কাক চুপ করে গেল।
আমি তাকিয়ে আছি। অবাক হয়ে এমন একজনকে দেখছি যে হৃদয়ে ভালোবাসার সমুদ্র ধারণ করে পিশাচ হবার সাধনা করে যাচ্ছে।
বিভ্রম
মিলির হঠাৎ মনে হলো তার সামনে বসে থাকা যুবকটা বিরাট চোর। এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। তারা দুজন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে এসেছে। কোনার দিকের একটা টেবিল তাদের জন্যেই বুক করা। মিলির বড় খালা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মালিকের সঙ্গেও কথা বলে রেখেছেন— কোনার দিকের একটা টেবিল দেবেন। বেয়ারারা যেন ঘনঘন বিরক্ত না করে। ওঁরা দুএক থাকবে।
ঘটনাটা হচ্ছে–মিলির সামনে বসে থাকা ছেলেটার নাম সুজাত আলি। নিউইয়র্কে থাকে। দেশে এসেছে বিয়ে করতে। মিলির বড়খালা সালেহা বেগম খুব চেষ্টা করছেন যেন ছেলেটার সঙ্গে মিলির বিয়ে হয়ে যায়। মিলির বিয়ে নিয়ে খুব ঝামেলা হচ্ছে। একটার পর একটা বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। মিলির চেহারা মোটেই অসুন্দর না। গায়ের রঙ চাপা। নাকটা মোটা। মোটা নাকে তাকে খারাপ লাগে না। মিলির নিজের ধারণা মোটা নাকের কারণে তার চেহারায় মায়া ভাব বেড়েছে। কয়েক দিন আগে HBO-তে টাইম মেশিন নামে সে একটা ছবি দেখেছে। ছবির নায়িকার সঙ্গে তার মিল আছে। নায়িকার গায়ের রঙ কালো। নাক থ্যাবড়া। তারপরেও এত মিষ্টি চেহারা।
হ্যান্ড ব্যাগে রাখা মিলির মোবাইল টেলিফোন বাজছে। নিশ্চয়ই তার বড় খালা। উনার টেনশান বাতিক আছে। এই নিয়ে দশ মিনিটের মাথায় তিনবার টেলিফোন করলেন।
মিলি।
হুঁ।
ছেলে এসেছে?
হুঁ।
এখন তোর সামনে?
না। সিগারেট কিনতে গেছে।
তোর সঙ্গে কথা হয়েছে?
না। শুধু বলেছে সিগারেটের প্যাকেট ফেলে এসেছে। কিনতে গেছে।
ছেলেকে দেখে কেমন মনে হলো? তোর ফার্স্ট ইমপ্রেশন কী?
চেহারায় চোর ভাব আছে।
চেহারায় চোর ভাব আছে মানে?
দেখেই মনে হয়েছে বিরাট চোর। খালা আমি রাখি। চোরটা আসছে।
মিলি মোবাইল পুরোপুরি অফ করে দিল। বড় খালা একটু পরপর টেলিফোন করবেন। লাইন না পেয়ে বিরক্ত হবে। বিরক্ত হলেই ভালো–একটা চোরের সঙ্গে তিনি বিয়ের কথাবার্তা চলাচ্ছেন।
সুজাত আলি চেয়ারে বসতে বসতে আনন্দিত গলায় বলল, বাংলাদেশে সিগারেট তো খুবই সস্তা। মাত্র ৭৫ টাকা নিল। নিউইয়র্কে এই প্যাকেট কিনতে লাগত চার ডলার। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় আড়াইশ টাকা।
মিলি বলল, দেশ থেকে বেশি করে সিগারেট কিনে নিয়ে যান।
এক কার্টনের বেশি নিতে দে না।
চুরি করে নিয়ে যাবে। স্যুটকেস ভর্তি থাকবে সিগারেট।
সুজাত আলি শব্দ করে হাসছে। মিলি প্রায় শিউরে উঠল। লোকটার কালো মাড়ি বের হয়ে এসেছেন। কালো মাড়ির উপর ঝকঝকে ধারালো দাঁত। সে দুই হাত টেবিলে রেখেছে। মোটা মোটা আঙুল। হাত ভর্তি হলাম। লোকটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, খাবারের অর্ডার দিয়ে দাও।
মিলি একবার ভাবল বলে, আমার সঙ্গে আজ আপনার প্রথম দেখা। আমি কোনো বাচ্চা মেয়ে না। এই বৎসর ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাশ করেছি। প্রথম দেখাতেই আমাকে তুমি তুমি করে কেন বলছেন? সে কিছু বলল না।
লোকটা এখন নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। মিলির কী বলা উচিত দয়া করে নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়বেন না। ঠেলাওয়ালারা বিড়ি খেয়ে নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে।
মিলি।
জি।
স্যুপের অর্ডার দিবে না। আমি স্যুপ খাই না।
পানি খেয়ে পেট ভর্তি।
অর্ডারটা আপনিই দিন।
ঠিক আছে।
সিগারেট শেষ করে নেই।
মিলি বলল, নিউইয়র্কে আপনি কী করেন?
অড জব করি।
অড জব কী?
যখন যেটা পাই। উইক এন্ডে ক্যাব চালাই।
মিলি বলল, বড় খালা বলেছিলেন আপনি কম্পিউটার সায়েন্স পড়ছেন।
সুজাত আলি বলল, আত্মীয়স্বজনরা এইটা ছড়ায়েছে। যাতে আমাকে বিয়ে দিতে পারে এইজন্যে। ট্যাক্সি ড্রাইভার শুনলে তো কেউ মেয়ে বিয়ে দিবে না। ঠিক না?
মিলি বলল, কেউ-কেউ হয়তো দিবে। যারা মহা বিপদ আছে তারা। আপনি তো অনেক মেয়ে দেখেছেন। তাদের অবস্থা?
বেশি মেয়ে দেখি নাই। তুমি থার্ড। এর আগে দুইজনকে দেখেছি। ওনলি টু।
সবই চাইনিজ রেস্টুরেন্টে?
উহুঁ। একজনকে দেখলাম বসুন্ধারা বলে একটা বড় শপিং কমপ্লেক্স যে করেছে সেখানে। সেখানে নয়তলায় ফুডকোর্ট করেছে। ফুডকোর্টে আমি একটা বার্গার খেয়েছি আর মেয়েটা কোক খেয়েছে।
মেয়েটার নাম মনে আছে?
নামটা ভুলে গেছি। আচ্ছা দাঁড়াও তোমাকে জেনে দিব। তালিব্যশ দিয়ে নাম। নাম।
মিলি বলল, মেয়েকে পছন্দ হয়েছিল?
সুজাত আলি ঝলল, পছন্দ হয়েছে। মেয়ের গায়ের রঙ ভালো। মুখের কাটিং ভালো। শুধু শর্ট। উঁচা হাই হিল পরে এসেছে তারপরেও শর্ট। মেয়েটার নাম এখন মনে পড়েছে। শায়লা।
মেয়েটাকে বাতিল করে দিলেন?
আরে না। আমি বাতিল করব কেন? সত্যি কথা বলতে কি শর্ট মেয়ে আমার পছন্দ। আমার মা ছিল শর্ট। বাবা বিরাট লম্বা। লম্বা বাবার পাশে শর্ট মা গুটুর গুটুর করে হাঁটতো। দেখতে ফাইন লাগত।
বিয়ে মেয়ে পক্ষ বাতিল করে দিল?
হুঁ।
কেন?
আছে ঘটনা। বলতে চাই না। খাবারের অর্ডার দিয়ে দেই? ভালো ভুখ লেগেছে।
দিন। আপনার একার জন্যে দেবেন। আমি শুধু একটা কোক কিংবা পেপসি। খাব।
সুজাত আলি বলল, শুধু কোক পেপসি কেন?
মিলি বলল, শায়লা মেয়েটাও তো শুধু কোকই খেয়েছিল।
সে আর তুমি কি এক?
হ্যাঁ, এক। আপনি খাবারের অর্ডার দিন। ভালো কথা আপনার পড়াশোনা কী?