জরী, আমার কাছে তুমি সুখে ছিলে না? কিসে একটি মানুষ সুখী হয়? নীলগঞ্জে আমাদের প্রকাণ্ড বাড়ি দেখে তোমার কি মন ভরে উঠে নি? তুমি কি অবাক হয়ে চেঁচিয়ে ওঠ নি— ওমা এ যে রাজপ্রাসদি! জোছনা রাত্রিতে হাত ধরাধরি করে যখন আমরা পুকুরপাড়ে বেড়াতে যেতাম তখন কি গভীর আবেগ তোমাকে এতটুকু আচ্ছন্ন করে নি? তোমাকে আমি কী দেই নি জরী? নিরবচ্ছিন্ন ভালোবাসার দেয়ালে তোমাকে ঘিরে রেখেছিলাম। রাখি নি?
তবু এক রাত্রিতে তুমি বিছানা ছেড়ে চুপিচুপি ছাদে উঠে গেলে। আমি দেখলাম, তুমি পাথরের মূর্তির মতো কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছ। বুকে ধ্বক করে একটা ধাক্কা লাগল। বিস্মিত হয়ে বললাম, কী হয়েছে জরী?
তুমি খুব স্বাভাবিক গলায় বললে, কই কিছু হয় নি তো। তারপর নিঃশব্দে নিচে নেমে এলে।
তোমার মধ্যে গভীর একটি শূন্যতা ছিল। আমি তা ধরতে পারি নি। শুধু বুঝতে পারছিলাম তোমার কোনোকিছুতেই মন লাগছে না। সে সময় এসে নীপবনে নাম দিয়ে আমি চমৎকার একটি পেইনটিং করছিলাম। আকাশে আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ। একটি ভাঙা বাড়ির পাশে একটি প্রকাণ্ড ছায়াময় কদম গাছ। এই নিয়ে আঁকা। আমার শিল্পীজীবনের ভালো কটি ছবির একটি। ভেবেছিলাম বিয়ের বছরটি ঘুরে এলে তোমাকে এই ছবি দিয়ে মুগ্ধ করব। কিন্তু ছবি তোমাকে এতটুকুও মুগ্ধ করল না। তুমি ক্লান্ত গলায় বললে, এক বছর হয়ে গেছে বিয়ের? ইশ কত তাড়াতাড়ি সময় যায়!
তোমার কণ্ঠে কি সেদিন একটি চাপা বিষাদ ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল? ক্রমে-ক্রমে তুমি বিষণ্ণ হয়ে উঠতে লাগলে। প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখতাম তুমি জেগে বসে আছ। অবাক হয়ে বলেছি, কী হয়েছে জরী?
কই? কিছু হয় নি তো।
ঘুম আসছে না?
আসছে।
বলেই তুমি আবার কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লে। কিন্তু তুমি জেগে রইলে। অথচ ভান করতে লাগলে যেন ঘুমিয়ে আছ। আমি বললাম, জরী সত্যি করে বল তো তোমার কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
কোথাও বেড়াতে যাবে?
কোথায়?
কক্সবাজার যাবে? হোটেল ভাড়া করে থাকব।
উহুঁ, ভাল্লাগে না।
আরো অনেকদিন পর এক সন্ধ্যায় ঘন ঘোর হয়ে মেঘ করল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল ঝড়। দড়াম শব্দে একেকবার আছড়ে পড়ছে জানালার পাই। বাজ পড়ছে ঘনঘন। ঘরের লাগোয়া জামগাছে শোঁ-শোঁ শব্দ উঠছে। দুজনে বসে আছি চুপচাপ। তুমি হঠাৎ একসময় বললে, তোমাকে একটা কথা বলি, রাখবে?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কী কথা?
আগে বল রাখবে?
নিশ্চয়ই রাখব।
তুমি তখন আমাকে তোমার আনিস স্যারের গল্প বললে। যিনি কলেজে তোমাদের অঙ্কের প্রফেসর ছিলেন। খামখেয়ালির জন্যে যার কলেজের চাকরিটি গেছে। এখন খুব খারাপ অবস্থায় আছেন। কোনোরকমে দিন চলে। তুমি আমাকে অনুরোধ করলে নীলগঞ্জে নতুন যে কলেজ হচ্ছে সেখানে তাঁকে একটি চাকরি জোগাড় করে দিতে।
তুমি উজ্জ্বল চোখে বললে, আনিস স্যার মানুষ নন। সত্যি বলছি ফেরেশতা। তুমি আলাপ করলেই বুঝবে।
আমি বললাম, নীলগঞ্জের কলেজের এখনো তো অনেক দেরি। মাত্র জমি নেয়া হয়েছে।
হোক দেরি। আনিস স্যার ততদিন থাকবে আমাদের এখানে। নিচের ঘর তো খালিই থাকে। একা মানুষ কোনো অসুবিধা হবে না।
একা মানুষ?
হুঁ। মেয়ে আর বউ দুজনের কেউই বেঁচে নেই। একদিনে দুজন মারা গেছে কলেরায়। আর মজা কী জানো? তার পরদিনই আনিস স্যার এসেছেন ক্লাস নিতে। প্রিন্সিপ্যাল স্যার বললেন, আজ বাড়ি যান। ক্লাস নিতে হবে না। আনিস স্যার বললেন, বাড়িতে গিয়ে করবটা কী? কে আছে বাড়িতে?
আমি বললাম, চিঠি লিখলেই কি তোমাদের স্যার আসবেন এখানে?
হ্যাঁ, আসবেন। আমি লিখলেই আসবেন। লিখব স্যারকে?
বেশ, লেখ।
তুমি সঙ্গে-সঙ্গে চিঠি লিখতে উঠে গেলে। সে চিঠি শেষ হতে অনেক সময় লাগল। বসে-বসে দেখলাম অনেক কাটাকুটি করলে। অনেক কাগজ ছিড়ে ফেললে। এবং এক সময় চিঠি শেষ করে হাসিমুখে উঠে এলে। তোমাকে সে রাতে ভীষণ উৎফুল্ল লাগছিল।
আহ, লিখতে-লিখতে কেমন যেন লাগছে। এখন প্রায় মধ্যরাত্রি। তবু ইচ্ছে হচ্ছে রাস্তায় একটু হেঁটে বেড়াই। নিশি রাতে নির্জন রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে আমার বেশ লাগল। তুমি কি দস্তয়েভস্কির রূপালী রাত্রি পড়েছ? রূপালী রাত্রিতে আমার মতো একজন নিশি-পাওয়া লোকের গল্প আছে।
জরী, তোমাদের স্যার কবে যেন উঠলেন আমাদের বাড়িতে? দিন-তারিখ এখন আর মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে মাঝবয়েসী একজন ছোটখাটো মানুষ ভোরবেলা এসে খুব হইচই শুরু করেছিলেন। চেঁচিয়ে রাগী ভঙ্গিতে ডাকছিলেন—সুলতানা, সুলতানা। তুমি ধড়মড় করে জেগে উঠলে। ও আলু, কী কাণ্ড, স্যার এসে পড়েছেন—এই বলে খালি পায়েই ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে গেলে। আমি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম তুমি পা ছুঁয়ে সালাম করছ, আর তোমার স্যার বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। খানিক পরে দেখলাম তিনি খুব হাসছেন। সেই সঙ্গে লাজুক ভঙ্গিতে তুমিও হাসছ।
তুমি খুশি হয়েছিলে তো? নিশ্চয়ই হয়েছিলে। আমি স্টুডিওতে বসে তোমার গভীর আনন্দ অনুভব করতে পারছিলাম। একটি তীব্র ব্যথা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সেদিন আমার আত্মহত্যার কথা মনে হয়েছিল।
অথচ তোমার স্যার ঋষিতুল্য ব্যক্তি ছিলেন। এমন সহজ, এমন নির্লোভ লোক আমি খুব কমই দেখেছি। কোনোকিছুর জন্যেই কোনো মোহ নেই। এমন নির্লিপ্ততা কল্পনাও করা যায় না। জরী, তুমি ঠিক লোকের প্রেমেই পড়েছিলে। এমন মানুষকে ভালোবেসে দুঃখ পাওয়াতেও আনন্দ। তোমার স্যার ফেরেশতা ছিলেন কিন্তু জরী আমি তো ফেরেশতা নই। আমার হৃদয়ে ভালোবাসার সঙ্গে-সঙ্গে গ্লানি ও ঘৃণা আছে। আমি সত্যি একজন সাধারণ মানুষ।