পাশের ঘরে বইয়ের পাতা ওল্টানোর শব্দ হচ্ছে। এই যে সিগারেট ধরাল। সিগারেটের ধোয়ার গন্ধ ভেসে আসছে। ইজিচেয়ার থেকে উঠল—কঁাচক্যাচ শব্দ হচ্ছে ইজিচেয়ারে।
প্রিয়াংকা স্বামীকে সজোরে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় ডাকল—এই-এই।
ঘুম ভেঙে জাভেদ বলল, কী?
প্রিয়াংকা ফিসফিস করে বলল, না কিছু না। তুমি ঘুমাও।
নন্দিনী
মজিদ বলল, চল্ তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই।
বেশ রাত হয়েছে। চারদিকে ফিনফিনে কুয়াশা। দোকানপাট বন্ধ। হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। পাড়াগাঁর শহরগুলিতে আগেভাগে শীত নামে। মজিদ বলল, পা চালিয়ে চল। শীত কম লাগবে।
কোথায় যাবি?
চল না দেখি। জরুরি কোনো কাজ তো তোর নেই। নাকি আছে?
না নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় রাস্তা ছেড়ে ইট বিছানো সরু রাস্তায় এসে পড়লাম। শহর অনেক বদলে গেছে। আগে এখানে ডালের কারবারিরা বসত। এখন জায়গাটা ফাঁকা। পিছনেই ছিল কার্তিকের মডার্ন সেলুন। সেখানে দেখি একটা চায়ের স্টল। শীতে গুটিশুটি মেরে লোকজন চা খাচ্ছে। আমি বললাম, এক দফা চা খেয়ে নিবি নাকি মজিদ
উহুঁ, দেরি হয়ে যাবে।
শহরটা বদলে গেছে একেবারে। মহারাজের চপের দোকানটা এখনো আছে?
আছে।
হাঁটতে-হাঁটতে ধর্মতলা পর্যন্ত চলে এলাম। ধর্মতলার গা ঘেঁষে গিয়েছে হাড়িখাল নদী। আমি আর মজিদ গোপনে সিগারেট টানবার জন্যে কতবার হাড়িখালের পাড়ে এসে বসেছি। কিন্তু এখন নদীটদী কিছু চোখে পড়ছে না।
নদীটা কোথায় রে মজিদ? হাড়িখাল এইদিকেই ছিল না?
ঐ তো নদী। সাবধানে আয়।
একটা নর্দমার মতো আছে এখানে। পা পিছলে পড়েই গিয়েছিলাম। সামলে উঠে দেখি নদী দেখা যাচ্ছে। আমরা নদীর বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। সরু ফিতের মতো নদী অন্ধকারেও চিকমিক করছে। আগে এখানে এরকম উঁচু বাঁধ ছিল না। নদীর ঢালু পাড়ে সরষের চাষ হত। মজিদ চুপচাপ হাঁটছিল।
আমি বললাম, আর দূর কত?
ঐ দেখা যাচ্ছে।
কার বাড়ি?
আয় মা চুপচাপ। খুব সারপ্রাইজড হবি।
একটি পুরনো ভাঙা দালানের সামনে দুজন থমকে দাঁড়ালাম। বাড়ির চারপাশ ঝোপঝাড়ে অন্ধকার হয়ে আছে। সামনের অপরিচ্ছন্ন উঠোনে চার-পাঁচটা বড়-বড় কাগজি লেবুর গাছ। লেবুর গন্ধের সঙ্গে খড়-পোড়ানো গন্ধ এসে মিশেছে। অসংখ্য মশার পিনপিনে আওয়াজ। মজিদ খটখট করে কড়া নাড়তে লাগল। ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় কেউ একজন বলল, কে?
মজিদ আরো জোরে কড়া নাড়তে লাগল। হারিকেন হাতে একটি লম্বা নোগামতো শ্যামলা মেয়ে দরজা খুলে দিল। মজিদ বলল, কাকে নিয়ে এসেছি দেখ।
আমি কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। মেয়েটি হাসিমুখে বলল, আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন তো? আমি নন্দিনী।
আমি মাথা নাড়লাম।
আপনি কবে দেশে ফিরেছেন?
দু-মাস হবে। এতদিন ঢাকায় ছিলাম। এখানে এসেছি গতকাল।
মজিদ বিরক্ত হয়ে বলল, ভিতরে আয় না। ভিতরে এসে বস্।
ঘরের ভিতরটা বেশ গরম। একটি টেবিলে কাচের ফুলদানিতে গন্ধরাজ ফুল সাজানো। চৌকিতে ধবধবে শাদা চাদর বিছানো। ঘরের অন্য প্রান্তে প্রকাণ্ড একটা ইজিচেয়ার। মজিদ গা এলিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়ল। হালকা গলায় বলল, চিনি এনেছি। একটু চা বানাও।
নন্দিনী হারিকেন দুলিয়ে চলে গেল। আমরা দুজন অন্ধকারে বসে রইলাম। মজিদ ফস করে বলল, সারপ্রাইজড় হয়েছিস নাকি?
হুঁ।
কেমন দেখলি নন্দিনীকে?
ভালো।
শুধু ভালোং ইজ নট শী ওয়ান্ডারফুল?
আমি সে কথার জবাব না দিয়ে বললাম, এই বাড়িতে আর কে থাকে?
সবাই থাকে।
সবাই মানে?
মজিদ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুই একবার নন্দিনীকে প্রেমপত্র লিখেছিলি না? অনেক কবিতাটবিতা ছিল সেখানে। তাই না?
আমি শুকনো গলায় বললাম, বাদ দে ওসব পুরানো কথা।
মজিদ টেনে-টেনে হাসতে লাগল।
পরের দশ মিনিট দুজনেই চুপ করে রইলাম। মজিদ একটির পর একটি সিগারেট টানতে লাগল। মাঝে-মাঝে হাসতে লাগল আপন মনে।
অনেকক্ষণ আপনাদের অন্ধকারে বসিয়ে রাখলাম। ঘরে একটা মোটে হারিকেন। কী যে করি!
নন্দিনী চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল।
চিনি হয়েছে চায়ে?
কাপে চুমুক দিয়ে মজিদ বিষম খেয়ে কাশতে লাগল। আমি বললাম, অাপনাদের এদিকে খুব হওয়া তো।
হুঁ নদীর উপরে বাড়ি। হাওয়ার জন্যে কুপি জ্বালানোই মুশকিল।
ভেতর থেকে কে একজন ডাকল, বউ ও বউ।
নন্দিনী নিঃশব্দে উঠে গেল। আমি বললাম, তুই প্রায়ই আসিস এখানে?
আসি।
ব্যাপার কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
আমি চুপ করে রইলাম। মজিদ বলল, রাত হয়ে যাচ্ছে, এইবার ফিরব। নন্দিনীকে কেমন দেখলি বল্ না শুনি।
ভালো। আগের মতোই, একটুও বদলায় নি।
নন্দিনী আমাদের ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ততক্ষণে চাঁদ উঠে গেছে। স্নান জোছনায় চারদিক কেমন ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। মজিদ বলল, যাই নন্দিনী।
নন্দিনী কিছু বলল না। হারিকেন উঁচু করে বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে রইল। আমরা ধর্মতলা পর্যন্ত নিঃশব্দে হাঁটলাম। একসময় মজিদ বলল, কলেজের ফেয়ারওয়েলে নন্দিনী কোন্ গানটা গেয়েছিল মনে আছে?
না মনে নেই।
আমার আছে।
মজিদ গুনগুন করে একটা গানের সুর ভাজতে থাকল। হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, জানিস, নন্দিনীকে আমিই এ বাড়িতে এনে তুলেছিলাম।
তাই নাকি?
ওর বাবাকে তখন মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে।
সুরেশ্বর বাবুকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছিল নাকি?
মারবে না তো কী করবে? তুই কী যে কথা বলিস। মেরে তো সাফ করে ফেলেছে এদিকে।
আমি বললাম, সুরেশ্বর বাবু একটা গাধা ছিলেন। কত বললাম— মিলিটারি আসবার আগেই পালান। না পালাবেন না, একটামাত্র মেয়ে সঙ্গে নিয়ে হুস করে চলে যাবে, তা না ….।