আমি কী হই?
তুমি পিশাচ বা এই জাতীয় কিছু হয়ে যাও।
আমি বললাম, এইভাবে তো বাস করা সম্ভব নয়। তুমি বরং আলাদা থাক। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার-জুডি তাতে রাজি হল না। অতি তুচ্ছ কারণে আমেরিকানদের বিয়ে ভাঙে। স্বামীর পছন্দ হলুদ রঙের বিছানার চাদর স্ত্রীর পছন্দ নীল রঙ। ভেঙে গেল বিয়ে। আমাদের এত বড় সমস্যা, কিন্তু বিয়ে ভাঙল না। আমি বেশ কয়েক বার তাকে বললাম, জুডি, তুমি আলাদা হয়ে যাও! ভালো দেখে একটা ছেলেকে বিয়ে করা। সারা জীবন তোমার সামনে পড়ে আছে। তুমি এইভাবে জীবনটা নষ্ট করতে পার না।
জুডি প্রতিবারই বলে, যাই হোক, যত সমস্যাই হোক, আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না, I love you. I love you.
……আমি গল্পের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। শেষ অংশটি বলার অ্যাগে আমি আপনাকে আমার চোখের দিকে তাকাতে অনুরোধ করব। দয়া করে আমার চোখের দিকে তাকান।
রাশেদুল করিম সানগ্লাস খুলে ফেললেন। মিসির আলি তৎক্ষণাৎ বললেন, আপনার চোখ সুন্দর। সত্যি সুন্দর। আপনার মা যে বলতেন চোখে জন্মকাজল, ঠিকই বলতেন।
রাশেদুল করিম বললেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ কার ছিল জানেন?
ক্লিওপেট্রার?
অধিকাংশ মানুষের তাই ধারণা। এ-ধারণা সত্যি নয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ ছিল বুদ্ধদেবের পুত্ৰ কুনালের। ইংরেজ কবি শেলির চোখও খুব সুন্দর ছিল। আমার স্ত্রীর ধারণা, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে চোখ আমার। জুডি বলত—এই চোখের কারণেই সে কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।
রাশেদুল করিম সানগ্লাস চোখে দিয়ে বললেন, গল্পের শেষ অংশ বলার আগে আপনাকে ক্ষুদ্র ধন্যবাদ দিতে চাচ্ছি।
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কী জন্যে বলুন তো? কাউকে যখন আমি আমার চোখের দিকে তাকাতে বলি, সে আমার পাথরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আপনি প্রথম ব্যক্তি-যিনি একবারও আমার পাথরের চোখের দিকে তাকান নি। আমার আসল চোখের দিকে তাকিয়ে-ছিলেন। Sonice of you, Sir.
রাশেদুল করিমের গলা মুহূর্তের জন্যে হলেও ভারি হয়ে গেল। তিনি অবশ্যি চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, আটটা প্ৰায় বাজতে চলল, গল্পের শেষটা। বলি-জুডার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগল। কড়া ডোজের ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমুতে যায়, দু-এক ঘন্টা ঘুম হয়, বাকি রাত জেগে বসে থাকে। মাঝে-মাঝে চিৎকার করে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদে।…..
এমনি একরাতের ঘটনা। জুলাই মাস। রাত সাড়ে তিনটার মতো হবে। জুডির মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল-সে আমার বা চোখটা গেলে দিল।…
আমি ঘুমুচ্ছিলাম, নারকীয় যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। সেই ভয়াবহ কষ্টের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
রাশেদুল করিম চুপ করলেন। তাঁর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমতে লাগল।
মিসির আলি বললেন, কী দিয়ে চোখ গেলে দিলেন?
সুঁচালো পেনসিল দিয়ে। আমার মাথার বালিশের নিচে প্যাড এবং পেনসিল থাকে। তখন গ্রুপ থিওরি নিয়ে গভীর চিন্তায় ছিলাম। মাথায় যদি হঠাৎ কিছু আসে তা লিখে ফেলার জন্যে বালিশের নিচে প্যাড় এবং পেনসিল রাখতাম।
আপনার স্ত্রী ঘটনা প্রসঙ্গে কী বক্তব্য দিয়েছেন?
তার মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সে কিছুই বলে নি। শুধু চিৎকার করেছে। তার একটিই বক্তব্য-এই লোকটা পিশাচ। আমি প্রমাণ পেয়েছি। কেউ বিশ্বাস করবে: না। কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ আছে।
কী প্রমাণ আছে তা কি কখনো জিজ্ঞেস করা হয়েছে?
না। একজন উন্মাদকে প্রশ্ন করে বিপর্যস্ত করার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া আমি তখন ছিলাম হাসপাতালে। আমি হাসপাতালে থাকতে—থাকতেই জুডির মৃত্যু হয়।
স্বাভাবিক মৃত্যু?
না। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। সে মারা যায় ঘুমের অষুধ খেয়ে। এইটুকুই আমার গল্প। আমি আপনার কাছে একটাই অনুরোধ নিয়ে এসেছি, আপনি সমস্যাটা কী, বের করবেন। আমাকে সাহায্য করবেন। আমি যদি পিশাচ হই, তাও আমাকে বলবেন। এই ফাইলের ভেতর জুডির একটা স্কেচবুক আছে। স্কেচবুকে নানান ধরনের কমেন্টস লেখা আছে। এই কমেন্টসগুলি পড়লে জুডির মানসিক অবস্থা আঁচ করতে আপনার সুবিধা হতে পারে! আটটা বাজে, আমি তাহলে উঠি?
আবার কবে আসবেন?
আগামীকাল ভোর ছটায়। ভালো কথা, আমার এই গল্পে কোথাও কি প্ৰকাশ পেয়েছে, জুডিকে আমি কতটা ভালবাসতাম?
না, প্ৰকাশ পায় নি।
জুডির প্রতি আমার ভালবাসা ছিল সীমাহীন।
আমি এখন উঠছি।।
ছিল বলছেন কেন? এখন কি নেই?
ভদ্রলোক জবাব দিলেন না। রাশেদুল করিম চলে যাবার পর মিসির আলি ফাইল খুললেন। ফাইলের শুরুতেই একটা খাম। খামের ওপর মিসির আলির নাম লেখা।
মিসির আলি খাম খুললেন। খামের ভেতর ইংরেজিতে একটা চিঠি লেখা। সঙ্গে চারটি এক শ ডলারের নোট। চিঠি খুবই সংক্ষিপ্ত।
প্রিয় মহোদয়, আপনার সার্ভিসের জন্যে সন্মানী বাবদ সামান্য কিছু দেওয়া হল। গ্ৰহণ করলে
খুশি হব।
বিনীত
আর, করিম।
০২.
মিসির আলি স্কেচবুকের প্রতিটি পাতা সাবধানে ওন্টালেন। চারকেল এবং পেনসিলে স্কেচ আঁকা। প্রতিটি স্কেচের নিচে আঁকার তারিখ। স্কেচের বিষয়বস্তু অতি তুচ্ছ, সবই ঘরোয়া জিনিস-এক জোড়া জুতো, মলাট-ছোড়া বই, টিভি, বুকশেলফ। স্কেচ বুকের শেষের দিকে শুধুই চোখের ছবি। বিড়ালের চোখ, কুকুরের চোখ, মাছের চোখ এবং মানুষের চোখ। মানুষের চোখের মডেল যে রাশেদুল করিম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। না বললেও ছবির নিচের মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে মন্তব্যগুলি বেশ দীর্ঘ। যেমন একটি মন্তব্য :