বৎসরের অন্য দিনগুলি আজকের মতো হয় না কেন?—-ভাবতে-ভাবতে আমি সিগারেট ধরালাম। হিটার জ্বালিয়ে চায়ের কেতলি বসিয়ে দিলাম। সমস্ত ব্যাপারটা ঘটল নিঃশব্দে। তবু বাকের সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি জড়ানো গলায় বললেন, চা হচ্ছে নাকি?
হ্যাঁ।
আজ এত ভোরে উঠলেন যে, ব্যাপার কী? শরীর খারাপ নাকি?
জি না। চা খাবেন বাকের সাহেব?
দেন এক কাপ।
এই বলেই মাথা বের করে তিনি নাক ঝাড়লেন। নাক মুছলেন মশারিতে— কী কুৎসিত ছবি। আজ চমৎকার সব ছবি দেখতে ইচ্ছা করছে। আমি প্রাণপণে ভাবতে চেষ্টা করলাম বাকের সাহেব নামে এ ঘরে কেউ থাকে না এবং এটা যেনতেন ঘরও নয়। এটাই হচ্ছে মহিমগড়ের রাজবাড়ি এবং আমি এসেছি মহিমগড়ের রাজকন্যার অতিথি হয়ে। আর আমিও কোনো হেজিপেজি লোক নই। আমি একজন কবি। আজ সন্ধ্যায় মহিমগড়ের রাজকন্যাকে আমি কবিতা শোনাব।
মঞ্জু সাহেব।
জি বলুন।
এরকম লাগছে কেন আপনাকে কিছু হয়েছে নাকি?
না, কী হবে?
দেখি, একটা সিগারেট দেন দেখি।
বাকের সাহেব তাঁর সাপের মতো কালো রোগী হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। একটা সিগারেট দিলাম। অথচ আমি নিশ্চিত জানি, বালিশের নিচে তাঁর নিজের সিগারেট আছে। বাকের সাহেব নিজের সিগারেট কমই খান। আহ, কী সব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ভাবছি। আজ আমি একজন অতিথি-কবি। আমার চিন্তাভাবনা হবে কবির মতো। আমি নরম স্বরে ডাকলাম, বাকের সাহেব।
জি।
আজ আমার কেন জানি বড় ভালো লাগছে।
ভালো লাগার কী হল আবার?
বার্কের সাহেব বড়ই অবাক হলেন। তার কাছে আজকের দিনটি অন্য সব দিনের মতোই। সাধারণ। ক্লান্তিকর। আমি মৃদুস্বরে ডাকলাম, বাকের সাহেব।
বলেন।
আজ আমার জন্মদিন।
তাই নাকি?
জি। এগারোই বৈশাখ।
আম-কাঁঠালের সিজনে জন্মেছেন রে ভাই।
এই বলেই বাকের সাহেব চায়ের কাপ নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। আজ আমি রাগ করব না। চমৎকার একটি সকালকে কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। সন্ধ্যাবেলা যাব নীলুদের বাড়ি। সন্ধ্যা হবার আগে পর্যন্ত শুধু ওর কথাই ভাবব।
বাকের সাহেব বাথরুম থেকে ফিরে এসে বললেন, পাইখানা কষা হয়ে গেছে ভাই।
আমি শুনেও না-শোনার ভান করলাম। আজ আমি অসুন্দর কিছুই শুনব না। আজ আমার জন্মদিন। আজ নীলুদের বাসায় যাব এবং তাকে গোপন কথাটি বলব।
ঝড় হোক। বৃষ্টি হোক। কিংবা প্রচণ্ড টর্নেডো হোক। কিছুই আসে যায় না। আজ সন্ধ্যায় আমি ঠিকই যাব নীলুদের বাসায়। নীলুর বাবা হয়তো বসে থাকবেন বারান্দায়। তিনি আজকাল বেশিরভাগ সময় বারান্দাতেই থাকেন। অপরিচিত কাউকে দেখলে কপালের চামড়ায় ভঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকান। আমার দিকেও তাকাবেন। আমি হাসিমুখে বলব, নীলুফার কি বাসায় আছে? ওর সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল। আমি উত্তেজিত অবস্থায় ঠিকমতো কথা বলতে পারি না। কথা গলায় আটকে যায়। কিন্তু আজ আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আজ কথা বলব অভিনেতাদের মতো।
চা শেষ করেই বাকের সাহেব ঘুমুবার আয়েজন করলেন। গল টেনে বলেন, নটা পর্যন্ত ঘুমাব। তারপর উঠে নাশতা খেয়ে আবার ঘুম। ছুটির দিনের ঘুম কাকে বলে, দেখবেন। ম্যারাথন ঘুম। হা-হা-হা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নিশ্বাস ভারী হয়ে এল। বারান্দায় এসে দেখি আলো ফুটছে। আকাশ হালকা নীল। পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। গোপন কথা বলার জন্যে এরচে সুন্দর দিন অর হবে না।
সকাল এগারোটায় টেলিফোন করলাম। নীলুকে টেলিফোনে কখনো পাওয়া যায় না। আজ পাওয়া গেল। নীলু কিশোরীদের মতো গলায় বলল, কে কথা বলছেন?
আমি মঞ্জু।
ও, মঞ্জু ভাই। আপনি কেমন আছেন?
ভালো। তুমি কেমন আছ নীলু?
আমিও ভালো।
কী করছিলে?
পড়ছিলাম। আবার কী করব? আমার অনার্স ফাইনাল না?
ও তাই তো। আচ্ছা শোন নীলু, তুমি কি আজ সন্ধ্যায় বাসায় থাকবে?
থাকব না কেন?
আমি একটু আসব তোমাদের ওখানে।
বেশ আসুন।
একটা কথা বলব তোমাকে।
কী কথা।
গোপন কথা।
আপনার আবার গোপন কথা কী?
নীলু খিলখিল করে হাসতে লাগল। কী সুন্দর সুরেলী হাসি। কী অদ্ভুত লাগছে শুনতে।
হ্যালো নীলু।
বলুন শুনছি। আজ সন্ধ্যায় আসব।
বেশ তো আসুন। রাখলাম এখন। নাকি আরো কিছু বলবেন?
না, এখন আর কিছু বলব না।
নীলু রিসিভার নামিয়ে রাখার পরও আমি অনেকক্ষণ রিসিভার কানে লাগিয়ে রইলাম।
মাত্র এগারোটা বাজে। আরো আট ঘণ্টা কাটাতে হবে। কোথায় যাওয়া যায়? কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। নিউমার্কেটে কিছুক্ষণ হাঁটলাম একা একা। এবং একসময় দামি একটা শার্ট কিনে ফেললাম। অন্যদিন হলে শার্টের দাম আমার বুকে বিধে থাকত। আজ থাকল না। দামের কথা মনেই রইল না।
দশটি ফাইভ ফাইভ কিনলাম এ্যালিফেন্ট রোড থেকে। অন্তত আজকের দিনটিতে দামি সিগারেট খাওয়া যেতে পারে। নীলুর জন্য কিছু-একটা উপহার নিয়ে গেলে হয় না? কী নেয়া যায়? সুন্দর মলাটের একটা কবিতার বই। সেখানে খুব গুছিয়ে একটা কিছু লিখতে হবে যেমন, নীলুকে দেখা হবে চন্দনের বনে। বইটি দেয়া হবে ফিরে আসার সময়। নীলু নিশ্চয়ই আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসবে। তখন বলব, নীলু, আজ কিন্তু আমার জন্মদিন। নীলু বলবে, ওমা আগে বলবেন তো?
আগে বললে কী করতে?
কোনো উপহার টুপহার কিনে রাখতাম।
কী উপহার?
কবিতার বইটই।
আমি তো কবিতা পড়ি না।
না পড়লেও বই উপহার দেয়া যায়। ঠিক এই সময় আমি মোড়ক খুলে বইটি হাতে দিয়ে অল্প হাসব। হাসতে-হাসতেই বলব, আমি তোমার জন্য একটা কবিতার বই এনেছি নীলু।