অনেক ধাক্কাধাব্ধির পর সে দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে আমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, কী হয়েছে?
সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ভয় পেয়েছি।
কিসের ভয়?
জানি না কিসের ভয়।
ভয় পেয়েছ তো আমাকে ডেকে তোল নি কেন? বাথরুমে দরজা বন্ধ করে ছিলে কেন?
জুড়ি জবাব দিল না। একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, ব্যাপারটা কি আমাকে খুলে বল তো?
সকালে বলব।।না, এখুনি বল। কী দেখে ভয় পেয়েছ?
জুডি অস্পষ্ট স্বরে বলল, তোমাকে দেখে।
আমাকে দেখে ভয় পেয়েছ মানে? আমি কী করেছি?
জুডি যা বলল তা হচ্ছে–রাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। হোটেলের ঘরে নাইট লাইট জ্বলছিল, ওই আলোয় সে দেখে, তার পাশে যে শুয়ে আছে সে কোনো জীবন্ত মানুষ নয়, মৃত মানুষ–যে-মৃত মানুষের গা থেকে শবদেহের গন্ধ বেরুচ্ছে। সে তয়ে কাঁপতে থাকে, তবু সাহসে হাত বাড়িয়ে মানুষটাকে স্পর্শ করে। স্পর্শ করেই চমকে ওঠে, কারণ মানুষটার শরীর বরফের মতোই শীতল। সে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যায় যে আমি মারা গেছি। তার জন্যে এটা বড় ধরনের শক হলেও সে যথেষ্ট সাহস দেখায়-টেবিল-ল্যাম্প জ্বেলে দেয় এবং হোটেল ম্যানেজারকে টেলিফোন করবার জন্যে টেলিফোন সেট হাতে তুলে নেয়। ঠিক তখন সে লক্ষ করে, মৃতদেহের দুটি বন্ধ চোখের একটি ধীরে-বীরে খুলছে। সেই একটিমাত্র খোলা চোখ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জুডি টেলিফোন ফেলে দিয়ে ছুটে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। এই হল ঘটনা।
রাশেদুল করিম কথা শেষ করে সিগারেট ধরলেন। হাতের ঘড়ি দেখলেন। মিসির আলি বললেন, থামলেন কেন?
সাতটা বেজেছে। আপনি বলেছেন, সাতটার সময় আপনার জন্যে চা আসে। আমি চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। চা খেয়ে শুরু করব। আমার গল্প শুনতে আপনার কেমন লাগছে?
ইন্টারেষ্টিং। এই গল্প কি আপনি অনেকের সঙ্গে করেছেন? আপনার গল্প বলার ধরন থেকে মনে হচ্ছে অনেকের সঙ্গেই এই গল্প করেছেন।
আপনার অনুমান সঠিক। ছ থেকে সাত জনকে আমি বলেছি। এর মধ্যে সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন। পুলিশের লোক আছে।
পুলিশের লোক কেন?
গল্প শেষ করলেই বুঝতে পারবেন পুলিশের লোক কী জন্যে।
চা চলে এল! চায়ের সঙ্গে পরোটা-ভাজি। মিসির আলি নাশতা করলেন। রাশেদুল করিম সাহেব পরপর দু কাপ চা খেলেন।
আমি কি শুরু করব?
জ্বি, শুরু করুন।
আমাদের হানিমুন মাত্র তিন দিন স্থায়ী হল। জুডিকে নিয়ে পুরনো জায়গায় চলে এলাম। মনটা খুবই খারাপ। জুডির কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না। রোজ রাতে সে ভয়ংকর চিৎকার করে ওঠে। ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আমি যখন জেগে উঠে তাকে সন্তুনা দিতে যাই, তখন এমনভাবে তাকায়, যেন আমি একটা পিশাচ কিংবা মূর্তিমান শয়তান। আমার দুঃখের কোনো সীমা রইল না। সেই সময় নন এবেলিয়ান গ্রুপের ওপর একটা জটিল এবং গুরুত্বপূৰ্ণ কাজ করছিলাম। আমার দরকার ঠাণ্ডামাথায় চিন্তা করার মতো পরিবেশ, মানসিক শান্তি। সব দূর হয়ে গেল। অবশ্য দিনের বেলায় জুডি স্বাভাবিক। সে বদলাতে শুরু করে সূর্য ডোবার পর থেকে। আমি তাকে একজন সাইকিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গেলাম।
সাইকিয়াটিস্ট প্রথমে সন্দেহ করলেন সমস্যা ড্রাগঘটিত। হয়তো জুডি ড্রাগে অভ্যস্ত! সেই সময় বাজারে হেলুসিনেটিং ড্রাগ এল.এস.ডি. প্রথম এসেছে। শিল্পসাহিত্যের লোকজন শখ করে এই ড্রাগ খাচ্ছেন। বড়গলায় বলছেন–মাইন্ড অলটারিং ট্রিপ নিয়ে এসেছি। জুডি ফাইন আর্টস-এর ছাত্রী। ট্রিপ নেওয়া তার পক্ষে খুব অস্বাভাবিক নয়।
দেখা গেল, ড্রাগঘটিত কোনো সমস্যা তার নেই। সে কখনো ড্রাগ নেয় নি। সাইকিয়াট্রিস্টরা তার শৈশবের জীবনে কোনো সমস্যা ছিল কি না তাও বের করতে চেষ্টা করলেন। লাভ হল না। জুডি এসেছে গ্রামের পরিবার থেকে। এ-ধরনের পরিবারে তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। তাদের সহজ এবং স্বাভাবিক।
সাইকিয়াটিস্ট জুডিকে ঘুমের অষুধ দিলেন। কড়া ডোজের ফেনোবাৰ্বিটন! আমাকে বললেন, আপনি সম্ভবত লেখাপড়া নিয়ে থাকেন। স্ত্রীর প্রতি, বিশেষ করে নববিবাহিত স্ত্রীর প্রতি যতটা সময় দেওয়া দরকার তা দিচ্ছেন না। আপনার প্রতি আপনার স্ত্রীর একধরনের ক্ষোভ জন্মেছে। সে যা বলছে, তা ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।
জুডির কথা একটাই-আমি ঘুমুবার পর আমার দেহে প্ৰাণ থাকে না। একজন মৃত মানুষের শরীর যেমন অসাড় পড়ে থাকে, আমার শরীরও সে-রকম পড়ে থাকে। ঘুমের মধ্যে মানুষ হাত নাড়ে, পা নাড়ে- আমি তার কিছুই করি না। নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফুেলি না। গা হয়ে যায় বরফের মতো শীতল। একসময় গা থেকে মৃত মানুষের শরীরের পচা গন্ধ বেরুতে থাকে এবং তখন আচমকা আমার বা চোখ খুলে যায়, সেই চোখে আমি একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই চোখের দৃষ্টি সাপের মতো কুটিল।
জুডির কথা শুনে—শুনে আমার ধারণা হল, হতেও তো পারে। জগতে কত রহস্যময় ব্যাপারই তো ঘটে। হয়তো আমার নিজেরই কোনো সমস্যা আছে। আমিও ডাক্তারের কাছে গেলাম। ক্লিপ অ্যানলিস্ট। জানার উদ্দেশ্য একটিই-ঘূমের মধ্যে আমার কোনো শারীরিক পরিবর্তন হয় কি না! ডাক্তাররা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করলেন। একবার নয়, বারবার করলেন। দেখা গেল আমার ঘুম আর দশটা মানুষের ঘুমের চেয়ে আলাদা নয়। ঘুমের মধ্যে আমিও হাত-পা নাড়ি। অন্য মানুষদের যেমন ঘুমের তিনটি স্তর পার হতে হয়, আমারও হয়। ঘুমের সময় আর দশটা মানুষের মতো আমার শরীরের উত্তাপও আধ ডিগ্ৰী হ্রাস পায়। আমিও অন্য সবার মতো স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন দেখি! জুডি সব দেখেশুনে বলল, ডাক্তাররা জানে না। ডাক্তাররা কিছুই জানে না। আমি জানি। তুমি আসলে মানুষ না দিনের বেলা তুমি মানুষ থাক—সূৰ্য ডোবার পর থাক না।