আনিস হাসিমুখে হাঁটতে লাগল।
বাড়ির উঠানে আনিস এসে দাঁড়াতেই আনিসের মা কাঁদতে লাগলেন। তার অভ্যাসই এরকম। যে-কোনো খুশির ব্যাপারে মরাকান্না কঁদতে বসেন। কেউ ধমক দিয়ে না-থামলে সে কান্না থামে না। আনিসের বাবা চেঁচিয়ে বললেন, একটা জলচৌকি এনে দে না কেউ, বসুক। সবগুলি হয়েছে গাধা। রুনু হাঁ করে দেখছিস কী? পাখা এনে হাওয়া কর।
আনিসের ছোটভাই আজিজ বলল, খবর দিয়ে আসে নাই কেন দাদা? খবর দিলেই ইস্টিশনে থাকতাম।
আনিস কিছু বলল না। জুতার ফিতা খুলতে লাগল। আনিসের মার কান্না তখনো থামে নি। এবার আজিজ ধমক দিল।
আহ্ মা, তোমার ঘ্যানঘ্যানানি থামাও।
সঙ্গে-সঙ্গে তার কান্না থেমে গেল। সহজ ও স্বাভাবিক গলায় তিনি বললেন, তোর শরীরটা এত খারাপ হল কী করে রে আনিস? পেটের ঐ অসুখটা সারে নি? চিকিৎসা করাচ্ছিস তো বাবা?
সবাই লক্ষ্য করল আনিসের শরীর সত্যি খারাপ হয়েছে। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে। গলি ভেতরে বসে গেছে। আনিসের বাবা বললেন, স্বাস্থ্য খারাপ হবে না? মেসের খাওয়া। পাঁচ বছর মেসে থাকলাম, জানি তো সব। বুঝলে আনিসের মা, মেসে খাওয়ার ধারাই ঐ।
পরী একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। আনিসের জন্য নতুন করে রান্না চড়াতে হবে। তবু তার ভেঁতরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। পরীর শাশুড়ি একসময় ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ও কী বউমা, সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন? রান্না চড়াও গিয়ে। তার আগে আনিসকে চা দাও এক কাপ।
পরী অপ্রস্তুত হয়ে রান্নাঘরে চলে এল। রুনু এল তার পিছু-পিছু।
রুনু হেসে বলল, আমি চা বানিয়ে আনছি, তুমি ভাইজানের কাছে থাকো ভাবী। পরী লজ্জা পেয়ে হাসল।
তুই তো ভারী ফাজিল হয়েছিস রুনু।
হয়েছি তো হয়েছি। তোমাকে একটা কথা বলি ভাবী।
কী কথা?
রুনু ইতস্তত করতে লাগল। পরী অবাক হয়ে বলল, বল না কী বলবি।
বাবা আমার যেখানে বিয়ে ঠিক করেছেন সেটা আমার পছন্দ না ভাবী। ভাইজানকে বুঝিয়ে বলবে তুমি। দোহাই তোমার।
পরী আশ্চর্য হয়ে বলল, পচ্ছন্দ হয় নি কেন রুনু? ছেলেটা তো বেশ ভালোই। কত জায়গা জমি আছে। তার উপর স্কুলে মাস্টারি করে।
করুক। আমার একটুও ভালো লাগে নি। কেমন ফ্যাক-ফ্যাক করে হাসছিল দেখতে এসে। না-না ভাবী, তোমার পায়ে পড়ি।
আচ্ছা-আচ্ছা, পায়ে পড়তে হবে না। আমি বলব।
রুনু খুশি হয়ে বলল, তুমি বড় ভালো মেয়ে ভাবী।
তাই নাকি?
হুঁ। ভাইজান হঠাৎ আসায় তোমার খুব খুশি লাগছে তাই না?
পরী জবাব না দিয়ে মুখ নিচু করে হাসতে লাগল।
বল না ভাবী খুব খুশি লাগছে?
লাগছে।
রুনু ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলল! থেমে বলল, ভাইজানের চাকরিটা বড় বাজে। বৎসরে দশটা দিন ছুটি নেই। গত ঈদে পর্যন্ত আসল না।
পরী কিছু বলল না। চায়ের কাপে চিনি ঢালতে লাগল।
রুনু বলল, এবার তুমি বাসা করে ভাইজানের সঙ্গে থাকো ভাৰী। মেসের খাওয়া খেয়ে তার শরীর কী হাল হয়েছ দেখেছ?
পরী মৃদুস্বরে বলল, দুই জায়গায় খরচ চালানো কি সহজ কথা? অল্প কটা টাকা পায়। চা হয়ে গেছে, নিয়ে যা রে রুনু।
রুনু চা নিয়ে এসে দেখে তার বিয়ে নিয়েই আলাপ হচ্ছে। বাবা বলছেন, ছেলে হল তোমার বি.এ. ফেল। তবে এবার প্রাইভেট দিচ্ছে। বংশটংশ খুবই ভালো। ছেলের এক মামা ময়মনসিংহে ওকালতি করেন। তাঁকে এক ডাকে সবাই চিনে।
আনিসের মা বলেছেন, ছেলে দেখতে-শুনতে খারাপ না—রঙটা একটু মাজা। পুরুষমানুষের ফরসা রঙ কী আর ভালো ভালো না।
আনিস বলল, রুনুর পছন্দ হয়েছে তো? তার পছন্দ হলে আর আপত্তি কী?
পাশের বাড়ি থেকে আনিসের ছোটচাচা এসেছেন খবর পেয়ে। তিনি বললেন, রুনুর আবার পছন্দ-অপছন্দ কী? আমাদের পছন্দ নিয়ে কথা।
আনিস রুনুর দিকে তাকিয়ে হাসল। লজ্জা পেয়ে রুনু চলে এল রান্নাঘরে।
আনিসের বাবা বললেন, কাল বিকালে না হয় ছেলেটাকে খবর দিয়ে আনি। তুই দেখ।
কাল বিকাল পর্যন্ত তো থাকব না বাবা। আজ শেষরাতেই যাব।
সে কী!
ছুটি নিয়ে আসি নি তো। কোম্পানি একটা কাজে পাঠিয়েছিল ময়মনসিংহ। অনেকদিন আপনাদের দেখি নাই। কাজটাও হয়ে গেল সকাল-সকাল। তাই আসলাম।
একটা দিন থাকতে পারিস না?
উঁহু। কাল অফিস ধরতেই হবে। প্রাইভেট কোম্পানি, বড় ঝামেলার চাকরি।
আনিস একটা নিশ্বাস ফেলল। সবাই চুপ করে গেল হঠাৎ। চার মাস পর এসেছে আনিস। আবার কবে আসবে কে জানে। আনিসের মা কাঁপা গলায় বললেন, তোর বড় সাহেবকে একটা টেলিগ্রাম করে দে না।
আনিস হেসে উঠল। গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে বলল, বড়কর্তা যদি কোনোমতে টের পায় আমি বাড়িতে এসে বসে আছি তাহলেই চাকরি নষ্ট হয়ে যাবে। গোসল করব মা, গা কুটকুট করছে।
কুয়োয় করবি? পানি তুলে দেবে?
উঁহু, পুকুরে করব। পুকুরে মাছ আছে রে আজিজ?
আছে ভাইজান। বড়-বড় মৃগেল মাছ আছে।
আনিসের পিছু-পিছু পুকুরপাড়ে সবাই এসে পড়ল। আনিসের বাবা আর মা পাড়ে বসে রইলেন। আজিজ ভীষণ গরম লাগছে এই বলে আনিসের সঙ্গে গোসল করতে নেমে গেল। ঝুনু ঘাটের উপর তোয়ালে আর সাবান নিয়ে অপেক্ষা করছে। আনিসের সবচেয়ে ছোটবোন ঝুনু, ঘুমিয়ে পড়েছিল। আনিস ভোর রাত্রে চলে যাবে শুনে তার ঘুম ভাঙানো হয়েছে। সেও এসে চুপচাপ রুনুর পাশে বসেছে। শুধু পরী আসে নি। দুটি চুলোয় রান্না চাপিয়ে সে আগুনের আঁচে বসে আছে একাকী।
খাওয়াদাওয়া শেষ হতে-হতে অনেক রাত ইল। আনিসকে ঘিরে গোল হয়ে সবাই বসে গল্প করতে লাগল। উঠোনে শীতল পাটিতে বসেছে গল্পের আসর। এর মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে রুনু ঘুমুচ্ছে। চমত্তার চাদনি, সেইসঙ্গে মিষ্টি হাওয়া। কারুর উঠতে ইচ্ছে করছে না। পরীর কাজ শেষ হয় নি। সে বাসনকোসন নিয়ে ধুতে গেছে ঘাটে। এক সময় রুনু বলল, ভাইজান এখন ঘুমোতে যাক মা। রাত শেষ হতে দেরি নেই বেশি। আনিসের বাবা বললেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা রে তুই ঘুমুতে যা। রুনু তুই বউ-মাকে পাঠিয়ে দে। বাসন সকালে ধুলেই হবে।