ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
আমার হাইপোথিসিসের জন্যে আপনার লেফট হ্যানডেড পার্সন হওয়া খুবই প্রয়োজন।
কেন?
বলছি। তার আগে—শুরুতে যা বলছিলাম সেখানে ফিরে যাই। দৃশ্যটি আপনি দয়া করে কল্পনা করুন। আপনি একধরনের টেন্স অবস্থায় আছেন। আপনার স্ত্রী জেগে আছেন-ভীত চোখে আপনাকে দেখছেন। আপনার এই অবস্থার সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই। তিনি ভয়ে অস্থির হয়ে গেলেন। তাঁর ধারণা হল আপনি মারা গেছেন। তিনি আপনার গায়ে হাত দিয়ে আরো ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ আপনার গা হিমশীতল।।
গা হিমশীতল হবে কেন?
মানুষ যখন গভীর ট্রেন্স স্টেটে চলে যায় তখন তার হার্টবিট কমে যায়। নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস ধীরে বয়। শরীরের টেম্পরেচার দুই থেকে তিন ডিগ্ৰী পৰ্যন্ত নেমে যায়। এইটুকু নেমে যাওয়া মানে অনেকখানি নেমে যাওয়া। যাই হোক, আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি তাকালেন।–তাকালেন। কিন্তু এক চোখ মেলে। বী চোখে। ডান চোখটি তখনো বন্ধ।
কেন?
ব্যাখ্যা করছি। রাইট হ্যানডেড পার্সন যারা আছে, তাদের এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে তাকাতে বললে তারা বা চোখ বন্ধ করে ডান চোখে তাকবে। ডান চোখ বন্ধ করে বা চোখে তাকানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা সম্ভব শুধু যারা ন্যাটা তাদের পক্ষেই। আপনি লেফট হ্যানডেড পার্সনা-আপনি একধরনের গভীর টেন্স ষ্টেটে আছেন। আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত রেখেছেন। আপনি কী হচ্ছে জানতে চাচ্ছেন। চোখ মেলছেন। দুটি চোখ মেলতে চাচ্ছেন না। গভীর আলস্যে একটা চোখ কোনোমতে মেললেন-অবশ্যই সেই চোখ হবে-বী চোখ। আমার যুক্তি কি গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে?
রাশেদুল করিম হা-না কিছু বললেন না।
মিসির আলি বললেন, আপনার স্ত্রী আরো ভয় পেলেন। সেই ভয় তাঁর রক্তে মিশে গেল। কারণ শুধুমাত্র একবার এই ব্যাপার ঘটেনি। অনেকবার ঘটেছে। আপনার কথা থেকেই আমি জেনেছি, সেই সময় অঙ্কের একটি জটিল সমাধান নিয়ে আপনি ব্যস্ত। মুড়ার সমগ্ৰ চিন্তা-চেতনায়য় আছে–অঙ্কের সমাধান-নতুন কোনো থিওরি। নয় কি?
হ্যাঁ।
এখন আমি আমার হাইপোথিসিসের সবচেয়ে জটিল অংশে আসছি। আমার হাইপোথিসিস বলে, আপনার স্ত্রী আপনার চোখ গেলে দেন নি। তাঁর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তিনি আপনার চোখের প্রেমে পড়েছিলেন। একজন শিল্পীমানুষ কখনো সুন্দর কোনো সৃষ্টি নষ্ট করতে পারেন না। তবুও যদি ধরে নিই তাঁর মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠে গিয়েছিল এবং তিনি এই ভয়াবহ কাণ্ড করেছেন—তাহলে তাঁকে এটা করতে হবে ঝোঁকের মাথায়, আচমকা। আপনার চোখ গেলে দেওয়া হয়েছে পেনসিলে-যে পেনসিলটি আপনার মাথার বালিশের নিচে রাখা। যিনি ঝোঁকের মাথায় একটা কাজ করবেন। তিনি এত যন্ত্রণা করে বালিশের নিচে থেকে পেনসিল নেবেন না। হয়তো-বা তিনি জানতেনও না বালিশের নিচে পেনসিল ও নোটবই নিয়ে আপনি ঘুমান!
রাশেদুল করিম বললেন, কাজটি তাহলে কে করেছে?
সেই প্রসঙ্গে আসছি—আপনি কি আরেক কাপ চা খবেন। বানিয়ে দেব?
না।
অ্যাকসিডেন্ট কীভাবে ঘটল তা বলার আগে আপনার স্ত্রীর লেখা ডায়েরির প্রতি আপুনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি—এক জায়গায় তিনি লিখেছেন-আপনার বা চোখ দিয়ে পানি পড়ত। কথাটা কি সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
কোন পানি পড়ত? একটি চোখ কেন কাঁদত? আপনার কী ধারণা?
করিম বললেন, আমার কোনো ধারণা নেই। আপনার ধারণা বলুন। আমি অবশ্যি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ডাক্তার বলেছেন এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। যে-ফ্ল্যাণ্ড চোখের জল নিয়ন্ত্রণ করে, সেই গ্ল্যাণ্ড বা চোখে বেশি কর্মক্ষম ছিল।
মিসির আলি বললেন, এটা একটা মজার ব্যাপার! হঠাৎ কেন বঁ। চোখের গ্ল্যাণ্ড কর্মক্ষম হয়ে পড়ল। আপনি মনে-মনে এই চোখকে আপনার সব রকম অশান্তির মূল বলে চিহ্নিত করার জন্যেই কি এটা হল? আমি ডাক্তার নই। শারীরবিদ্যা জানি না। তবে আমি দু জন বড় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন এটা হতে পারে। মোটেই অস্বাভাবিক নয়। গু্যাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। একটি চোখকে অপছন্দও করছে মস্তিষ্ক।
তাতে কী প্রমাণ হচ্ছে?
মিসির আলি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, তাতে একটি জিনিসই প্রমাণিত হচ্ছে-আপনার বা চোখ আপনি নিজেই নষ্ট করেছেন।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে রাশেদুল করিম ভাঙা গলায় বললেন, কী বলছেন আপনি?
কনশ্যাস অবস্থায় আপনি এই ভয়ংকর কাজ করেন নি। করেছেন। সাবকনশ্যাস অবস্থায়। কেন করেছেন তাও বলি—আপনি আপনার স্ত্রীকে অসম্ভব ভালবাসেন। সেই স্ত্রী আপনার কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। কেন দূরে সরে যাচ্ছেন? কারণ তিনি ভয় পাচ্ছেন। আপনার বা চোখকে। আপনি আপনার স্ত্রীকে হারাচ্ছেন বা চোখের জন্যে। আপনার ভেতর রাগ, অতিমান জমতে শুরু করেছে। সেই রাগ আপনার নিজের একটি প্রত্যঙ্গের ওপর। চোখের ওপর। এই রাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচণ্ড হতাশা। আপনি যে— বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সেই গবেষণা অন্য একজন করে ফেলেছেন। জার্নালে তা প্রকাশিত হয়ে গেছে। আপনার চোখ সমস্যা তৈরি না-করলে এমনটা ঘটত না। নিজেই গবেষণাটা শেষ করতে পারতেন। সবকিছুর জন্যে দায়ী হল চোখ।
মিসির আলি আরেকটি সিগারেট ধরাতে-ধরাতে বললেন, আমার এই হাইপোথিসিসের পেছনে আরেকটি শক্ত যুক্তি আছে। যুক্তিটি বলেই আমি কথা শেষ করব।