মিসির আলি রিকশাওয়ালার কথাবার্তায় চমৎকৃত হলেন। পরবর্তী দশ মিনিট তিনি রিকশাওয়ালাকে যা বললেন, তার মূল কথা হল–নারীর কারণে আমরা যদি স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে থাকি তাহলে নারীই পারে আবার আমাদের স্বর্গে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
রিকশাওয়ালা কী বুঝল কে জানে। তার শেষ বক্তব্য ছিল, যাই কন চাচামিয়া, মেয়েমানুষ আসলে সুবিধার জিনিস না।
কলিং বেল আবার বাজছে।
মিসির আলি বেল টেপার ধরন থেকে অনুমান করতে চেষ্টা করলেন-কে হতে পারে।
ভিখিরি হবে না। ভিখিরিরা এত ভোরে বের হয় না। ভিক্ষাবৃত্তি যাদের পেশা তারা পরিশ্রান্ত হয়ে গভীর রাতে ঘুমুতে যায়, ঘুম ভাঙতে সেই কারণেই দেরি হয়। পরিচিত কেউ হবে না। পরিচিতরা এত ভোরে আসবে না। তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে পারে এমন ঘনিষ্ঠতা তাঁর কারো সঙ্গেই নেই।
যে এসেছে, সে অপরিচিত। অবশ্যই মহিলা। পুরুষরা কলিং বেলের বোতাম অনেকক্ষণ চেপে ধরে থাকে। মেয়েরা তা পারে না। মেয়েটির বয়স অল্প তাও অনুমান করা যাচ্ছে। অল্পবয়স্ক মেয়েদের মধ্যে এক ধরনের ছটফটে ভাব থাকে। তারা অল্পসময়ের মধ্যে কয়েক বার বেল টিপবে। নিজেদের অস্থিরতা ছড়িয়ে দেবে কলিং বেলে।
মিসির আলি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে দরজা খুললেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, তাঁর অনুমান সম্পূর্ণ ভূল প্রমাণ করে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। বেঁটেখাটো একজন মানুষ। গায়ে সাফারি। চোখে সানগ্লাস। এত ভোরে কেউ সানগ্লাস পরে না। এই লোকটি কোন পরেছে কে জানে!
স্যার, স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনার নাম কি মিসির আলি?
জ্বি।
আমি কি আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারি?
মিসির আলি কী বলবেন মনস্থির করতে পারলেন না। লোকটিকে তিনি পছন্দ করছেন না, তবে তার মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস লক্ষ করছেন-যা তাঁর ভালো লাগছে। আত্মবিশ্বাসের ব্যাপারটা আজকাল আর দেখাই যায় না।
লোকটি শান্ত গলায় বলল, আমি আপনার কিছুটা সময় নষ্ট করব ঠিকই।–তবে তার জন্যে আমি পে করব।
পে করবেন?
জ্বি। প্রতি ঘন্টায় আমি আপনাকে এক হাজার করে টাকা দেব। আশা করি আপনি আপত্তি করবেন না। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
আসুন।
লোকটি ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতে বলল, মনে হচ্ছে আপনার এখনো হাত-মুখ ধোয়া হয় নি। আপনি হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, আমি অপেক্ষা করছি।
মিসির আলি বললেন, ঘন্টা হিসেবে আপনি যে আমাকে টাকা দেবেন—সেই হিসেবে কি এখন থেকে শুরু হবে? নাকি হাত-মুখ ধুয়ে আপনার সামনে বসার পর থেকে শুরু হবে?
লোকটি খানিকটা অপ্ৰস্তুত হয়ে বলল, টাকার কথায় আপনি কি রাগ করেছেন?
রাগ করি নি, মজা পেয়েছি। চা খাবেন?
খেতে পারি। দুধ ছাড়া।
মিসির আলি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, এক কাজ করুন।–রান্নাঘরে চলে যান। কেতলি বসিয়ে দিন। দু কাপ বানান। আমাকেও এক কাপ দেবেন।
ভদ্ৰলোক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, আমাকে ঘন্টা হিসেবে পে করবেন বলে যেভাবে হকচাকিয়ে দিয়েছিলেন, আমিও ঠিক একইভাবে আপনাকে হকচাকিয়ে দিলাম। বসুন, চা বানাতে হবে না। সাতটার সময় রাস্তার ওপাশের রেস্টুরেন্ট থেকে আমার জন্যে চা-নাশতা আসে। তখন আপনার জন্যেও চা আনিয়ে দেব।
থ্যাংক ইউ স্যার।
আপনি কথা বলার সময় বারবার বা দিকে ঘুরছেন, আমার মনে হচ্ছে আপনার বী চোখটা নষ্ট। এই জন্যেই কি কালো চশমা পরে আছেন?
ভদ্রলোক সহজ গলায় বললেন, জ্বি। আমার বা চোখটা পাথরের।
ভদ্রলোক সোফার এক কোণে বসলেন। মিসির আলি লক্ষ করলেন, লোকটি শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছে। চাকরির ইন্টারভ্যু দিতে এলে ক্যান্ডিডেটরা যে-ভঙ্গিতে চেয়াতে বসে অবিকল সেই ভঙ্গি। মিসির আলি বললেন, আজকের খবরের কাগজ এখনো আসে নি। গত দিনের কাগজ দিতে পুরি? যদি আপনি চোখ বোলাতে চান।
আমি খবরের কাগজ পড়ি না। এক-একা বসে থেকে আমার অভ্যাস আছে। আমার জন্যে আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। শুরুতে টাকা দেওয়ার কথা বলে যদি আপনাকে আহত করে থাকি, তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
মিসির আলি টুথব্রাশ হাতে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। লোকটিকে তাঁর বেশ ইস্টারেষ্টিং বলে মনে হচ্ছে। তবে কোনো গুরুতর সমস্যা নিয়ে এসেছে বলে মনে হয়। না। আজকাল অকারণেই কিছু লোকজন এসে তাঁকে বিরক্ত করা শুরু করেছে। মাসখানেক আগে একজন এসেছিল ভূতবিশারদ। সে নাকি গবেষণাধর্মী একটি বই লিখছে—যার নাম বাংলার ভুত। এ-দেশে যত ধরনের ভূত-পেত্নী আছে সবুর নাম, আচার-ব্যবহার বইয়ে লেখা। মেছো ভূত, গেছে ভূত, জলা ভূত, শাকচুন্নি, স্কন্ধকাটা, কুনী ভূত, কুত্তি ভূত, আঁধি ভূত সর্বমোট এক শ ছ রকমের ভূত।
মিসির আলি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ভাই, আমার কাছে কেন? আমি সারা জীবন ভূত নেই এটাই প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি।
সেই লোক মহা উৎসাহী হয়ে বলল, কোন কোন ভূত নেই বলে প্রমাণ করেছেন—এটা কাইন্ডলি বলুন। আমার কাছে ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। আমি টেপ করে নেব।
সানগ্লাস-পরা বেঁটে ভদ্রলোক সেই পদের কেউ কি না কে বলবে?
তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে-মুছতে মিসির আলি বললেন, ভাই, বলুন কী ব্যাপার।
প্রথমেই আমার নাম বলি-এখনো আমি আপনাকে আমার নাম বলি নি। আমার নাম রাশেদুল করিম। আমেরিকার টেক্সাস এম অ্যান্ড এন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের আমি একজন অধ্যাপক। বর্তমানে এক বছরের স্যাঘাটিক্যাল লীভে দেশে এসেছি। আপনার খোঁজ কীভাবে এবং কার কাছে পেয়েছি তা কি বলব?