ঘরের ভিতর হারিকেন জ্বলছিল। আনিস সলতে বাড়িয়ে দিল। টুকুন কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। আনিস চুমু খেল তার কপালে। পরীর দিকে তাকিয়ে বলল, জ্বর নাকি টুকুনের?
হুঁ।
কবে থেকে?
কাল থেকে। সর্দি জ্বর। ও কিছু না। ঘাম দিচ্ছে, এক্ষুনি সেরে যাবে।
আনিস পরীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। পরীর লজ্জা করতে লাগল। পরী বলল, হাসছ কেন?
এমনি। পরী তোমার জনো শাড়ি এনেছি একটা। দেখ তো পছন্দ হয় কিনা।
পরী খুশি-খুশি গলায় বলল, অনেকগুলি পয়সা খরচ করলে তো।
শাড়িটা পর, দেখি কেমন তোমাকে মানায়।
রুনুর জন্যে একটা শাড়ি আনলে না কেন? বেচারির একটাও ভালো শাড়ি নেই।
পয়সায় কুলোলে আনতাম। আরেকবার আসার সময় আনব।
পরী ইতস্তুত করে বলল, আমার একা একা শাড়ি নিতে লজ্জা লাগবে। এইটি রুনুর জন্যে থাক! আরেকবার নিয়ে এসো আমার জন্যে।
আনিস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বেশ থাক তবে, আজ রাতের জন্য পর না দেখি?
শাড়ির ভাঁজ ভেঙে যাবে যে। রুনু মনে করবে আমার জন্যে এনেছিলে পরে তাকে দিয়েছ।
আচ্ছা, তাহলে থাক।
পরী লজ্জিত স্বরে বলল, বিয়ের শাড়িটা পরব? যদি বল তাহলে পরি।
পরী লজ্জায় লাল হয়ে ট্রাঙ্কের তালা খুলতে লাগল। আনিস বলল, টুকুন দেখতে তোমার মতো হয়েছে, তাই না?
হ্যাঁ, আব্বা তাকে ছোট পরী ডাকে। আচ্ছা টুকুনের একটা ভালো নাম রাখ না কেন?
জরী রাখব তার নাম।
জরী আবার কেমন নাম?
তোমার সঙ্গে মিলিয়ে রাখলাম। পরীর মেয়ে জরী।
পরী হেসে উঠল। হাসি থামলে বলল, অন্যদিকে তাকিয়ে থাক, শাড়ি বদলাব।
কী হয় অন্য দিকে তাকালে?
আহ্ শুধু অসভ্যতা।
আনিস মাথা নিচু করে টুকুনকে আদর করতে লাগল। পরী হালকা গলায় বলল, দেখ তো কেমন লাগছে?
একেবারে লাল পরী।
ইশ, শুধু ঠাট্টা।
রান্নাঘর থেকে ধুপধাপ শব্দ উঠছে।
আনিস বলল, এত রাতে ধান কুটছে কেন?
ধান কুটছে না চাল ভাঙছে। তোমার জন্যে পিঠা তৈরি হবে।
নিশ্চয়ই রুনুর কাণ্ড।
আনিস পরীর হাত ধরে তাকে কাছে টানল। পরীর চোখে আবার পানি এসে পড়ল। গাঢ়স্বরে বলল, আবার কবে আসবে?
জুলাই মাসে।
কতদিন থাকবে তখন?
অ-নে-ক দিন।
তুমি এত রোগা হয়ে গেছে কেন? পেটের ঐ ব্যথাটা এখনো হয়?
হয় মাঝে-মাঝে।
টুকুন কেঁদে জেগে উঠল। পরী বলল, জ্বর আরো বেড়েছে। ও টুকুন সোনা, কে এসেছে দেখ। দেখ তোমার আব্ব এসেছে।
আনিস বলল, আমার কোলে একটু দাও তো পরী। আরে-আরে মেয়ের একটা দাঁত উঠেছে দেখছি। কী কাণ্ড! ও টুকুন, ও জরী, একটু হাস তো মা। ও সোনামণি, দেখি তোমার দাঁতটা?
টুকুন তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। তাই দেখে আনিস ও পরী দুজনেই হাসতে লাগল।
আমার জরী সোনা কথা শিখছে নাকি, পরী? হুঁ। মা বলতে পারে। আর পাখি দেখলে বলে, ফা ফা।
আনিস হো-হো করে হেসে উঠল যেন ভীষণ একটা হাসির কথা। হাসি থামলে বলল, আমার জরী তোমার চেয়েও সুন্দর হবে। তাই না পরী?
আমি আবার সুন্দর নাকি?
না, তুমি ভীষণ বিশ্রী।
আনিস আবার হেসে উঠল। তার একটু পরেই বাইরে কাক ডাকতে লাগল। আনিসের বাবার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। ও আনিস, ও আনিস।
জি বাবা।
এখন রওনা না দিলে ট্রেন ধরতে পারবি না বাবা।
আনিস টুকুনকে শুইয়ে দিল বিছানায়। পরী কোনো কথা বলল না।
আনিস বাইরে বেরিয়ে দেখল চাদ হেলে পড়েছে। জোছনা ফিকে হয়ে এসেছে। বিদায়ের আয়েজন শুধু হল। ঘুমন্ত ঝুনুকে আবার ঘুম থেকে টেনে তোলা হল। সে হঠাৎ বলে ফেলল, ভাবী আজ বিয়ের শাড়ি পরেছে কেন?
কেউ তার কথার কোনো জবাব দিল না। মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী আকাশের চাদ। পরীকে অহেতুক লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্যেই হয়তো একখণ্ড বিশাল মেঘের আড়ালে তার সকল জোছনা লুকিয়ে ফেলল।
লম্বা-লম্বা পা ফেলে এগিয়ে চলল আনিস। শেষরাতের ট্রেনটা যেন কিছুতেই মিস না হয়।
পিশাচ
স্যার, আমি পিশাচ-সাধনা করি।
আমি কৌতূহল নিয়ে পিশাচ সাধকের দিকে তাকালাম। মামুলি চেহারা। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথায় চুল নেই। শরীরের তুলনায় মাথা বেশ ছোট। সেই মাথা শারীরিক কোনো অসুবিধার কারণেই হয়তো সারাক্ষণ বামদিকে ঝুঁকে আছে। তার হাতে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা পাখির খাঁচা। খাঁচায় যে পাখিটা আছে সেটা খুব সম্ভব কাক। পা ছাড়া পাখিটার আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কাকের পা বলেই মনে হচ্ছে।
লোকটার বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। গ্রামের অভাবী মানুষের বয়স চট করে ধরা যায় না। দুঃখ ধান্দায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরেই তাদের মধ্যে বুড়োটে ভাব চলে আসে। আমার কাছে মনে হলো, লোকটার বয়স চল্লিশের বেশি হবে না। মাথার চুল অবিশ্যি বেশির ভাগই পাকা। মুখের চামড়াও ঝুলে পড়েছে।
লোকটার পরনে টকটকে লাল রঙের নতুন লুঙ্গি। গলায় একই রঙের লাল চাদর উড়নির মতো ঝোলানো। এটাই সম্ভবত পিশাচ-সাধকদের পোশাক। সব ধরনের সাধকদের জন্যে পোশাক আছে— ড্যানসিং দরবেশরা আলখাল্লা পরেন, সন্ন্যাসীরা গেরুয়া পরেন, নাগা সন্ন্যাসীরা নগ্ন থাকেন। পিশাচ-সাধকরা লাল লুঙ্গি এবং লাল চাদর কেন পরবে না? আমি পিশাচ-সাধকের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, তুমি তাহলে পিশাচের সাধনা করো?
পিশাচ-সাধক সব কটা দাঁত বের করে হাসল। আনন্দিত গলায় বলল, কথা সত্য।
লোকটার দাঁত ঝকঝকে সাদা। গ্রামের মানুষরা পান-সিগারেট খেয়ে দাঁত কুৎসিতভাবে নোংরা করে রাখে, এর বেলায় তা হয়নি।