছোট থাকতেই বেহেশতে নসিব হয়েছেন। এর তার বাড়িতে বড় হয়েছি। সারা জীবন কষ্ট করেছি। সবচেয়ে বড় যে কষ্ট সেটা করেছি।
সবচেয়ে বড় কষ্ট কোনটা?
না খাওয়ার কষ্ট। এই কষ্টের সীমা নাই। তুমি কি কোনোদিন না খেয়ে কাটায়েছ?
না।
তুমি বিরাট ভাগ্যবতী।
তাইতো দেখছি।
আমার বিষয়ে আর কিছু জানতে চাইলে বল। বিয়ের আগে দুই পক্ষের সব পরিষ্কার থাকা ভালো।
মিলি ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনি তো মনে হয় মোটামুটি নিশ্চিত যে আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে। তা কিন্তু হচ্ছে না। আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি। আমার পরেও নিশ্চয়ই আরও অনেক মেয়ে দেখবেন। তাদের কোনো একজনকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে যান।
সুজাত বলল, আর দেখব না।
বিয়ে না করেই ফেরত যাবেন?
হুঁ।
আর মেয়ে দেখবেন না–কারণটা কী?
লজ্জা লাগে।
কীসের লজ্জা?
সবকিছু মিলায়ে লজ্জা। নিজেকে নিয়ে লজ্জা লাগে–না আছে চেহারা, না আছে পড়াশোনা। যোগ্যতা একটাই বিদেশে থাকি। তোমার মতো যেসব মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কথা বলি তাদের জন্যেও লজ্জা লাগে। সুন্দরী, বিদ্যাবতী মেয়ে ক্যাব ড্রাইভার বিয়ে করার জন্যে তৈরি।
মিলি কঠিন গলায় বলল। আপনি ভুল করছেন আমি কিন্তু জানতাম না আপনি ক্যাব ড্রাইভার। আমাকে বলা হয়েছে আপনি কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করছেন।
ও আচ্ছা।
মিলি তার গলায় কাঠিন্য কিছুমাত্র না কমিয়ে বলল, আপনার সম্পর্কে আমি অনেক খারাপ খারাপ কথা বলতে পারি কিন্তু বলব না।
সুজাত বলল, একটা বল।
আপনার চেহারায় চোর ভাব আছে। আচ্ছা আপনি কি কখনো চুরি করেছেন?
সুজাত সহজ গলায় বলল, একবার চুরি করেছি। দেশ ছেড়ে বিদেশ যাব। টাকা শর্ট। পরে ছোট মামির গয়না চুরি করলাম। পরে অবশ্য সব শোধ করেছি।