Site icon BnBoi.Com

নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ – হুমায়ূন আহমেদ

নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ - হুমায়ূন আহমেদ

উবাস্তে ইয়ামা

‘উবাস্তে’র অর্থ ময়লা, ইংরেজিতে গারবেজ। ‘ইয়ামা’ শব্দের অর্থ পর্বত। জাপানি এই শব্দ দুটির অর্থ—যে পর্বতে ময়লা ফেলা হয়।
প্রাচীন জাপানের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে লালন-পালন করার সামর্থ্য ছিল না। একটা পর্যায়ে তারা পিঠে করে বাবা-মাকে নিয়ে পর্বতের খাদে ফেলে দিয়ে আসত। সবার কাছে এটাই ছিল স্বাভাবিক। পিঠে চড়া বৃদ্ধ পিতা-মাতার হাতে গাছের একটি ছোট্ট ডাল থাকত। এই ডাল দিয়ে তারা পুত্রের গায়ে আস্তে আস্তে বাড়ি দিত। এই কাজটা তারা কেন করত, তা পরিষ্কার নয়। বলা হয়ে থাকে, এই কাজটি তারা করত, যেন পুত্র ফিরে যাওয়ার পথ ভুলে না যায়।
আজকের জাপান অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের তৃতীয় শক্তি। জাপানি ইয়েনের পাশে আমেরিকান ডলার দাঁড়াতেই পারছে না। কিন্তু উবাস্তে ইয়ামা এখনো জাপানে আছে। তবে এখন আর পাহাড়-পর্বতে জাপানিরা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে রেখে আসছে না। তারা ফেলে দিয়ে আসছে আধুনিক ওল্ড হোমে।
এই বৃদ্ধনিবাসের একটি গল্প নাসিরের কাছে শুনলাম। [ড. নাসির উদ্দিন জমাদার, পূর্ণ প্রফেসর, রিক্কিও বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।] বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে নাসির আমাকে দেখতে আমেরিকায় এসেছে। এখন আমার সঙ্গে বাস করছে। প্রতিদিন জাপানি রান্না রাঁধছে। অতি পুষ্টিকর এবং অতি অখাদ্য এসব খাবার খেতে আমাকে বাধ্য করছে।
যা-ই হোক, বৃদ্ধনিবাসের গল্পটা বলি। নাসির প্রথম যৌবনে ভলান্টিয়ার হিসেবে জাপানিদের বৃদ্ধনিবাসে কাজ করত। অথর্ব এসব মানুষকে গোসল করানো, খাওয়ানো ছিল তার কাজ। একদিন নাসিরের উপস্থিতিতে এক বৃদ্ধা তাঁর তিন পুত্রকে খবর পাঠালেন। তাদের বললেন, বাবারা! আমার খুব শখ বৃদ্ধাশ্রমে মৃত্যু না হয়, তোমাদের কারও বাসায় আমার মৃত্যু হয়। আমার কাছে নগদ পাঁচ কোটি টাকা আছে (বাংলাদেশি হিসাবে বলা হলো)। তোমাদের মধ্যে যে আমাকে জীবনের শেষ কটি দিন রাখবে, তাকে আমি এই পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে যাব।
তিন পুত্রই কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বলল, মা, সম্ভব হবে না। বাসা ছোট। এখন তোমার অনেক সেবা দরকার। সেটা পারব না।
বৃদ্ধ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক আছে।

আমরা অনেক ভালো আছি না? বাংলাদেশের হতদরিদ্র রিকশাওয়ালা তার রিকশার পেছনে লিখে রাখে ‘মায়ের দোয়া’। বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা করা শুধু যে আমাদের সংস্কৃতির অংশ, তা নয়, এটা বাধ্যতামূলক।
যৌথ পরিবার বাংলাদেশে এখন আর নেই। যৌথ পরিবার ভেঙে পড়েছে। বৃদ্ধ পিতা-মাতাদের এখন বিভিন্ন ছেলেমেয়ের বাসায় রুটিন করে থাকতে হয়। যে পুত্র বা কন্যার কাছে বৃদ্ধ পিতা বা মাতা থাকতে যান, সেই পুত্র বা কন্যা আকাশের চাঁদ হাতে পায় বলে আমার ধারণা।
ধর্মও পিতা-মাতার প্রতি আমাদের কর্তব্য বিষয়ে অনুশাসন দিয়ে গেছে। অনেক উদাহরণের মধ্যে একটি দিচ্ছি, ‘শো গ্র্যাটিচ্যুড টু মি অ্যান্ড টু ইয়োর প্যারেন্টস।’ (সূরা ৩১, আয়াত-১৪) আল্লাহপাক তাঁর নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরপরই বলেছেন পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথা।
সূরা ১৭, আয়াত ২৩-এ বলা হয়েছে, ‘ইয়োর লর্ড ডিক্রিড দ্যাট ইউ ওয়রশিপ নান বাট হিম, অ্যান্ড দ্যাট ইউ বি কাইন্ড টু প্যারেন্টস।’ আমি কল্পনায় দেখার চেষ্টা করলাম, আমার বয়স ৭০ হয়েছে। আমি অথর্ব, সংসারে অপ্রয়োজনীয়। আমার বড় পুত্র নুহাশ হুমায়ূন আমাকে পিঠে করে নিয়ে যাচ্ছে উবাস্তে বেঙ্গালওয়ানে [যেহেতু বাংলাদেশে পর্বত নেই, ফেলে দিতে হবে সমুদ্রে। বঙ্গোপসাগরের জাপানি নাম বেঙ্গালওয়ান।] আমার হাতে ছোট্ট লাঠি। আমি লাঠি দিয়ে পুত্রের গায়ে মাঝেমধ্যে বাড়ি দিচ্ছি। কী ভয়ংকর! কী ভয়ংকর!!
জাপানের রিক্কিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম হয়েছে। এর মূল প্রবক্তা হলেন রিক্কিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক কাসাহারা কিওশি। এই কাজে অধ্যাপক কাসাহারাকে কয়েকবার ঢাকায় আসতে হয়েছে।
প্রতিবারই তাঁর সঙ্গী ছিলেন রিক্কিও বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক ড. নাসির উদ্দিন জমাদার। এই মানুষটির ধারণা, হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন, যাকে অধ্যাপক কাসাহারা কিওশি খুবই পছন্দ করবেন। মূলত নাসিরের আগ্রহে আমি অধ্যাপক কাসাহারাকে ঢাকা ক্লাবে ডিনারে দাওয়াত করলাম। ডিনারের একটি পর্যায়ে কাসাহারা ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে ঘোষণা করলেন, হুমায়ূন আহমেদ তাঁর বন্ধু।
এরপর তাঁর সঙ্গে আরও দুবার আমার দেখা হলো। প্রতিবারই আমার রসিকতায় তাঁকে হো হো করে হাসতে দেখলাম। একবার তিনি গলা নিচু করে বললেন, বন্ধু, আমি খুব খারাপ অবস্থায় আছি। আমার মানিব্যাগের ওপর আমার কোনো কন্ট্রোল নেই। মানিব্যাগ জমা রাখতে হয় আমার স্ত্রীর কাছে। আমাকে আমার হাতখরচের টাকাও তার কাছ থেকে চেয়ে নিতে হয়। তোমার কী অবস্থা আমাকে বলো।
যা-ই হোক, বন্ধু কাসাহারা ড. নাসির জমাদারের হাতে একটি খাম আমাকে পাঠিয়েছেন। নাসির খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে খামটা আমার হাতে দিয়ে বলল, আপনার বন্ধু কাসাহারা এই খামটি আপনাকে দিতে বলেছেন। আমি আপনার স্বভাব জানি। আমি ভয় পাচ্ছি, আপনি খামটি নেবেন না। তাহলে আপনার বন্ধু মনে কষ্ট পাবেন। জাপানের নিয়ম হচ্ছে, বন্ধুর আনন্দে ও দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়ানো।
আমি খাম খুলে দেখি, সেখানে সাত হাজার আমেরিকান ডলার। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ছয় লাখ টাকা। অধ্যাপক কাসাহারা (যাঁর মানিব্যাগের ওপর কন্ট্রোল নেই) তাঁর বন্ধুর চিকি ৎ সার জন্য পাঠিয়েছেন।
উবাস্তে ইয়ামার দেশের একজন মানুষের এই আচরণ হিসাবে মেলে না।

‘পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে
এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।’
—জীবনানন্দ দাশ

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, তারিখ: ০১-১২-২০১১

কচ্ছপকাহিনি

প্রায় ১০০ বছর আগে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রামের দৃশ্যচিত্র। আসরের নামাজ শেষ করে মাদ্রাসার একজন হতদরিদ্র শিক্ষক তাঁর বড় দুই পুত্রকে ডেকে পাঠালেন। তাদের বললেন, আমি হতদরিদ্র, নাদান একজন মানুষ। তোমাদের দুজনকে পড়াশোনা করানোর সাধ্য আমার নাই। আমি একজনকে পড়াশোনা করাব। অন্যজন গৃহস্থি (খেতের কাজ) করবে। তোমরা দুই ভাই আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসো, কে পড়াশোনা করবে, আর কে গৃহস্থি করবে। এই নিয়ে যেন পরে ভাইয়ে ভাইয়ে মনোমালিন্য না হয়। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ আল্লাহ পাক অপছন্দ করেন।
ঘটনা শুনে বড় ভাই কাঁদতে শুরু করল। কারণ, তার খুব স্কুলে পড়ার শখ। তার ধারণা হলো, হয়তো এই সুযোগ সে পাবে না। তার ছোট ভাই বড়জনের কান্না দেখে বাবাকে বলল, আমি গৃহস্থি করব। বড় ভাই পড়াশোনা করুক।
সেই অঞ্চলে সত্তর মাইলের মধ্যে কোনো স্কুল নেই। সত্তর মাইল দূরে বাচ্চা একটা ছেলেকে জায়গির পাঠানো হলো। অন্যের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করবে। বিনিময়ে তাদের ফুট-ফরমাশ খাটবে।
গরমের ছুটিতে বালক জায়গির থেকে বাড়িতে ফিরেছে। বালকের মা বললেন, বাবা গো! খাওয়াদাওয়া তারা ঠিকমতো দিত?
বালক বলল, দিত। কিন্তু তরকারিতে লবণ কম বলে খেতে পারতাম না।
তুমি লবণ চাইতা?
আমার লজ্জা করে।
গরমের ছুটির পর বালক জায়গিরে ফিরে যাচ্ছে। বালকের মা তার সঙ্গে বাঁশের চোঙের ভেতর ভরে লবণ দিয়ে দিলেন, যাতে বালককে লবণের কষ্ট না করতে হয়।
বালকের নাম ফয়জুর রহমান আহমেদ। আমার বাবা। অতি দুর্গম গ্রামের তিনি প্রথম ম্যাট্রিকুলেট, তিনি প্রথম গ্র্যাজুয়েট।
মুসলমান একটি ছেলে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে শুনে আঠারোবাড়ীর জমিদার তাকে দেখতে চাইলেন। বাবা খালি পায়ে জমিদারের সামনে উপস্থিত হলেন। সেই সময় ছাতা মাথায় দিয়ে জুতা পরে জমিদারের সামনে যাওয়া যেত না। জমিদার বললেন, বাবা, তুমি জুতা পায়ে আমার কাছে আসার যোগ্যতা অর্জন করেছ। আর কখনো আমার সামনে খালি পায়ে আসবে না।
এই জমিদারের কথা আমি মধ্যাহ্ন উপন্যাসে উল্লেখ করেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই জমিদারের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গান, ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে’ এই জমিদার বাড়িতে লেখা।
বাঁশের চোঙায় লবণ নিয়ে জায়গির বাড়িতে যাওয়ার বিষয়টা একসময় আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। দুপুরে ভাত খাচ্ছি। তরকারিতে লবণ কম হয়েছে। পাতে লবণ নিতেই মা পুরোনো গল্প তুললেন। যেহেতু অনেকবার শোনা গল্প, আমি হুঁ হুঁ করে গেলাম। মা বললেন, তোদের গ্রামের বাড়িতে আগে যেমন স্কুল ছিল না, এখনো নাই। তুই একটা স্কুল করে দে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা কত কষ্ট করে দূরে দূরে পড়তে যায়।
আমি বললাম, মা! স্কুল-কলেজ করা কোনো লেখকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তবে আপনি চেয়েছেন, আমি স্কুল করে দেব।
মা বললেন, স্কুলটা যেন তোর বাবার নামে হয়।
আমি বললাম, স্কুল হবে স্কুলের নামে। বাবার নামে, মায়ের নামে না। আমি স্কুলের নাম দিলাম ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নামে স্কুল। বাবা একজন শহীদ। কাজেই তাঁর নামও স্কুলে যুক্ত। মা! ঠিক আছে?
কী যে ভয়াবহ এক ঝামেলা সেদিন মাথায় নিলাম, তা আমি জানি আর জানেন বেলাল বেগ।
বেলাল বেগ সম্পর্কে বলি। ঘোরের জগতে বাস করা একজন মানুষ। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেছেন। আড়বাঁশির ওস্তাদ মানুষ। আমেরিকানরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাবরেটরি স্কুল করে, তখন তিনি সেই স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হন। বিটিভিতে চমৎকার সব শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম করতেন। একটির নাম ‘কিন্তু কেন’।
বেলাল বেগের সন্ধান আমাকে দিলেন সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে বেলাল বেগের সঙ্গে ছিলেন। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের তিনিও ছিলেন শিক্ষক। বেলাল বেগের সন্ধান করার চেষ্টা করলাম। শুনলাম, তিনি স্ত্রী এবং সংসারের ওপর অভিমান করে সন্দ্বীপে একা বাস করছেন। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা আমেরিকায় থাকে। তারা বেলাল বেগকে নিয়ে যেতে চায়। বেলাল বেগ নিজের দেশ ছেড়ে যাবেন না।
বেলাল বেগকে সন্দ্বীপ থেকে আনা হলো। আমি তাঁকে স্কুলের কথা বললাম। তাঁর চোখ চকচক করতে লাগল। তিনি আমাকে কিছু শর্ত দিলেন।
১. এই স্কুল আর দশটা স্কুলের মতো হলে চলবে না। এটি হতে হবে এমন এক স্কুল, যা উন্নত দেশের স্কুলের পাশে দাঁড়াবে।
২. স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার পাশাপাশি শিখবে মোরালিটি।
৩. প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর মাথায় স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিতে হবে।
আমি বললাম, আপনি আপনার মতো করুন। সব দায়িত্ব আপনার।
বেলাল বেগ ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি চলে গেলেন আমার গ্রামের বাড়ি কুতুবপুরে। গ্রামের মানুষদের আগে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্কুলের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হবে। স্কুলের জন্য একসঙ্গে অনেকখানি জায়গা প্রয়োজন। জায়গা কিনতে হবে। এই অঞ্চলে কোনো রাস্তাঘাট নেই। রাস্তাঘাট করতে হবে। ইলেকট্রিসিটি আনতে হবে।
বেলাল বেগের কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে একদিন আমার মা তাকে ডেকে পাঠালেন। বেলাল বেগের হাত ধরে বললেন, বাবা! একটা পর্যায়ে সবাই আমার ছেলেকে ছেড়ে চেলে যায়। তুমি তাকে ছেড়ে যেয়ো না। সে একা স্কুলটা করতে পারবে না।
বেলাল বেগ বললেন, আমি কখনো আপনার ছেলেকে ছেড়ে যাব না। আপনাকে কথা দিলাম।
বেলাল বেগ কথা রাখেননি। স্কুল নির্মাণের মাঝপথে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে গেলেন। আমি স্কুল শেষ করলাম। অপূর্ব আর্কিটেকচারাল ডিজাইনের কী সুন্দর স্কুল! ডিজাইনার ছিল আর্কিটেকচারের দ্বিতীয় বর্ষের একজন ছাত্রী—মেহের আফরোজ শাওন।
স্কুল তো দাঁড়াল। স্কুল চালাব কীভাবে? কিছুই তো জানি না। আমার সঞ্চিত অর্থের সবটাই গেছে। কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছি, তার একটা উদাহরণ দিই। ১২ বছর আগে খরচ করেছি ৭০ লাখ টাকা। স্কুলের জন্য ফার্নিচার কেনার টাকা নেই। লোহার খুঁটি গাড়া হয়েছে, বেড়া দেওয়ার টাকা নেই।
চেষ্টা করলাম সরকারের হাতে স্কুল তুলে দিতে। সরকারি লোকজন চোখ কপালে তুলে বলল, একটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার দাঁড়া করিয়ে আপনি দিয়ে দেবেন, তা কীভাবে হবে?
আওয়ামী লীগ, বিএনপি—অনেক দেনদরবার করলাম, তারা কেউ এই দায়িত্ব নেবে না। শিক্ষা শিক্ষা বলে এই দুই দলই মুখে ফেনা তুলে ফেলে, কিন্তু তৈরি একটা স্কুলের দায়িত্ব নেয় না।
একবার মনে হলো স্কুল বাদ, স্কুলের বদলে হাসপাতাল বানালে কি কেউ দায়িত্ব নেবে? প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটা হাসপাতাল তো দরকার। সেই চেষ্টাও বিফল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লোকজন এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন আমি একজন মানসিক প্রতিবন্ধী।
গেলাম ব্র্যাকের কাছে। তারা যদি কিছু করে। ব্র্যাকের কর্মকর্তারা এলেন, দেখলেন, প্রচুর খাওয়াদাওয়া করলেন এবং চলে গেলেন।
একসময় স্কুলের ২৬০টি কাচের জানালা ভেঙে পড়ল। লাইব্রেরি ঘর হিসেবে যেটা বানানো হয়েছিল, সেখানে নেশাখোরেরা গাঁজা খাওয়ার আসর বসাল। স্কুলের মাঠে সরিষা বুনে দেওয়া হলো। স্কুলের চারপাশের লোহার খুঁটিগুলো তুলে গ্রামের মানুষেরাই সের দরে বাজারে বেচে দিল। স্কুল ভবন গরু-ছাগল রাখার স্থায়ী নিবাসে পরিণত হলো।
এক রাতে খেতে বসেছি। আমার মা দুঃখিত গলায় বললেন, তোকে দিয়ে স্কুল বানানোর সিদ্ধান্ত ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। তুই আমার ওপর কোনো রাগ রাখিস না। দান গ্রহণ করতেও যোগ্যতা লাগে, তোর গ্রামের সেই যোগ্যতা নেই।
আমি বললাম, মা! আমি হচ্ছি কচ্ছপ। কচ্ছপ একবার যা কামড়ে ধরে তা ছাড়ে না। কচ্ছপের কামড় থেকে বাঁচার একটাই উপায়—তার গলা কেটে ফেলা। স্কুল আমি একাই চালাব।
হ্যাঁ, স্কুল চলছে। পাসের হার ১০০ ভাগ। এ বছর বৃত্তি পেয়েছে পাঁচটি ছেলেমেয়ে।
আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, পুরো বাংলাদেশে এই স্কুলের চেয়ে সুন্দর স্কুল নেই। কোনো স্কুলের এত বড় লাইব্রেরি নেই। এতগুলো কম্পিউটার নেই। আমি আমার স্কুলে এখন পর্যন্ত কোনো রাজনীতিবিদকে (এমপি, মন্ত্রী ইত্যাদি) নিতে পারিনি। তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। তাদের আমার প্রয়োজনও নেই।

পাদটীকা-১
বৃদ্ধ কচ্ছপ এইবার ‘ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার’ কামড়ে ধরেছে। কচ্ছপের কামড় বলে কথা। বেঁচে থাকলে কচ্ছপ যে ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার করে যাবে, তা নিশ্চিত ধরে নেওয়া যায়।
আমার পরিকল্পনা হলো, তিনজন ভিক্ষুকের কাছ থেকে প্রথম ক্যানসার রিসার্চ সেন্টারের জন্য অর্থ ভিক্ষা নেওয়া হবে। এদের ছবি তুলবেন নাসির আলী মামুন। স্কেচ করবেন ও ইন্টারভিউ নেবেন মাসুক হেলাল। তারপর আমরা যাব বাংলাদেশের তিন শীর্ষ ধনী মানুষের কাছে। ভিক্ষুকেরা দান করেছে শুনে তাঁরা লজ্জায় পড়ে কী করেন, আমার দেখার ইচ্ছা।
শীর্ষ ধনীর পর আমরা যাব তিন রাজনীতিবিদের কাছে। তাঁরা কিছুই দেবেন না আমরা জানি। তাঁরা নিতে জানেন, দিতে জানেন না। তবে খালি হাতে আমাদের ফেরাবেন না। উপদেশ দেবেন। আমাদের উপদেশের তো প্রয়োজন আছে।
তিন সংখ্যাটা কেন—এই প্রশ্ন আসতে পারে। পিথাগোরাসের মতে, তিন হচ্ছে সবচেয়ে রহস্যময় সংখ্যা। এটি একটি প্রাইম নাম্বার। তিন হচ্ছে ত্রিকাল—অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল। তিন হলো ট্রিনিটি। তিন মানে আমি, তুমি ও সে।

‘That holy dream that holy dream
…. … …
Hath cheered me as a lovely beam
A lonely spirit guiding.’

—Edgar Allan Poe
(A Dream)

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২০, ২০১১

কেয়ারগিভার

‘কেয়ারগিভার’ শব্দটির বাংলা—যে সেবা দান করে। স্লোয়ান-কেটারিংয়ে চিকিৎসা নিতে এসে কেয়ারগিভার শব্দের অর্থ নতুন করে জানলাম। হাসপাতালের কাছে রোগী যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার কেয়ারগিভার সে রকমই গুরুত্বপূর্ণ। কেয়ারগিভারের নাম হাসপাতালে তালিকাভুক্ত করা হলো—মেহের আফরোজ শাওন। রোগীর স্ত্রী। চিকিৎসকেরা কেয়ারগিভার ছাড়া আর কারও সঙ্গেই রোগ নিয়ে বা চিকিৎসা নিয়ে কোনো কথা বলবেন না।
রোগীর রক্ত নেওয়া হচ্ছে বা কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে, তখনো শুধু কেয়ারগিভারের উপস্থিতি থাকবে। আর কেউ থাকবে না।
কেমো দেওয়ার পদ্ধতিটাও সুন্দর। প্রথম একজন নার্স প্যাকেট ভর্তি করে কয়েক ব্যাগ ওষুধ নিয়ে আসবে। কেয়ারগিভার ও রোগীকে প্রতিটি ওষুধের নাম বলবে। তারপর সে বিদায় নেবে। আসবে দ্বিতীয় নার্স। সেও একই কাজ করবে। প্রতিটি ওষুধের নাম বলবে। ডাবল চেকিং। যাতে কখনো কোনো ভুল না হয়। ঠিক রোগীকে ঠিক কেমো দেওয়া হচ্ছে কি না, নাকি ভুল অন্য কাউকে দেওয়া হচ্ছে, তার পরীক্ষাও আছে। দুজন নার্সই আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করবে—
তোমার নামের শেষ অংশ কী?
আহমেদ।
প্রথম অংশ কী?
হুমায়ূন।
জন্মতারিখ বলো।
জন্মতারিখ বলতে গিয়ে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। ১৩ নভেম্বর আমার জন্ম, পাসপোর্টে লেখা এপ্রিলের ১০ তারিখ। হাসপাতালে পাসপোর্টের জন্মতারিখ লেখা হয়ে আছে। কাজেই যতবার আসল জন্মদিন বলেছি, হইচই শুরু হয়েছে। এই রোগী কি সেই রোগী, নাকি অন্য কেউ? পাত্তা লাগাও, পাত্তা লাগাও। তাড়াতাড়ি করো।
রোগীর সেবা ছাড়াও কেয়ারগিভারকে আরও কিছু ঝামেলার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ক্যানসারে আক্রান্তদের অনেক ধরনের সমিতি আছে। তাদের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তাদের সামলাতে হয়। বেশির ভাগ সমিতিই হলো রোগীর ডিপ্রেশন কাটানোবিষয়ক।
একটি সমিতি দেখলাম, বেঁচে থাকার অর্থ এবং আনন্দ বোঝানোর সমিতি। এক ঘণ্টা বাড়তি বেঁচে থাকাও বিশাল ব্যাপার, এ জাতীয় বিষয়। এর সঙ্গে আছে প্রেয়ার গ্রুপ অর্থাৎ দোয়া পার্টি বা স্পিরিচুয়াল কাউন্সেলিং। সব ধর্মের রোগীদের জন্যই দোয়ার ব্যবস্থা আছে।
আমার কেয়ারগিভার সব ঝামেলা হাসিমুখে সহ্য করে আমার সঙ্গেও সার্বক্ষণিক হাস্যমুখী থাকার চেষ্টা করে। মনে হয়, তাকে হাসপাতাল হাসি হাসি মুখে রোগীর সঙ্গে থাকতে বলে দেওয়া হয়েছে।
একদিন লক্ষ করলাম, সে ঝিম ধরে কম্পিউটারের ফেসবুকের পাতার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের পাতায় অশ্রুবিন্দু।
আমি বললাম, সমস্যা কী?
কেয়ারগিভার বলল, কোনো সমস্যা না। সামান্য মন খারাপ। কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।
আমি বললাম, আমাকে বলো, দেখি, মন খারাপ কাটানোর চেষ্টা করতে পারি কি না।
তোমাকে বলব না। তোমার মন খারাপ হবে।
আমি বললাম, সহজে মন খারাপ হবে, এমন মানুষ আমি না। বুঝতে পারছি, ফেসবুকে পাঠানো কারও কমেন্ট পড়ে তুমি আপসেট হয়েছ। কী লিখেছে?
শাওন পড়ে শোনাল। কেউ একজন লিখেছে, তোমার উচিত শিক্ষা হয়েছে। আমি খুশি যে তোমার স্বামীকে ক্যানসার দিয়ে আল্লাহ তোমাকে শিক্ষা দিলেন। এই শিক্ষা তোমার আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল।
শাওনের মেয়ে লীলাবতী যখন মারা গেল, তখনো সে এ ধরনের চিঠিপত্র পেত। লেখা থাকত, তোমার কঠিন শাস্তি হওয়ায় আমরা খুশি। আরও শাস্তি হবে। এই ধরনের কথা।
আমি শাওনকে বললাম, পৃথিবীতে মানসিক অসুস্থ অনেক মানুষ। তাদের নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমরা ভাবব সুস্থ মানুষদের কথা। তোমার ফেসবুকে শত শত মানুষ কত চমৎকার সব কথা লিখছে। লিখছে না?
হ্যাঁ।
এর মধ্যে একজনের কথা চিন্তা করো। সে চলে গেছে মক্কায়, কাবা শরিফে। সেখান থেকে তোমাকে জানিয়েছে, আমি স্যারের জন্য দোয়া করতে এসেছি। শাওন আপু, আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। এর পরও কি মন খারাপ করা তোমার উচিত?
শাওন বলল, না, উচিত না।
তাহলে মিষ্টি করে একটু হাসো।
হাসতে পারব না।
বলেও সে হাসল।
আমাদের আশপাশে বিকৃত মানসিকতার মানুষের সংখ্যা কি বাড়ছে? মনে হয় বাড়ছে। একজনের কথা বলি, সে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য হাস্যকর কাণ্ডকারখানা শুরু করল। একটা পর্যায়ে গেটের সামনে স্ট্রাইক করার মতো অবস্থা। মহা বিরক্ত হয়ে তাকে আসতে বললাম। ২৩-২৪ বছরের যুবক। কঠিন চোখমুখ। আমি বললাম, এখন বলো, আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য এত ব্যস্ত হয়েছ কেন? বিশেষ কিছু কি বলতে চাও?
চাই।
তাহলে বলে ফেলো।
আপনার লেখা আমার জঘন্য লাগে।
এই কথাটা বলার জন্য এত ঝামেলা করেছ?
হ্যাঁ! কারণ সরাসরি এই কথা আপনাকে বলার কারোর সাহস নাই। সবাই আপনার চামচা।
আমি বললাম, আরও কিছু কি বলবে?
হ্যাঁ।
বলে ফেলো।
সে ইংরেজিতে বলল, আই ওয়ান্ট ইউ টু ডাই সুন।
আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম (ইংরেজিতে), আই হোপ অ্যান্ড প্রে ইউ হ্যাভ আ লং অ্যান্ড মিনিংফুল লাইফ।

হুমায়ূন আহমেদ, নিউইয়র্ক থেকে
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৫, ২০১১

তিন ডব্লিউ

কোনো নিউইয়র্কবাসীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আবহাওয়া আজ কেমন যাবে?
সে হতাশ ভঙ্গি করে বলে, তিন ডব্লিউ! তিন ডব্লিউর বিষয়ে কিছু বলা ঈশ্বরের পক্ষেও সম্ভব না।
তিন ডব্লিউ হচ্ছে—
১. Women
হ্যাঁ, মেয়েদের বিষয়ে কিছু বলা সব দেশের জন্যই কঠিন।
২. Work
‘কাজ’ আমেরিকায় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আসলেই ভয়াবহ। অকারণ দেশ দখল করে করে দেউলিয়ার কাছাকাছি। লিবিয়া চলে গেল। পরবর্তী দেশ কোনটি, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি।
৩. Weather
তিন ডব্লিউর শেষটি Weather। নিউইয়র্কের জন্য সম্ভবত এটা সত্যি। অক্টোবরে এখানে কখনো বরফ পড়ে না। এই অক্টোবরে বরফ পড়ে একাকার। মানুষ মারা গেছে তিনজন। আমেরিকানের মৃত্যু সহজ কথা না।
যা-ই হোক, বরফপাতের গল্প বলি। সকাল নয়টা বাজে। আমার পুত্র নিষাদ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, বাবা ‘ভয়মকর’ অবস্থা। (পুত্র ভয়ংকর বলতে পারে না, বলে ভয়মকর।)
আমি বললাম, ঘটনা কী?
সে বলল, আকাশের সাদা মেঘগুলো মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।
বাংলা ভাষার লেখকদের বরফপাতের বর্ণনায় থাকে, ‘পেঁজা তুলার মতো বরফ পড়ছে।’ এর বাইরে আমি কিছু পাইনি। শিশুর কাছে শুনলাম, আকাশের সাদা মেঘ নেমে এসেছে। নবীজি (দ.) বলেছেন, ‘বিদ্যাশিক্ষার জন্য সুদূর চীনে যাও।’ আমি বলছি, ভাষা শিক্ষার জন্য শিশুদের কাছে যাওয়া যেতে পারে।
থাকুক এই প্রসঙ্গ। তৃতীয় ডব্লিউ নিয়ে কথা বলি। আগের দিন প্রচণ্ড ঠান্ডা গিয়েছে। বাড়ির বয়লার ফেটে গেছে। হিটিং কাজ করছে না। আমরা ঠান্ডায় জবুথবু। পরদিনই আবহাওয়া উষ্ণ। ঝলমলে রোদ।
আমি গায়ে রোদ মাখানোর জন্য ঘরের বাইরে রোদে বসেছি। হাতে কফির মগ। আমার সামনে পাশের বাড়ির গায়ানিজ এক যুবক এসে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, গ্র্যান্ডপা। কেমন আছ?
আমি ধাক্কার মতো খেলাম। এই প্রথম এমন বয়স্ক মানুষ আমাকে ‘গ্র্যান্ডপা’ ডাকল। তাহলে কি আমার চেহারা গ্র্যান্ডপা ডাকার মতো হয়ে গেছে!
শাওন বলল, গ্র্যান্ডপা ডাকায় তোমার কি মন খারাপ লাগছে?
আমি বললাম, লাগছে।
শাওন বলল, তোমার নিজের নাতি-নাতনি আছে। তারা যদি তোমাকে ‘গ্র্যান্ডপা’ ডাকে, তাহলে কি তোমার খারাপ লাগবে?
আমি বললাম, অবশ্যই না।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করলাম। আসলেই তো। গ্র্যান্ডপা ডাকায় আমার মন খারাপ হবে কেন?
আমার এখন চার নাতি-নাতনি। আমি যেখানে বাস করি, তা তাদের জন্য নিষিদ্ধ বলে এদের আমি দেখি না। ওরাও গ্র্যান্ডপা ডাকার সুযোগ পায় না।
‘এভরি ক্লাউড হ্যাজ এ সিলভার লাইনিং’। আমার কর্কট রোগের সিলভার লাইনিং হলো, এই রোগের কারণে প্রথমবারের মতো আমার তিন কন্যা আমাকে দেখতে তাদের সন্তানদের নিয়ে ‘দখিন হাওয়া’য় পা দিল। ঘরে ঢুকল তা বলা যাবে না। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। সূর্যের চেয়ে বালি গরম হয়—এই আপ্তবাক্য সত্য প্রমাণ করার জন্য মেয়েদের স্বামীরা মুখ যতটা শক্ত করে রাখার, ততটা শক্ত করে রাখল।
অবশ্য আমিও সেই অর্থে তাদের দিকে যে ফিরে তাকালাম, তা না। ঘরভর্তি মানুষ। মেয়েদের দেখে হঠাৎ যদি আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করে কেঁদে ফেলি, সেটা ভালো হবে না।
আমি আমার তিন ডব্লিউর অর্থাৎ তিন কন্যার গল্প বলি।

১. প্রথম ডব্লিউ
নোভা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছে। আমেরিকা থেকে পিএইচডি করে বর্তমানে দেশে ফিরেছে। পিএইচডি ডিগ্রির সঙ্গে সে হিজাবও নিয়ে এসেছে। মাশআল্লাহ, কেয়া বাত হায়।
আমি যখন নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছি, তখনকার কথা। ইউনিভার্সিটি আমাকে বাগান করার জন্য দুই কাঠা জমি দিয়েছে। আমি মহা উৎসাহে শাইখ সিরাজ হয়ে গেলাম। খুন্তি, খুরপি, কোদাল কিনে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। মহা উৎসাহে জমি কোপাই, পানি দিই। বীজ বুনি। আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী কন্যা নোভা।
বিকেল পাঁচটায় ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে দেখি, বাড়ির সামনে খুরপি ও কোদাল নিয়ে নোভা বসে আছে। প্রথমে জমিতে যেতে হবে, তারপর বাসায় ঢোকা। যেদিন ফসলে জমি ভরে গেল, সেদিনের দৃশ্য—মেয়ে গাছ থেকে ছিঁড়ে টকটকে লাল টমেটো প্লাস্টিকের বালতিতে ভরছে এবং বলছে, বাবা, আই মেইড ইট! (মেয়ে তখনো বাংলা বলা শেখেনি)।
মেয়ের আনন্দ দেখে চোখ মুছলাম।

২. দ্বিতীয় ডব্লিউ
নাম শীলা। শুরুতে ছিল শীলা আহমেদ। স্বামী এসে স্ত্রীর নামের শেষে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বাবাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দেয়। এখন শীলার নামের অবস্থা কী জানি না। এই মেয়েটিও বড় বোনের মতো মেধাবী। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স ও এমএতে ইকোনমিকসে প্রথম শ্রেণী পেয়েছে।
এখন তার গল্প। তখন শীলার বয়স ১২ কিংবা ১৩। সবাইকে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে গিয়েছি। হোটেলে ওঠার সামর্থ্য নেই। বন্ধু ফজলুল আলমের বাসায় উঠেছি (ফজলুল আলম হচ্ছে আগুনের পরশমণির শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলমের ছোট ভাই।)
আমি ক্যাম্পিং পছন্দ করি, ফজলু জানে। সে বনে ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করল। আমরা জঙ্গলে এক রাত কাটাতে গেলাম। প্রচণ্ড শীত পড়েছে। তাঁবুর ভেতর জড়সড় হয়ে শুয়ে আছি। একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর রাতে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙল। দেখি, শীলা বসে আছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি বললাম, মা, কী হয়েছে?
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
আমি বুঝলাম, এই মেয়ে কঠিন ক্লস্ট্রোফোবিয়া। আসলেই সে নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। আমি বললাম, গরম কাপড় পরো। তাঁবুর বাইরে বসে থাকব।
সে বলল, একা একা থাকতে পারব না। ভয় লাগে। কিছুক্ষণ একা থাকতে গিয়েছিলাম।
আমি বললাম, আমি সারা রাত তোমার পাশে থাকব।
তাই করলাম। মেয়ে একপর্যায়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাল। সকাল হলো। মেয়ের ঘুম ভাঙল। সে বলল, বাবা, তুমি একজন ভালো মানুষ।
আমি বললাম, মা! পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, একজনও খারাপ বাবা নেই।
এখন মনে হয় শীলা বুঝে গেছে—পৃথিবীতে খারাপ বাবাও আছে। যেমন, তার বাবা।

৩. তৃতীয় ডব্লিউ
তৃতীয় কন্যার নাম বিপাশা। অন্য সব ভাইবোনের মতোই মেধাবী (বাবার জিন কি পেয়েছে? হা হা হা। আমাকে পছন্দ না হলেও আমার জিন কিন্তু মেয়েকে আজীবন বহন করতে হবে।)
এই মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনমিকসে অনার্স এবং এমএতে প্রথম শ্রেণী পেয়ে আমেরিকায় কী যেন পড়ছে। আমি জানি না।
আমার ধারণা, এই মেয়েটি অসম্ভব রূপবতী বলেই খানিকটা বোকা। তার বালিকা বয়সে আমি যখন বাইরে কোথাও যেতাম, সে আমার সঙ্গে একটি হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশি দিয়ে দিত। এই শিশিতে নাকি তার গায়ের গন্ধ সে ঘষে ঘষে ঢুকিয়েছে। তার গায়ের গন্ধ ছাড়া আমি ঘুমুতে পারি না বলেই এই ব্যবস্থা।
যেদিন আমি আমেরিকা রওনা হব, সেদিনই সে আমেরিকা থেকে তিন মাসের জন্য দেশে এসেছে। আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। একবার ভাবলাম, বলি—মা, অনেক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। ফিরব কি না, তা-ও জানি না। এক শিশি গায়ের গন্ধ দিয়ে দাও। বলা হলো না।
আমার তিন কন্যাই দূরদ্বীপবাসিনী। ওরা এখন আমাকে চেনে না, হয়তো আমিও তাদের চিনি না। কী আর করা? কে সারা সারা!

পাদটীকা
ফ্রম এভরি ডেপ্থ্ অব গুড অ্যান্ড ইল
দ্য মিস্ট্রি হুইচ বাইন্ডস মি স্টিল।
ফ্রম দ্য টরেন্ট অর দ্য ফাউন্টেন,
ফ্রম দ্য রেড ক্লিফ অব দ্য মাউন্টেন
মাই হার্ট টু জয় অ্যাট দ্য সেইম টোন
অ্যান্ড অল আই লাভ্ড্, আই লাভ্ড্ অ্যালোন।
(এডগার অ্যালান পো)

নিউইয়র্ক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৭, ২০১১

নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ – ০১

পূর্ণেন্দু পত্রীর একটি কবিতার শিরোনাম— ‘ক্রেমলিনের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’। আমি যেখানে আছি, সেই রেস্টহাউসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার লাইন মনে এল। ঝকঝক করছে রোদ। আকাশ ঘন নীল। জানালার পাশে অচেনা এক বৃক্ষের পাতায়ও রোদের রং লেগেছে। রোদ আমাকে কখনো অভিভূত করে না, আমি বৃষ্টিরাশির জাতক, কিন্তু আজ আকর্ষণ করল। আমি অভিভূত গলায় উচ্চারণ করলাম, নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ!
আমি ঘরে একা। পাশের ঘরে এস আই টুটুল বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে গিটার। সে ঘোষণা করেছে, আজ সারা রাত সে আমার লেখা গান গেয়ে শোনাবে। আমি বললাম, কেন?
সে বলল, আপনাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য।
আমি বললাম, গান ছাড়াই ভালো আছি। আমাকে একা থাকতে দিলেই অনেক আনন্দে থাকব।
টুটুল গত কিছুদিন ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে ডলার কামাচ্ছে। সব অনুষ্ঠানের শেষের গান নাকি হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘চান্দিপসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’। সংগত কারণেই এই গানের পর শ্রোতারা খানিকটা বিচলিত হন। শ্রোতাদের এই বিচলিত অবস্থা টুটুল উপভোগ করে। আমি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরলে টুটুল মনে হয় খানিকটা বেকায়দা অবস্থায় পড়বে। সে সবাইকে ধারণা দিয়ে দিয়েছে, নিউইয়র্কযাত্রা আমার অগস্ত্যযাত্রা।
আমার স্বভাব হচ্ছে, যেকোনো অবস্থায় যেকোনো বিষয় নিয়ে রসিকতা করা। মৃত্যু নিয়ে ক্রমাগত রসিকতা করে যাচ্ছি। এই রসিকতা কেউ সহজভাবে নিতে পারছে না।
রসিকতার নমুনা দেওয়া যেতে পারে। আমাকে বিদায় জানানোর জন্য সবাই উপস্থিত হয়েছে। চেহারা করুণ করার আপ্রাণ চেষ্টা সবার। একপর্যায়ে আমি বললাম, ভালো খাবারের ব্যবস্থা আছে, সবাই খেয়ে যাবেন। এটা আমার কুলখানির খাবার। নিজের কুলখানির খাবার নিজে উপস্থিত থেকে খাওয়ানো একটা ভাগ্যের ব্যাপার। আমি ভাগ্যবান। ক্যামেরাম্যান মাহফুজুর রহমান খান বিদায় জানাতে এসেছেন। তাঁকে বললাম, আপনার মৃত বাবার কাছে কোনো খবর পৌঁছাতে হলে আমাকে দিতে পারেন। আমি খবর দিয়ে দেব।
নিউইয়র্কে পৌঁছালাম বিকেলে। এম্বেসি থেকে আমাকে রিসিভ করতে এসেছে দেখে চমকালাম। ‘এম্বেসি মণিহার’ আমার নাহি সাজে। মুক্তধারার বিশ্বজিৎ গাড়ি নিয়ে এসেছে। নুহাশের মায়ের মামাতো বোন (জলি) থাকেন নিউইয়র্কে; তিনিও গাড়ি নিয়ে এসেছেন। আমি পড়লাম মহাবিপদে। কোন গাড়িতে চড়ব? এম্বেসি? বিশ্বজিৎ, না জলি?
আমার চিকিৎসা শুরু হবে মেমোরিয়েল স্লোয়ান কেটারিং ক্যানসার সেন্টারে। এটি নাকি পৃথিবীর এক নম্বর ক্যানসার গবেষণা ও চিকিৎসাকেন্দ্র। স্লোয়ান ও কেটারিং নামের দুই ইঞ্জিনিয়ার তাঁদের জীবনের সব সঞ্চয় দান করে এই হাসপাতাল তৈরি করেছেন। পৃথিবীর ক্যানসার রোগীদের নজর এই হাসপাতালের দিকে বলেই তিন-চার সপ্তাহের আগে ডাক্তারের কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়াই সম্ভব না।
আশ্চর্যের ব্যাপার, নিউইয়র্কে যেদিন পৌঁছালাম তার পরদিনই ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেল। ব্যবস্থা করলেন গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের স্ত্রী পূরবী দত্ত। তিনি নিজেও গল্পকার; একসময় এই ক্যানসার সেন্টারে গবেষক হিসেবে কাজ করতেন। কেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ হাসপাতালে আমার মতো অভাজনের চিকিৎসা হওয়া উচিত, তা তিনি তাদের লিখে জানালেন। পূরবী দত্ত এতটা মমতা আমার জন্য লুকিয়ে রেখেছিলেন, তা আমার জানা ছিল না। ‘অকৃতী অধম জেনেও তো তুমি কম করে কিছু দাওনি।’
আমার ডাক্তারের নাম স্টিফান আর ভেচ। দীর্ঘদেহী সুস্বাস্থ্যের বয়স্ক একজন মানুষ। খানিকটা গম্ভীর। ভুরু কুঁচকানো। তিনি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের সব কাগজপত্র পরীক্ষা করলেন। ওই হাসপাতাল থেকে মূল স্লাইড তলব করলেন। আমি একসময় বললাম, আমার ক্যানসার কোন পর্যায়ের? ডাক্তার বলেন, চতুর্থ পর্যায়ের। ক্যানসার যখন মূল কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন আমরা তাকে বলি চতুর্থ পর্যায়ের ক্যানসার।
আমি ভীত গলায় বললাম, ডাক্তার, আমি কি মারা যাচ্ছি?
ডাক্তার ভেচ নির্বিকার গলায় বললেন, হ্যাঁ।
শাওনের দিকে তাকিয়ে দেখি, সে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে। আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।
মারা গেলে করার তো কিছু নেই। কে সারা সারা!
ডাক্তার ভেচ হঠাৎই আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, তুমি একা তো মারা যাচ্ছ না। আমরা সবাই মারা যাচ্ছি। এই কারণে বললাম তুমি মারা যাচ্ছ। তবে খুব দ্রুত যে মারা যাবে, সে রকম মনে হচ্ছে না।
রোগের বাইরে ডাক্তারের সঙ্গে অনেক কথা হলো। ডাক্তার বললেন, তুমি পেশা কেন বদলেছ? ছিলে কেমিস্ট, হয়েছ লেখক।
আমি বললাম, পৃথিবীতে অনেক কেমিস্ট আছে, সে তুলনায় লেখক কম বলেই পেশা বদলেছি।
আমার ছেলেও কেমিস্ট। তার কেমিস্ট্রিতে তোমার মতো পিএইচডি ডিগ্রি আছে। লেখালেখির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তোমার কোনো বই কি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে?
আমি বললাম, হয়েছে। তবে তোমার জন্য আমি আমার নিজের ভাষা বাংলায় লেখা বই নিয়ে এসেছি। এই বইয়ে কী লেখা তুমি কিছুই বুঝবে না। তবে তুমি যদি বইটা তোমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রাখো, তাহলে আমার ভালো লাগবে। বইটার দিকে চোখ পড়লেই তোমার মনে হবে, অতি দূরদেশের বাংলা ভাষার এক লেখককে তুমি চিকিৎসা দিয়েছিলে।
ডাক্তার ভেচের হাতে বাদশাহ নামদার উপন্যাস তুলে দিলাম। তিনি বই হাতে নিয়ে বললেন, এই বই আমি আনন্দের সঙ্গে আমার লাইব্রেরিতে রেখে দেব।
শাওন একটু পরপর কেঁদে উঠছিল। ডাক্তার একসময় শাওনের পিঠে হাত রাখলেন। ভরসার এই স্পর্শ শাওনের জন্য প্রয়োজন ছিল।

পাদটীকা
একটা আলাদা স্যুটকেস ভর্তি করে আমি লেখালেখির প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম নিয়ে এসেছি। কাগজ, কলম, কাঁচি, গাম, ডিকশনারি এবং বেশ কিছু রেফারেন্স বই।
পুত্র নিষাদকে পাশে নিয়ে স্যুটকেস খুললাম। আমাদের দুজনকে চমকে দিয়ে স্যুটকেস থেকে একটা তেলাপোকা বের হলো। অসম্ভব প্রাণশক্তির এই পোকা বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। তেলাপোকাটা আমার দিকে সামান্য এগিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। তার পাগুলো শূন্যে, পাখা মেঝেতে। কিছুক্ষণ পা নেড়ে সে স্থির হয়ে গেল। দীর্ঘ ভ্রমণ চমৎকারভাবে শেষ করে সে মৃত। আমি নিষাদকে বললাম, বাবা, দেখো, বেচারা মারা গেছে।
নিষাদ বলল, তেলাপোকাকে বেচারা বলতে হয় না। মানুষকে বেচারা বলতে হয়। তুমি যখন মারা যাবে, তখন বলবে বেচারা।
তেলাপোকার মৃত্যু এবং পুত্রের কথায় প্রতীকী কিছু কি আছে?

নিউইয়র্ক থেকে | তারিখ: ২৬-১০-২০১১
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো।

নো ফ্রি লাঞ্চ

‘নো ফ্রি লাঞ্চ’—একটি আমেরিকান বাক্য। এই বাক্যটা বলে তারা এক ধরনের শ্লাঘা অনুভব করে। তারা সবাইকে জানাতে পছন্দ করে যে তারা কাজের বিনিময়ে খাদ্যে বিশ্বাসী।
এই ধরনের বাক্য বাংলা ভাষাতেও আছে—‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’। গায়ে তেল মাখতে হলে কড়ি ফেলতে হবে। আরামের বিনিময়মূল্য লাগবে। যা-ই হোক, ফ্রি লাঞ্চে ফিরে যাই। নো ফ্রি লাঞ্চের দেশে চিকিৎসা করতে ব্যাগ ভর্তি ডলার নিয়ে যেতে হবে, এই তথ্য আমি জানি। তবে বিকল্প ব্যবস্থাও আছে। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা বলে যেকোনো হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যেতে হবে। বুকে ব্যথা মানে হার্ট অ্যাটাক। হাসপাতাল হেলথ ইনস্যুরেন্স আছে কি নেই তা না দেখেই রোগী ভর্তি করবে। চিকিৎসা শুরু হবে। চিকিৎসার একপর্যায়ে ধরা পড়বে রোগীর হয়েছে ক্যানসার। হাসপাতাল তখন ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু করবে। রোগীকে ধাক্কা দিয়ে হাসপাতালের ফুটপাতে ফেলে দেবে না। চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর বলতে হবে, আমি কপর্দকশূন্য। এক মিলিয়ন ডলার বিল আমি দেব, তবে একসঙ্গে দিতে পারব না। ভেঙে ভেঙে দেব। প্রতি মাসে পাঁচ ডলার করে। এই প্রস্তাবে রাজি হওয়া ছাড়া হাসপাতালের তখন আর করার কিছু থাকে না। বাংলাদেশিদের কাছে এই বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থা সংগত কারণেই বেশ জনপ্রিয়।
বাঙালি ব্যবস্থায় আমি চিকিৎসা শুরু করব, এই প্রশ্নই ওঠে না। সমস্যা হচ্ছে, বিপুল অঙ্কের অর্থও তো আমার নেই।
আমার দুটো গাড়ি। দুটোই বিক্রির জন্য পাঠানো হলো। একটা বিক্রি হলো। দখিন হাওয়ার যে ফ্ল্যাটে থাকি, সেটা বিক্রির চেষ্টা করলাম। পারলাম না, ফ্ল্যাটবাড়ি নিয়ে কিছু আইনগত জটিলতা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে উত্তরায় পাঁচ কাঠার একটা জমি পেয়েছিলাম। সেই জমি বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিলাম। লাভ হলো না। বাকি থাকল নুহাশ পল্লী। অর্থ সংগ্রহের ছোটাছুটির একপর্যায়ে অন্যপ্রকাশের মাজহার বলল, আপনি কেন অস্থির হচ্ছেন? আমি তো আপনার সঙ্গে যাচ্ছি। আপনার চিকিৎসার অর্থ কীভাবে আসবে, কোত্থেকে আসবে তা দেখার দায়িত্ব আমার। আপনার না।
আমি বললাম, টাকা কীভাবে জোগাড় করবে? ভিক্ষাবৃত্তি? চাঁদা তুলবে?
মাজহার বলল, না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, কারও কাছ থেকে এক ডলার সাহায্য নেব না। এই মুহূর্তে আমার হাতে ৫০ হাজার আমেরিকান ডলার আছে।
আমি বললাম, দেখাও।
মাজহার বলল, দেখাতে পারব না। ৫০ হাজার ডলার নিউইয়র্কে আপনার জন্য আলাদা করা। চ্যানেল আইয়ের সাগর ভাই আপনার জন্য আলাদা করে রেখেছেন। সাহায্য না, ঋণ। পরে শোধ দেবেন।
আমি খানিকটা ভরসা পেলাম। চ্যানেল আইয়ের সাগরের অনেক বদভ্যাসের (!) একটি হলো শিল্প-সাহিত্যের কেউ বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া। এই কাজ অতীতেও সে অনেকবার করেছে। এখনো করছে। ভবিষ্যতেও করবে কি না জানি না। ইতিমধ্যে তার উচিত শিক্ষা হয়ে যাওয়ার কথা।
আমেরিকায় অর্থ ব্যয়ের একটি নমুনা দেওয়া যেতে পারে। হিসাবটা বাংলাদেশি টাকায় দিই।
স্লোয়ান কেটারিং মেমোরিয়ালের ডাক্তাররা আমার কাগজপত্র দেখবেন। রোগ নিয়ে কথাবার্তা বলবেন। শুধু এই জন্য তিন লাখ টাকা জমা দিতে হলো।
ডাক্তার শরীরে মেডিপোর্ট বসানোর জন্য Radio ল্যাবে পাঠালেন। (মেডিপোর্টের মাধ্যমে কেমোথেরাপি শুরু হবে) মেডিপোর্ট বসানোর খরচ হিসেবে জমা দিতে হলো আট লাখ টাকা।
মেডিপোর্ট বসানোর পরদিন কেমো শুরু হবে। আটটি কেমোর পুরো খরচ একসঙ্গে দিতে হবে। টাকার পরিমাণ এক কোটি টাকা। ভাগে ভাগে দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।
শাওন ও মাজহার দুজনেরই দেখি মুখ শুকনো। নিশ্চয়ই কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। যেহেতু তারা আমাকে বলেছে, টাকা-পয়সার বিষয় নিয়ে আমি যেন চিন্তা না করি, আমি তাই চিন্তা করছি না।
কেমোথেরাপি দিতে এসেছি। কেমোথেরাপির ডাক পড়বে, ভেতরে যাব। ডাক পড়ছে না। একা বসে আছি। শাওন আমার সঙ্গে নেই। সে মাজহারের সঙ্গে ছোটাছুটি করছে। শাওন চোখ লাল করে কিছুক্ষণ পরপর আসছে, আবার চলে যাচ্ছে।
একটা পর্যায়ে শাওন ও মাজহার দুজনকে ডেকে বললাম, ‘মার্ফিস ল’ বলে একটি অদ্ভুত আইন আছে। মার্ফিস ল বলে—If any thing can go wrong, it will go wrong. আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা বলো। টাকা কম পড়েছে?
মাজহার বলল, হ্যাঁ। চ্যানেল আইয়ের টাকাটা এই মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালে আমরা অর্ধেক, অর্থাৎ ৫০ লাখ টাকা দিতে চাই, ওরা নেবে না। হাসপাতাল বলছে, পুরো টাকা নিয়ে আসো, তারপর চিকিৎসা শুরু হবে। আমি বললাম, চলো, ফিরে যাই। টাকা জোগাড় করে চিকিৎসার জন্য আসব।
শাওন বলল, তোমার চিকিৎসা আজই শুরু হবে। কীভাবে হবে আমি জানি না, কিন্তু আজই হবে।
শাওন বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করল। আমি বললাম, তুমি সবার সামনে কাঁদছ। বাথরুমে যাও। বাথরুমে দরজা বন্ধ করে কাঁদো।
সে আমার সামনে থেকে উঠে বাথরুমে ঢুকে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার ডাক পড়ল, কেমোথেরাপি শুরু হবে। টাকা বাকি থাকতেই শুরু হবে।
সমস্যার সমাধান করলেন পূরবী দত্ত। তিনি হাসপাতালকে বোঝাতে সমর্থ হলেন যে হুমায়ূন আহমেদ নামের মানুষটি চিকিৎসা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মানুষ না। তিনি অবশ্যই প্রতিটি পাই-পয়সা শোধ করবেন।
হাসপাতাল চিকিৎসার পুরো টাকা শুরুতেই কেন নিয়ে নেয় তা ব্যাখ্যা করি। অনেক রোগী একটি কেমোর টাকা জোগাড় করে কেমো নিয়ে হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়। সে বলে, আমার আর টাকা নেই বলে কেমো নিতে পারছি না। আমার চিকিৎসা অসম্পূর্ণ। আমেরিকান হাসপাতাল চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রাখতে পারে না।

পাদটীকা
সর্বাধুনিক, বিশ্বমানের একটি ক্যানসার হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্র কি বাংলাদেশে হওয়া সম্ভব না? অতি বিত্তবান মানুষের অভাব তো বাংলাদেশে নেই। তাঁদের মধ্যে কেউ কেন স্লোয়ান বা কেটারিং হবেন না? বিত্তবানদের মনে রাখা উচিত, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যাংকে জমা রেখে তাঁদের একদিন শূন্য হাতেই চলে যেতে হবে। বাংলাদেশের কেউ তাঁদের নামও উচ্চারণ করবে না। অন্যদিকে আমেরিকার দুই ইঞ্জিনিয়ার স্লোয়ান ও কেটারিংয়ের নাম তাঁদের মৃত্যুর অনেক পরেও আদর-ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সমস্ত পৃথিবীতে স্মরণ করা হয়।
আমি কেন জানি আমেরিকায় আসার পর থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, হতদরিদ্র বাংলাদেশ হবে এশিয়ায় ক্যানসার চিকিৎসার পীঠস্থান।
যদি বেঁচে দেশে ফিরি, আমি এই চেষ্টা শুরু করব। আমি হাত পাতব সাধারণ মানুষের কাছে।

হুমায়ূন আহমেদ, নিউইয়র্ক থেকে
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০২, ২০১১

বন্ধুবিদায়

৩৭ বছরের পুরোনো বন্ধু, সুখ ও দুঃখদিনের সঙ্গীকে বিদায় জানিয়েছি। আমাদের বন্ধুত্বকে কেউ সহজভাবে নেয়নি। পারিবারিকভাবে তাকে কুৎসিত অপমান করা হয়েছে। তার পরও বন্ধু আমাকে ছেড়ে যায়নি। আমেরিকায় এসে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে হলো। হায় রে আমেরিকা! বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন, আমি সিগারেট-বন্ধুর কথা বলছি। ৩৭ বছরের সম্পর্ক এক কথায় কীভাবে বাতিল হলো, তা বলার আগে জীবনের প্রথম সিগারেট টানার গল্পটা করা যেতে পারে।
চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমাদের বাসা স্কুলের পাশেই, নালাপাড়ায়। একদিন স্কুলে যাওয়ার সময় লক্ষ করলাম, বাবা তাঁর সিগারেটের প্যাকেট ভুলে ফেলে গেছেন। প্যাকেটে তিনটা সিগারেট। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে প্যাকেটটি প্যান্টের পকেটে ভরে ফেললাম। রান্নাঘর থেকে দেশলাই নিলাম। স্কুলে গেলাম উত্তেজিত অবস্থায়। ভয়ংকর কোনো নিষিদ্ধ কাজ করার আনন্দে তখন শরীর কাঁপছে।
আমি সিগারেট ধরালাম স্কুলের বাথরুমে। সেটা কখন—ক্লাস চলার সময়ে, নাকি টিফিন পিরিয়ডে—তা মনে করতে পারছি না। সস্তা স্টার সিগারেটের (এর চেয়ে দামি সিগারেট কেনার সামর্থ্য বাবার ছিল না) কঠিন ধোঁয়ায় বালকের কচি ফুসফুস আক্রান্ত হলো। আমি বিকট শব্দে কাশছি। হঠাৎ বাথরুমের দরজা খুলে গেল। বাথরুমের দরজা উত্তেজনার কারণেই বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। স্যারদের বাথরুম ছাত্রদের বাথরুমের সঙ্গেই। বাইরে থেকে তালা লাগানো থাকে। স্যাররা চাবি নিয়ে আসেন। বড়ুয়া স্যার কুক্ষণে এসে আসামির কানে ধরে হেডস্যারের রুমে নিয়ে গেলেন।
হেডস্যার অবাক হয়ে বললেন, তুই এই বয়সে সিগারেটের প্যাকেট পকেটে নিয়ে ঘুরিস? তোকে স্কুল থেকে টিসি দেব। কাল তোর বাবাকে নিয়ে আসবি।
আমি বললাম, জি, আচ্ছা।
হেডস্যার বললেন, তোর বাবাকে আনার দরকার নেই। তোকে আজই টিসি দিয়ে দিচ্ছি। যন্ত্রণা পুষে লাভ নেই।
বড়ুয়া স্যার (আমাদের ক্লাসটিচার। অতি বিচিত্র কারণে তাঁর ক্লাসের প্রতিটি ছাত্রকে সন্তানের অধিক স্নেহ করতেন।) বললেন, থাক, মাফ করে দেন। ছেলের বাবা এই ঘটনা জানলে ছেলেকে মারধর করবেন। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। এমন শাস্তি দেব, জীবনে সিগারেট ধরবে না। প্রয়োজনে জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে সারা গায়ে ছ্যাঁকা দিব।
বড়ুয়া স্যার কঠিন শাস্তিই দিলেন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বাবা রে, বিড়ি-সিগারেট খুব খারাপ জিনিস। আর কোনো দিন খাবি না।
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, খাব না, স্যার। কোনো দিন খাব না।
বড়ুয়া স্যার আরও একবার আমার মহাবিপদে আমাকে উদ্ধার করতে অনেক দেনদরবার করেছিলেন। কাঠপেন্সিল-এর কোনো লেখায় বিস্তারিত বলেছি। আবারও বলি।
আমি ছিলাম মহা দুষ্টু। পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কহীন এক বালক। কাজেই ক্লাস সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষায় আমি একা ফেল করলাম। তখনকার স্কুলের নিয়মে ক্লাস সিক্স থেকে সব ছেলে নতুন ক্লাসে গেল। আমি একা বসে রইলাম। ক্লাসে আমি আর বড়ুয়া স্যার। ফেল করার সংবাদ বাসায় কীভাবে দেব, এই আতঙ্কে অস্থির হয়ে কাঁদছি। বাবা কিছু বলবেন না আমি জানি। তিনি তাঁর সমগ্র জীবনে তাঁর পুত্র-কন্যাদের গায়ে হাত তোলা দূরে থাকুক, ধমকও দেননি। কিন্তু মা অন্য জিনিস। তিনি মেরে তক্তা বানিয়ে দেবেন।
বড়ুয়া স্যার কিছুক্ষণ আমার কান্না দেখে বললেন, আয় আমার সঙ্গে। হেডস্যারকে বলে-কয়ে দেখি বিশেষ বিবেচনায় কিছু করা যায় কি না।
হেডস্যার বড়ুয়া স্যারের ওপর অত্যন্ত রাগ করলেন। তিনি কঠিন গলায় বললেন, যে ছেলে ড্রয়িং ছাড়া প্রতিটি বিষয়ে ফেল করেছে, আপনি তার জন্য সুপারিশ করতে এসেছেন? এই ছেলেকে আমি তো স্কুলেই রাখব না।
বড়ুয়া স্যার বললেন, স্যার, এই ছেলেটাকে পাস করিয়ে দিন। আমি আর কোনো দিন আপনার কাছে কোনো সুপারিশ নিয়ে আসব না।
বিশেষ বিবেচনায় হেডস্যার আমাকে ক্লাস সেভেনে প্রমোশন দিলেন।
পুরোনো দিনের কথা থাকুক, এখনকার কথা বলি।
স্লোয়ান কেটারিংয়ের ডাক্তাররা জানতে চাইলেন, আমি সিগারেট খাই কি না।
আমি লজ্জিত মুখে বললাম, হ্যাঁ।
দিনে কয়টা?
আমি মিনমিন করে বললাম, ত্রিশটা।
সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথের আমার হার্টের চিকিৎসক ফিলিপকো আমি এখনো ত্রিশটা সিগারেট দিনে খাই শুনে এমনভাবে তাকিয়েছিলেন যেন আমি মানুষ না, জন্তুবিশেষ।
ঢাকায় আমার বন্ধু এবং হার্টের চিকিৎসক ডা. বরেন আমার সিগারেট খাওয়ার পরিমাণ শুনে আনন্দিত গলায় বলেছিলেন, হুমায়ূন ভাই, আপনি তো মারা যাবেন! (ডা. বরেন কারও আগাম মৃত্যুসংবাদ কেন জানি খুব আনন্দের সঙ্গে দেন।)
স্লোয়ান কেটারিংয়ের ডাক্তার আমার সিগারেট খাওয়া নিয়ে কিছুই বললেন না। আমি খানিকটা কনফিউজড হয়ে গেলাম। তবে কেমোথেরাপি শুরুর আগের দিন আমাকে হাসপাতালে ডাকা হলো। তারা বলল, আমার চামড়া কেটে তার ভেতর একটি নিকোটিন রিলিজিং যন্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। শরীর যখন নিকোটিনের জন্য কাতর হবে, তখন যন্ত্র নিকোটিন রিলিজ করবে। খুব ধীরে ধীরে নিকোটিনের পরিমাণ যন্ত্র কমাবে।
আমি বললাম, শরীরের ভেতর আমি যন্ত্র ঢোকাব না। সিগারেট ছেড়ে দিলাম।
তারা বলল, যে দিনে ত্রিশটা সিগারেট খায়, সে সিগারেট ছাড়তে পারবে না।
আমি বললাম, পারব।
আশ্চর্যের ব্যাপার, পেরেছি।
আমাদের বাড়ির সামনে একটি ডেইলি গ্রোসারি শপ আছে। সেখানে চা-কফি পাওয়া যায়। যখন কাউকে দেখি কফির মগ নিয়ে বাইরে এসে সিগারেট ধরিয়ে টানছে, তখন এত ভালো লাগে! মনে হয়, তারা কী সুখেই না আছে!
যারা সিগারেট ছেড়ে দেয়, তারা অতি দ্রুত সিগারেটবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। যেমন আমার বন্ধু প্রতীক প্রকাশনার মালিক, একসময়ের গল্পকার আলমগীর রহমান। সে একসময় দিনে দুই প্যাকেট সিগারেট খেত। সিগারেট ছাড়ার পর আমাদের দিকে এমনভাবে তাকায়, যেন আমরা সিগারেট না, কাগজে মুড়ে গুয়ের পুরিয়া খাচ্ছি।
আমার ক্ষেত্রে কখনো এ রকম হবে না। পরিচিত কাউকে সিগারেট খেতে দেখলে আমি তার পিঠে হাত রেখে বলব, আরাম করে খাও! আমি দেখি।
সিগারেট প্রসঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা গল্প বলি। একবার নিউইয়র্কে তাঁর সঙ্গে এক হোটেলে উঠেছি (প্যান অ্যাম হোটেল)। দেখি, তিনি সিগারেট খাচ্ছেন না, চুরুট টানছেন। আমি বললাম, সিগারেট বাদ দিয়ে চুরুট কেন?
উনি বিরক্ত গলায় কী একটা মহিলা কলেজের নাম করে বললেন, ছাত্রীরা এই সমস্যা করেছে। সভার মাঝখানে দল বেঁধে মঞ্চে এসে বলেছে, ‘আপনাকে সিগারেট ছাড়তে হবে। মঞ্চেই কথা দিতে হবে।’ আমি বাধ্য হয়ে সিগারেট ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে চুরুট ধরেছি।

আরও কিছুদিন অতিরিক্ত বেঁচে থাকার জন্য মানুষ অনেক কিছু ত্যাগ করে। মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ কী? গলিত স্থবির ব্যাঙও নাকি দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে। অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।
আমি কখনো অতিরিক্ত কিছুদিন বাঁচার জন্য সিগারেটের আনন্দ ছাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমি ভেবে রেখেছিলাম ডাক্তারকে বলব, আমি একজন লেখক। নিকোটিনের বিষে আমার শরীরের প্রতিটি কোষ অভ্যস্ত। তোমরা আমার চিকিৎসা করো, কিন্তু আমি সিগারেট ছাড়ব না।
তাহলে কেন ছাড়লাম?
পুত্র নিনিত হামাগুড়ি থেকে হাঁটা শিখেছে। বিষয়টা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি। দু-এক পা হেঁটেই ধুম করে পড়ে যায়। ব্যথা পেয়ে কাঁদে।
একদিন বসে আছি। টিভিতে খবর দেখছি। হঠাৎ চোখ গেল নিনিতের দিকে। সে হামাগুড়ি পজিশন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার ছোট্ট শরীর টলমল করছে। যেকোনো সময় পড়ে যাবে এমন অবস্থা। আমি ডান হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে হাঁটা বাদ দিয়ে দৌড়ে হাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্বজয়ের ভঙ্গিতে হাসল। তখনই মনে হলো, এই ছেলেটির সঙ্গে আরও কিছুদিন আমার থাকা উচিত। সিগারেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত সেই মুহূর্তেই নিয়ে নিলাম।

পাদটীকা
আমেরিকার মহান লেখক মার্ক টোয়েন বলেছেন, অনেকেই বলে সিগারেট ছাড়া কঠিন ব্যাপার। আমি তাদের কথা শুনেই অবাক হই। সিগারেট ছাড়া কঠিন কিছুই না। আমি ১৫৭ বার সিগারেট ছেড়েছি।

নিউইয়র্ক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৩, ২০১১

বালিশ

আমার জন্ম-জেলা নেত্রকোনায় ‘বালিশ’ নামের একধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়। আকৃতি বালিশের মতোই। এক বালিশ সাত-আটজনে মিলে খেতে হয়।
নেত্রকোনা শহরের এক মিষ্টির দোকানে বসে আছি। ময়রা থালায় করে বালিশ এনে আমার সামনে রাখল। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, একটু মুখে দেন, স্যার।
আমি বললাম, যে মিষ্টির নাম বালিশ, সেই মিষ্টি আমি খাই না। আমি লেখক মানুষ। আমার মধ্যে রুচিবোধ আছে।
ময়রা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, স্যার, আপনি একটা নাম দিয়ে দেন। আমার দোকানে এর পর থেকে আমি বালিশ মিষ্টি এই নামে ডাকব।
পুত্র-কন্যার নাম রাখার জন্য, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম রাখার জন্য কেউ কেউ আমার কাছে আসে। এই প্রথম মিষ্টির নাম। আমি মাথা ঘামাচ্ছি সুন্দর কোনো নাম যদি পাওয়া যায়।
ভারতবর্ষের ভাইসরয়ের স্ত্রী লেডি কেনিংয়ের সম্মানে একটি মিষ্টি বানানো হয়েছিল, নাম ‘লেডিকেনি’। লেডি কেনিং চলে গেছেন, কিন্তু লেডিকেনি ময়রাদের দোকানে রয়ে গেছে।
আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে বললাম, মিষ্টির নাম রাখুন ‘বালক-পছন্দ’। বালকেরা মিষ্টির সাইজ দেখে খুশি হয় বলেই এই নাম।
ময়রা বলল, স্যার, নাম রাখলাম। এরপর কেউ আমার দোকানে বালিশ পাবে না। পাবে বালক-পছন্দ।
নেত্রকোনায় অনেক দিন যাই না, আসলেই এই নাম রাখা হয়েছে কি না, তা জানি না। মনে হয় না। রাজনৈতিক নাম বদলানো সহজ, স্থায়ী নাম বদলানো কঠিন ব্যাপার। কোনো মিষ্টির নাম যদি থাকত ‘বঙ্গবন্ধু-পছন্দ’, তাহলে ক্ষমতা বদলের পরপর তার নাম হতো ‘জিয়া-পছন্দ’। এটা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতাম না। কারণ, এটাই স্বাভাবিক।
হঠাৎ বালিশ নিয়ে এত কথা বলছি কেন?
কারণ আছে। গত তিন দিনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। ঘুম ভাঙার পরপরই আমার মাথার নিচ থেকে শাওন বালিশ টেনে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাচ্ছে। রহস্যময় কর্মকাণ্ড। তবে মিসির আলির পক্ষে রহস্য ভেদ করা কঠিন কিছু না। আমি রহস্য ভেদ করলাম।
কেমোথেরাপির কারণে আমার মাথার সব চুল পড়ে যাচ্ছে। বালিশভর্তি চুল। শাওন আমাকে এই দৃশ্য দেখাতে চাচ্ছে না। শুনেছিলাম, আধুনিক কেমোর উন্নতি হয়েছে। এখন আর চুল পড়ে না। ঘটনা তা না। যা-ই হোক, মাথার চুল নিয়ে আমি চিন্তিত না। আমি চিন্তিত নতুন এক রিয়েলিটিতে ঢুকছি। আমার পিঠে সিল পড়েছে—‘তুমি ক্যানসার নামের ব্যাধির চিকিৎসা নিচ্ছ’। কারও যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরু হলে কেউ বুঝে না তার কী রোগ হয়েছে বা কী চিকিৎসা চলছে। ব্যতিক্রম ক্যানসারের কেমো। সে শরীরের ভেতরে এবং বাইরে দুই জায়গাতেই নিজেকে জানান দেবে।
চুল পড়ার ঘটনা কেন ঘটে, একটু বলে নিই। শরীরে যখন কেমোথেরাপিতে ভয়ংকর বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, সেই বিষ খুঁজে বেড়ায় সেই সব কোষকে, যা দ্রুত বিভাজনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ক্যানসার সেল দ্রুত বিভাজন সেল। কাজেই কেমো তাদের আক্রমণ করে। একই সঙ্গে চুলের গোড়ার কোষ এবং মুখের ভেতরের কোষও দ্রুত বিভাজমান কোষ। কোনো অন্যায় না করেও এরা মারা পড়ে। চুল পড়ে যায়, মুখের ভেতর ঘায়ের মতো হয়।
আমার মুখগহ্বর এখনো ঠিক আছে, তবে চুল পড়ছে। শাওন বাজারে গেলেই এখন টুপি কিনে আনে। নানান ধরনের টুপি পরে আয়নার সামনে দাঁড়াই। নিজেকে অন্য রকম লাগে। অন্য কোনো বাস্তবতায় চলে যাই।
ইতালির মোনজা শহরে আইন করা হয়েছে, যেন কেউ গোলাকার কাচপাত্রে গোল্ডফিশ রাখতে না পারে। আইন প্রণেতারা ভাবছেন, গোলাকার কাচপাত্রে বাস করার কারণে গোল্ডফিশগুলোর দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে। পৃথিবী সম্পর্কে তারা ভুল ধারণা পাচ্ছে।
মজার ব্যাপার হলো, আমরা মানুষও প্রবল বিভ্রমে বাস করি। আমাদের সবার বাস্তবতাই আলাদা। মানুষ হিসেবে আমরা আলাদা। আমাদের রিয়েলিটিও আলাদা।
এখন নিউইয়র্কে রাত আটটা। আমি কাগজ-কলম নিয়ে বসে আছি। বাংলাদেশে দিনে লিখতাম, এখন লিখছি রাতে। ভিন্ন বাস্তবতা না?
যা-ই হোক, এই মুহূর্তে আমার মন ভালো, জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির একগাদা বই টরন্টো থেকে সুমন রহমান মেইল করে পাঠিয়েছে। কিছুদিন হলো এই লেখকের বই আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। কেন পড়ছি, তা পরে একসময় বিতং করে জানাব।
খোদ জাপানি ভাষায় আমার একটি বই প্রকাশিত হচ্ছে। বই নিয়ে জাপান থেকে ড. নাসির জমাদার (তিনি বইটির অনুবাদক) নিউইয়র্কে আসছেন। এই খবরটিতেও আনন্দ পাচ্ছি। বইটির বাংলা নাম বনের রাজা। বাচ্চাদের একটি বই। শুভ্রকে নিয়ে লেখা কোনো বই জাপানি ভাষায় প্রকাশিত হলে হারুকি মুরাকামিকে পাঠিয়ে দিয়ে লিখতাম…। না থাক, কী লিখতাম, তা সবাইকে না জানালেও চলবে।
টরন্টোর সুমন বইগুলোর সঙ্গে এক লাইনের একটি চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে লেখা—‘দ্রুত সুস্থ হয়ে পাঠকদের উৎকণ্ঠা দূর করুন’।
ভাই, সুমন। কোনো কিছুই আমার হাতে নেই। নিয়ন্ত্রণ অন্য কারোর কাছে।

পাদটীকা
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের দুটি ছেলে নিতান্ত অল্প বয়সে হোয়াইট হাউসে মারা যায়। আব্রাহাম লিংকন তারপর হতাশ হয়ে লিখলেন, গডের সৃষ্টি কোনো জিনিসকে বেশি ভালোবাসতে নেই। কারণ, তিনি কখন তাঁর সৃষ্টি মুছে ফেলবেন, তা তিনি জানেন। আমরা জানি না।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৭, ২০১১

ব্ল্যাক ফ্রাইডে

শুক্রবার মুসলমানদের জন্য পবিত্র একটি দিন। খ্রিষ্টানদের রোববার, ইহুদিদের শনিবার। সপ্তাহের তিন দিন, তিন ধর্মাবলম্বীরা নিয়ে বসে আছে।
শুক্রবার মুসলমানদের পবিত্র দিন বলেই কি আমেরিকানরা ‘কালো শুক্রবার’ আবিষ্কার করল? থ্যাংকস গিভিংয়ের রাত থেকেই শুরু এই কালো শুক্রবার। একটি দিনের জন্য কম দামে জিনিসপত্র বিক্রির মহোৎসব। ৪০ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন, যার দাম এক হাজার ডলার, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, কালো শুক্রবারে তা বিক্রি হয় ২০০ ডলারে। আমেরিকানরা বড় বড় দোকানের সামনে প্রচণ্ড শীত অগ্রাহ্য করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। কখন রাত ১০টা বাজবে, কখন শুরু হবে কালো শুক্রবার?
গত বছরের কালো শুক্রবারে দোকানে ঢোকার ধাক্কাধাক্কিতেই নাকি মারা গেছে পাঁচজন। ‘সেল’ শুনলেই আমেরিকানদের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। জীবন বাজি রেখে হলেও ‘সেলে’ জিনিস কিনতে হবে। সেই জিনিস কাজে লাগুক বা না লাগুক। আমেরিকা পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে অকারণ শপিং করে দেউলিয়া হওয়া যায়। ব্যাংক বাড়িঘর নিয়ে নেয়। এমনও হয়, গৃহত্যাগীরা পথে হাঁটাহাঁটি শুরু করে। টিভির খবরে দেখলাম, এই ব্ল্যাক ফ্রাইডেতে সারা আমেরিকায় ৫৫ বিলিয়ন ডলারের জিনিসপত্র বিক্রি হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে এ বছরের বাংলাদেশের বাজেটের দ্বিগুণ এক ব্ল্যাক ফ্রাইডের বিক্রি।
এ বছরের কালো শুক্রবারটা আমার দেখার শখ ছিল। শরীরে কুলোয়নি বলে যাওয়া হয়নি। একটি লাভ অবশ্যি হয়েছে, টেলিফোনে আমার এক প্রিয় কবির সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁর প্রথম কথা, ‘হুমায়ূন! তোমার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি কেন?’
কবির কণ্ঠস্বর তেজি। গলা শুনে বোঝার উপায় নেই, উনি শারীরিকভাবে অচল হয়ে গেছেন। খুব মন খারাপ হলো যখন উনি বললেন, হুমায়ূন! আমার জীবন হুইলচেয়ারে আটকে গেছে।

আমি এক মিনিটের বেশি হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে পারি না। আমার কিডনি নষ্ট। ছয় বছর বেঁচে আছি ডায়ালাইসিসের ওপর। ডায়ালাইসিস নিয়ে পাঁচ বছরের বেশি কেউ বাঁচে না। আমি এক বছর বেশি বেঁচে আছি। সেটাই বা খারাপ কী? হুমায়ূন! বয়সে আমি বড় বলে তোমাকে তুমি করে বলছি। সমস্যা আছে?
আমি বললাম, আপনার ক্ষেত্রে নেই।
কবির নাম শহীদ কাদরী।
‘রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে স্বাধীনতা দিবসের
সাঁজোয়া বাহিনী,
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে রেসকোর্সের কাঁটাতার,
কারফিউ, ১৪৪ ধারা,
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে ধাবমান খাকি
জিপের পেছনে মন্ত্রীর কালো গাড়ি,
কাঠগড়া গরাদের সারি সারি খোপ
কাতারে কাতারে রাজবন্দী’
(রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট; শহীদ কাদরী)
আমি কবিকে বললাম, আপনার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি, কিন্তু আপনার অনেক গল্প আমি জানি।
কবি বললেন, কী গল্প জানো?
আমি বললাম, আপনি একদিন দুর্বল এক কবির বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছেন। দুর্বল কবির বিশাল বাড়ি দেখে বিস্মিত হয়ে হিন্দিতে বললেন, ‘এতনা ছোটা কবি কা এতনা বড় মোকাম!’
কবি হো হো করে হেসে ফেলে বললেন, হুমায়ূন, একদিনের কথা বলি। আমি শামসুর রাহমানকে নিয়ে বের হয়েছি। কারও পকেটেই টাকা-পয়সা নেই। রাস্তার পাশের দোকান থেকে দুই কাপ চা কিনে চুমুক দিচ্ছি, হঠাৎ দেখি, কালো মরিস মাইনর গাড়িতে করে বিখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী যাচ্ছেন। শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘দেখো, আমরা দুই প্রধান কবি রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছি, রিকশায় ওঠার সামর্থ্যও নেই, আর একজন ফোক সিঙ্গার গাড়িতে চড়ে ঘুরছে। কোনো মানে হয়?’
আসাদুজ্জামান নূর এই কবির সঙ্গে চাকরি করতেন। মনে হয় সোভিয়েত দূতাবাসের তথ্যকেন্দ্রে চাকরি। শহীদ কাদরী ছিলেন নূরের বস। নূরের কাছে শুনেছি, একদিন কবি অফিসে এসে ফাইলপত্র ছুড়ে ফেলে বললেন, হিন্দি চুলের চাকরি শহীদ কাদরী করে না। বলেই যে বের হলেন, আর কোনো দিন অফিসে ফিরলেন না।
এই মুহূর্তে দেশের একজন প্রধান কবি পড়ে আছেন নিউইয়র্কের জ্যামাইকায়। কোনো মানে হয়? তিনি কি তাঁর দেশের অপূর্ব জোছনা দেখবেন না? তাঁর গায়ে কি বর্ষার প্রথম জলধারা পড়বে না? তিনি কি আর কোনো দিনও হাতে নেবেন না বাংলাদেশের বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল?

‘ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করব যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে তোমাকে প্রিয়তমা!
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করব
কত বাঙ্কার ডিঙিয়ে
কাঁটাতার, ব্যারিকেড পার হয়ে অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মিদের কারগুলি এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা’
(তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা; শহীদ কাদরী।)

কবি! আপনাকে অভিবাদন!

পাদটীকা
হুমায়ূন! আমি নাস্তিক মানুষ। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে প্রার্থনায় বিশ্বাস করা শুরু করেছি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমেরিকার সব হাসপাতালে রোগীদের জন্য প্রার্থনার ব্যবস্থা আছে। স্ট্যাটিসটিকসে দেখা গেছে, যাদের জন্য প্রার্থনা করা হয়, তারা দ্রুত আরোগ্য লাভ করে।
আমি আমার স্ত্রীকে আপনার জন্য প্রার্থনা করতে বলেছি।
শহীদ কাদরী
ব্ল্যাক ফ্রাইডে ২০১১
জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক
পুনশ্চ
দুর্বল কবি এবং ফোক সিঙ্গারের নাম আমার লেখায় ছিল। শহীদ কাদরীর অনুরোধে দুটি নাম বাদ রাখলাম। পাঠকদের কাছে ধাঁধা—নাম দুটি কী? সঠিক উত্তরদাতার কাছে প্রথম আলোর এক কপি ডাকযোগে পৌঁছে যাবে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০১১

মাঠরঙ্গ

গুপ্তধন পাওয়ার মতো ব্যাপার ঘটেছে। আমার হাতে বিশ্বকাপের দুটো টিকিট। বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ডের খেলা মাঠে বসে দেখতে পারব। টিকিট দুটি এমপি হিসেবে শাওনের মা পেয়েছেন। তাঁর হাত থেকে ছিনতাই করে নিয়ে নিয়েছে তাঁর ছোট দুই মেয়ে। শাওন দুই বোনের হাত থেকে গোপনে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। চোরের ওপর বাটপারি একেই বলে।
আড়াইটার সময় খেলা শুরু হবে, আমরা সাড়ে ১২টার সময় ঘর থেকে বের হলাম। স্টেডিয়ামে ঢুকতে হলে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে, নিরাপত্তা চেকিং, আগেভাগে যাওয়াই ভালো।
স্টেডিয়ামে ঢোকার পথের রাস্তায় কোনো যানবাহন চলছে না। শত শত মানুষ হাঁটাহাঁটি করছে। এদের হাতে টিকিট নেই। যেখানে খেলা হবে, তার আশপাশেই থাকতে পারার আনন্দেই তারা অভিভূত।
রাস্তায় প্রচুর তরুণ-তরুণীকে দেখা গেল রংতুলি নিয়ে ঘুরছে। ক্রিকেটপ্রেমীদের মুখে বাংলাদেশ পতাকা আঁকছে। অতি উৎসাহীরা তাদের সারা মুখে হলুদ-কালো আঁকিবুঁকিতে বাঘ সাজছে। শাওন তার গালে বাংলাদেশের পতাকা আঁকাল। আমি তাকে বললাম, আমার বাঘ সাজার শখ! তোমার কি আপত্তি আছে?
শাওন বলল, আপত্তি থাকবে কেন? তোমার যা সাজার ইচ্ছা সাজ।
শেষ মুহূর্তে বাঘ সাজার পরিকল্পনা বাদ দিলাম। বৃদ্ধ বাঘ সেজে মাঠে ঢোকার মানে হয় না। মাঠে ঢুকবে তরুণ বাঘ এবং বাঘিনীরা।
প্রথম পর্যায়ের নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে আমি ধরা খেলাম। পকেটের সিগারেটের প্যাকেট-ম্যাচ ফেলে দিতে হলো। দ্বিতীয় পর্যায়ের নিরাপত্তা চেকিংয়ে শাওন ধরা খেল। তার হ্যান্ডব্যাগে পাওয়া গেল ফেস পাউডারের কৌটা, মেকআপের কিছু জিনিসপত্র ও চিরুনি। সব ফেলে দিতে হবে। শাওন করুণমুখে দেনদরবার করছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি। দেনদরবারে লাভ হলো না। সব ফেলে দিতে হলো।
স্টেডিয়ামে ঢুকে ধাক্কার মতো খেলাম। সব ছবির মতো সুন্দর। আমি বিদেশি কোনো স্টেডিয়াম দেখিনি, কাজেই তুলনা করতে পারছি না। তুলনা ছাড়াই বলছি, আমাদের এই স্টেডিয়াম দৃষ্টিনন্দন। বড় কোনো হোটেলের ঘরে ঢুকলে প্রথমেই বাথরুম দেখতে ইচ্ছা করে। আমি স্টেডিয়ামের বাথরুমে উঁকি দিলাম, সব ঝকঝক তকতক করছে।
টিকিটে নম্বর দেওয়া ছিল। নম্বর মিলিয়ে বসেছি। আমাদের সামনে (মাঠের ওপাশে) বিশাল টিভি স্ক্রিন। আমি অস্বস্তি নিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে আছি। অস্বস্তির কারণ পুরো মাঠ একসঙ্গে দেখতে পাচ্ছি। আমার অভ্যাস টিভি স্ক্রিনে খেলা দেখা। সেখানে সবকিছুই খণ্ড খণ্ড করে দেখানো হয়। যখন বোলার বল হাতে ছুটে আসেন, তখন শুধু বোলারকে ধরা হয়। বল দেখানো হয় স্লোমোশনে। এখন সব খেলোয়াড়কে একসঙ্গে দেখব, ব্রেইন ব্যাপারটা গুছিয়ে নিতে পারছে না।
টস হয়ে গেছে। বাংলাদেশ টস জিতে ব্যাটিং নিয়েছে। সারা মাঠে আনন্দের ঢেউ (আক্ষরিক অর্থেই ঢেউ), এক প্রান্ত থেকে ঢেউ শুরু হয়ে অন্য প্রান্তে গিয়ে থামে। এর নাম মেক্সিকান ওয়েভ।
দুই দলের খেলোয়াড়েরা সার বেঁধে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন। সবার সামনে বাংলাদেশের একটি করে বালক বা বালিকা। সুন্দর দৃশ্য। শুরু হলো আয়ারল্যান্ডের জাতীয় সংগীত দিয়ে। অনেক দর্শক দেখলাম উঠে দাঁড়ালেন। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। আয়ারল্যান্ড আজ আমাদের শত্রু। শত্রুদের জাতীয় সংগীতে কি উঠে দাঁড়ানো উচিত?
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সময় অদ্ভুত দৃশ্যের অবতারণা হলো। দর্শকেরা সবাই উঠে দাঁড়িয়েছেন। গানের সঙ্গে গলা মিলাচ্ছেন। আমি লক্ষ করলাম, আমার চোখে পানি এসে গেছে।
খেলা শুরু হয়েছে। তামিমের দুর্দান্ত ঝোড়ো ব্যাটিং। আমাদের পেছনে বসা কিছু তরুণের মন্তব্য শুনে মজা পাচ্ছি।
‘তামিম তক্তা বানায়ে দাও।’
‘মুখ বরাবর বল মারো। বদগুলোর মুখ ভোঁতা করে দাও। কত বড় সাহস! বাংলাদেশের সঙ্গে খেলতে আসে।’
‘তামিমের আজ যে অবস্থা সাড়ে তিন শ থেকে চার শ রান উঠবে। আয়ারল্যান্ড আজ মাঠেই হাগামুতা করবে।’
আমি এদের উত্তেজনায় যুক্ত হতে পারছি না, কারণ বল চোখে দেখছি না। বল কোন দিকে যাচ্ছে তাও বুঝতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে, টিভি পর্দায় খেলা দেখা উচিত ছিল। মাঠে এসে ভুল করেছি।
আমার সামনের সারিতে এক তরুণ ও তরুণীও আমাকে খেলায় মন দিতে দিচ্ছে না। তারা হয় নতুন বিয়ে করেছে কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকা। তারা সারাক্ষণই একে অন্যের ছবি তুলছে। একজন অন্যজনের গায়ে পড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে পায়ের খেলাও খেলছে। পায়ে পায়ে ঠোকাঠুকি। ভুভুজেলা নামক বাদ্যযন্ত্রটি এই স্টেডিয়ামে নিষিদ্ধ, কিন্তু এই যুগল ভুভুজেলার একটি মিনি সংস্করণ জোগাড় করেছে। বস্তুটি বাঁশির মতো না, চারকোনা, ফুঁ দিলেই ভুভুজেলার চেয়েও বিকট শব্দ হয়। এরা ক্ষণে ক্ষণে ভুভুজেলা বাজিয়ে আমাকে চমকাচ্ছে।
আমার পাশে এক ভদ্রলোক বসেছেন। তিনি সারাক্ষণই উচ্চস্বরে মোবাইল ফোনে বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে চলেছেন। খেলা কী হচ্ছে বা না হচ্ছে এদিকে তার ভ্রুক্ষেপও নেই।
কে সামছু! আমি তো মাঠে খেলা দেখছি। ফজলু কই? তারে টেলিফোনে পাচ্ছি না। ফজলুকে বল, আমারে যেন কল দেয়। রংমিস্ত্রি পেয়েছ? আচ্ছা আমি পাত্তা লাগাচ্ছি।
খেলা এগোচ্ছে মোবাইলওয়ালা রংমিস্ত্রির অনুসন্ধানে ব্যস্ত আছেন।
খাদক প্রজাতির একজনকে দেখলাম, খেলা শুরু থেকেই তিনি খাবার স্টল থেকে একের পর এক খাবার নিয়ে আসছেন। শেষ হচ্ছে, আবার আনছেন। খাদ্য গ্রহণ চলছেই। আবহসংগীতের মতো মুরগির হাড় চিবানোর শব্দ আসছে।
পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যকে দেখে খুব মায়া লাগল। তাদের ডিউটি পড়েছে বক্সের দর্শকদের দিকে তাকিয়ে থাকার। চমৎকার খেলা হচ্ছে, বেচারারা উপস্থিত থেকেও খেলা দেখতে পারছে না, তাদের তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে উল্লসিত দর্শকদের মুখের দিকে। উল্লাসের কারণ জানার অধিকার তাদের নেই।
উল্লাসে বাধা পড়ল, ইমরুল কায়েস আউট। বাংলাদেশের টিমে ডমিনো এফেক্ট প্রবল। একা কেউ আউট হয় না, দলবল নিয়ে হয়। দেখতে দেখতে চার ব্যাটসম্যান শেষ। সাবিকের আউটে মাঠে নেমে এল কবরের নিস্তব্ধতা।
শেষ ভরসা আশরাফুল। সাত নম্বরে নেমে সে সবাইকে চমকাবে—এই আমাদের বিশ্বাস। মাঠে আশরাফুল ঢোকামাত্র, আমরা হাততালি দিলাম। আমাদের মধ্যে স্বস্তির ভাব ফিরে এল। হায় খোদা! এ তো দেখি পুরোনো আশরাফুল। এক রান করে আউট। ব্যাট নিয়ে প্র্যাকটিস করতে করতে হাসিমুখে মাঠ থেকে বিদায়।
আমার পেছনে বসা তরুণের দল বলল, আশরাফুলকে এমন শাস্তি দেওয়া দরকার, যেন তার সারা জীবন মনে থাকে। একটা লম্বা বাঁশ এনে…। বাক্যটি লিখলাম না। পাঠকদের কল্পনায় ছেড়ে দিলাম।
আশরাফুল আউট হওয়ার পরপর আমি উঠে দাঁড়ালাম। শাওনকে বললাম, বাংলাদেশের পরাজয় আমি এত মানুষের সঙ্গে দেখব না। আমি চললাম।
শাওনও উঠে দাঁড়াল। দুঃখিত গলায় বলল, মাঠে বসে বাংলাদেশের বিজয় দেখবে বলে তোমাকে মাঠে নিয়ে এসেছি। এমন অবস্থা হবে কে জানত! সরি।
বাংলাদেশের ব্যাটিং বিপর্যয়ের খবর রাস্তায় দাঁড়ানো মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। তাদের হতাশায় ম্রিয়মাণ মুখ দেখে দেখে ফিরছি। আমার হূদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। শাওন বলল, প্লিজ, এত মন খারাপ করবে না। পরের ম্যাচে আমরা অবশ্যই জিতব। এত মানুষের ভালোবাসা কখনো বৃথা যেতে পারে না।
পাদটীকা
একি কাণ্ড! এই খেলায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ জিতেছে। অভিমান করে মাঠ ছেড়ে চলে আসায় আসল খেলাটা দেখা হলো না। আফসোস, আফসোস এবং আফসোস!

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০৪, ২০১১

সংসার

একজন মানুষ এক জীবনে কতবার ‘সংসার’ করে? বেশির ভাগ মানুষের জন্য একবার। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশি মানুষের জন্য দুবার। প্রথম সংসার জ্বলেপুড়ে যাওয়ার কারণে দ্বিতীয়বার। আমি, মনে হয়, কথা গুছিয়ে বলতে পারছি না। এখানে ‘সংসার’ মানে বিয়ে করে ঘর বাঁধা বোঝাচ্ছি না। হাঁড়িকুড়ি, বিছানা-বালিশ নিয়ে দিনযাপন বোঝাচ্ছি।
আমার মা অতি অল্প বয়সে বাবার সঙ্গে সংসার করতে এসেছিলেন। বাবার মৃত্যুতে মায়ের সংসার লন্ডভন্ড হয়ে গেল। তিনি তাঁর বড় ছেলের সঙ্গে ঢাকায় এলেন। নিউমার্কেট থেকে হাঁড়িকুড়ি কিনে নতুন সংসার শুরু করলেন। আমি বাবাশূন্য মায়ের নতুন সংসারে যুক্ত হলাম।
পড়াশোনার জন্য আমেরিকায় গেলাম। গুলতেকিনকে নিয়ে শুরু হলো তৃতীয় সংসার। হাঁড়িপাতিল কেনা, বিছানা-বালিশ কেনা।
ঢাকায় ফিরে এসেই সেই সংসারও ভাঙল। উত্তরার এক বাসায় শুরু হলো আমার একার চতুর্থ সংসার।
বছর তিনেক পর শাওন আমার সঙ্গে যুক্ত হলো। ‘দখিন হাওয়া’য় আমার পঞ্চম সংসার।
ক্যানসার বাধিয়ে আমেরিকায় এসে শুরু হলো ষষ্ঠ সংসার।
সম্ভবত, সপ্তম সংসার হবে আমার শেষ সংসার। সেখানে কি আমি একা থাকব, নাকি সুখ-দুঃখের সব সাথিই থাকবে?
দার্শনিক কথাবার্তা থাক, ষষ্ঠ সংসার নিয়ে বলি।
বাড়ি ভাড়া করা হলো, হাঁড়ি-পাতিল কেনা হলো; টিভি কেনা, বিছানা-বালিশ—সে এক হইচই।
তিন রুমের একটি আলাদা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। বাড়িটা নিশ্চয় সুন্দর। কারণ, কথাবার্তার একপর্যায়ে বাড়িতে রোগী দেখতে আসা প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘বাড়িটা কার?’
আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ‘যেহেতু ভাড়া নিয়েছি, আপাতত আমার।’
বাড়িটায় তিনটা শোবার ঘর। জানালার পাশে প্রকাণ্ড মেপলগাছ। মেপলগাছের পাতায় ফল-এর (Fall) রং ধরতে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে তাকালে চোখ ঘরে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ে।
আমেরিকান ইনডিপেনডেন্ট বাড়িতে ‘এটিক’ নামের একটা ছাদঘর থাকে। এই ঘরটা হয় সবচেয়ে সুন্দর। অনেকখানি সময় আমি এটিতে একা কাটাই। লেখালেখি করি না। ছবি আঁকি। জলরং ছবি। ছবি মোটেই ভালো হচ্ছে না। রঙে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। শুধু অন্যদিন-এর মাজহার বলছে, ‘অসাধারণ! আপনার আঁকা ছবি বিক্রি করে আমরা চিকিৎসার খরচ তুলে ফেলতে পারব, ইনশাল্লাহ।’
চিকিৎসার খরচ নিয়ে আমি এই মুহূর্তে ভাবছি না। নিজেকে ব্যস্ত কীভাবে রাখা যায়, ভাবছি তা নিয়ে।
প্রচুর বই জোগাড় করেছি (অর্থাৎ, কিনেছি)। বাড়ির পাশেই একটা পাবলিক লাইব্রেরি, তার মেম্বার হয়েছি। মেম্বার হতে গিয়ে গোপন আনন্দও পেলাম। বিদেশি লেখকদের বইয়ের তাকে দেখি আমার অনেক বই। বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম, ‘বাংলা ভাষার এই বই তোমরা কীভাবে পেয়েছ?’ লাইব্রেরিয়ান বলল, ‘আমাদের বই দেয় লাইব্রেরি অব কংগ্রেস।’
আমি বললাম, ‘বাংলা ভাষার এই লেখক আমার প্রিয় লেখকদের একজন।’ লাইব্রেরিয়ান বলল, ‘হাউ নাইস! তুমি তার একটা বই ইস্যু করে নিয়ে যাও। সাত দিন রাখতে পারবে।’
আমি হিমুর একটা বই ইস্যু করে নিয়ে এলাম।
দেশে যখন ছিলাম, নিয়মিত সাপ্তাহিক টাইম পড়তাম। এখন পয়সা দিয়ে চারটি পত্রিকার গ্রাহক হয়েছি—
Time
Science
Scientific American
National Geographic
অন্য সময় হলে শাওন মাসে মাসে এতগুলো টাকা খরচ করতে দিত না। তার এখন হিসাবের টাকা। গুনে গুনে খরচ করতে হচ্ছে। সে ঠিক করেছে, আমার কোনো কিছুতেই বাধা দেবে না। বিশাল বাড়িতে আমাদের সঙ্গে মাজহার ছাড়া কেউ নেই। কাজেই জলি ও তার স্বামীকে নাইওর নিয়ে এসেছি। রান্নার দায়িত্ব জলি নিয়ে নিয়েছে। সে প্রতিদিন জিজ্ঞেস করে, ‘হুমায়ূন ভাই, আজ কী খাবেন?’ আমি চেষ্টা করি এমন কোনো খাবারের নাম করতে, যা জোগাড় করা অসম্ভব। কিন্তু অবাক কাণ্ড, খাবারের টেবিলে তা পাচ্ছি। উদাহরণ—
কচুর লতি দিয়ে কাঁঠালবিচি
গরুর ভুঁড়ি
মাছ দিয়ে মাষকলাইয়ের ডাল
ডাঁটা দিয়ে ট্যাংরা মাছ।
মাজহার দায়িত্ব নিয়েছে আমাকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর। অদ্ভুত, উদ্ভট ও অখাদ্য সব ফল ও ফলের রস আমাকে নিয়মিত খেতে হচ্ছে। অসংখ্য বিভিন্ন ধরনের ফল খেয়ে আমি এখন বুঝেছি—জগতে ফলের রাজা আম। ফলের রানি আম। ফলের রাজপুত্র-রাজকন্যা আম।
দেশে আমি ‘গর্তজীবী’ ছিলাম। আমেরিকায় এসে গর্ত থেকে বের হয়েছি। যতটা পারি, পৃথিবী দেখে যাই। কিছুই তো বলা যাচ্ছে না।
গর্ত থেকে বের হয়ে আমি কিছুটা সময় আমার বাড়ির পেছনের ব্যাক ইয়ার্ডে (Back Yard) কাটাই।
আমেরিকানরা এই জায়গাটা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। উইকএন্ডে বারবিকিউ করে, আড্ডা দেয়, বিয়ার খেয়ে উল্লাস করে। বাকি দিনগুলোতে জায়গাটা পড়ে থাকে অনাথের মতো। আমি চেষ্টা করি প্রতিদিন সন্ধ্যার কিছুটা সময় এখানে কাটাতে।
এক সন্ধ্যায় পুত্র নিষাদকে নিয়ে বসেছি। হঠাৎ পুত্র আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘বাবা, দেখো, বাংলাদেশের চাঁদটা এখানে চলে এসেছে। আকাশে কত বড় চাঁদ!’ তাকিয়ে দেখি, মেপলগাছের ফাঁকে নিউইয়র্ক নগরে সম্পূর্ণ বেমানান এক চাঁদ নির্লজ্জের মতো উঠে বসে আছে। তার তো থাকার কথা বাঁশবাগানে মাথায়।
আমি পুত্রকে বললাম, ‘বাংলাদেশের চাঁদ এখানে কীভাবে চলে এসেছে?’ সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমরা যখন প্লেনে করে এসেছি, তখন প্লেনের পেছনে পেছনে চলে এসেছে। চাঁদটা তোমাকে খুব ভালোবাসে তো, এই জন্য এসেছে।’
শিশুরা না বুঝে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে ফেলে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে আমার মনে হলো, আমার পুত্রের কথা সত্যি। বাংলাদেশের দুঃখী চাঁদ শুধু আমাকে ভালোবেসেই কংক্রিটের নিউইয়র্ক নগরে চলে এসেছে।
আমি আমার লেখকজীবনে একটিমাত্র উপন্যাসই আমেরিকায় বসে লিখেছিলাম—সবাই গেছে বনে। নামটা ধার করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান থেকে—‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’।
আচ্ছা, পাঠক কি জানেন, এই গানটি কোনো আনন্দগীতি, না দুঃখগীতি? রবীন্দ্রনাথের অতি আদরের পুত্র শমির মৃত্যুর পরদিন রাতে আকাশ ভেঙে জোছনা নেমেছিল। রবীন্দ্রনাথ একা টানাবারান্দায় বসে প্রবল জোছনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে লিখলেন—
‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে
যাব না গো যাব না যে
রইনু পড়ে ঘরের মাঝে—
এই নিরালায় রব আপন কোণে।…
আমার এ ঘর বহু যতন ক’রে
ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।
আমারে যে জাগতে হবে
কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে…’

হুমায়ূন আহমেদ, নিউইয়র্ক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
তারিখ: ৩০-১০-২০১১

সুপার হিরো

হিরো একটি পশ্চিমা কনসেপ্ট। এদের কমিক বইয়ে হিরো আছে (ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান, সুপারম্যান), বাস্তবেও আছে।
আমাদের তেমন কিছু নেই। মাঝেমধ্যে এক-আধজনকে পাওয়া যায়— ভাঙা রেললাইনের সামনে গামছা নিয়ে দাঁড়িয়ে ট্রেন থামায়। অনেকের জীবন রক্ষা করে। আমরা কিছুদিন তাকে নিয়ে হইচই করে ব্যাক টু দ্যা প্যাভিলিয়ন। উল্টো ব্যাপারও আছে, পুরো ট্রেন জ্বালিয়ে দেওয়া।
পশ্চিমা একজন হিরোর গল্প দিয়ে আজকের লেখা শুরু করছি। তার নাম টেরি ফক্স। কানাডার এক যুবক। মাত্র বাইশ বছর বয়সে ভয়াবহ ক্যানসার (osteosarcoma) তাকে আক্রমণ করল। তার একটি পা কেটে ফেলে দিতে হলো। টেরি ফক্স হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ভাবলেন, ক্যানসার গবেষণার জন্যে আরও অর্থ প্রয়োজন। তিনি ঘোষণা করলেন, এক পা নিয়েই তিনি কানাডার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত দৌড়ে ক্যানসারের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করবেন।
আটলান্টিক সমুদ্রে পা ডুবিয়ে তিনি দৌড় শুরু করলেন। তত দিনে একটা নকল পা লাগানো হয়েছে। এক শ তেতাল্লিশ দিন পর্যন্ত তিনি নকল পায়ে দৌড়ালেন। ৩,৩৩১ মাইল অতিক্রম করে তাকে থামতে হলো। কারণ ক্যানসার তখন ফুসফুস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। মাত্র তেইশ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। তিনি ক্যানসার রিসার্চের জন্যে রেখে গেলেন সংগ্রহ করা এক শ মিলিয়ন ডলার। এখন সংগ্রহ পাঁচ শ মিলিয়ন ছেড়ে গেছে।
ক্যানসার রিসার্চের অর্থ সংগ্রহের জন্যে বিশ্বজুড়েই টেরি ফক্স ম্যারাথন হয়। পঁচিশতম ম্যারাথনে পৃথিবীর তিন মিলিয়ন মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে, বাংলাদেশেও এই ম্যারাথন হয়েছে।
ক্যানসার হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্রের জন্যে আমরা অর্থ সংগ্রহে নামতে যাচ্ছি। আমাদের গুরু অবশ্যই টেরি ফক্স।
আমি টেকনাফে বঙ্গোপসাগরে পা ডুবিয়ে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত যাব। আমার পক্ষে দৌড়ানো সম্ভব না। কারণ শিশুপুত্র আমার দুই পা চেপে ধরে থাকবে। এরা পা চেপে ধরায় ওস্তাদ। আমি পরিবার ছাড়া এক দিনও একা থাকতে পারি না। আমার সঙ্গে আমার দুই শিশুপুত্র এবং তাদের মা থাকবে। আমরা প্রতীকী অর্থে মাঝে মাঝে দৌড়াব। বাকিটা গাড়িতে। এই আনন্দযাত্রায় সবাইকে আমন্ত্রণ।
ক্যানসার ইনস্টিটিউটের জন্যে আমি যে সাড়া পেয়েছি তাতে আমার মনে হয়েছে আমার মানবজীবন ধন্য। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
অভিনেতা রহমত (নয় নম্বর বিপদ সংকেত) আমাকে জানিয়েছেন রাজশাহীতে তাঁর পাঁচ বিঘা জমি দিতে চান। যদি ক্যানসার ইনস্টিটিউট ঢাকায় হয় তাহলে তিনি তাঁর সঞ্চিত পাঁচ লাখ টাকা দিতে চান। এর বেশি তাঁর আর নেই। থাকলে তাও দিতেন।
নিউইয়র্কের বাঙালি ডাক্তার নাহরিন মামুন জানিয়েছেন ঢাকায় তাঁর জমি আছে। পুরোটাই তিনি ক্যানসার ইনস্টিটিউটকে দিয়ে দিতে চান। আমি যখন বলব তখন।
জেনেভা থেকে আনজু ফেরদৌসী জানিয়েছেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সঞ্চয় ১০ হাজার ডলার শুরুতে দিতে চান। এক্ষুনি দিতে চান। পরে যদি কিছু খরচ হয়ে যায়।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আমেরিকার প্রধান প্রধান হাসপাতালে বাংলাদেশের ডাক্তার সন্তানরা প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করে যাচ্ছেন।
পৃথিবীর সেরা অনকোলজিস্টের অনেকেই বাংলাদেশি। একজন অনকোলজিস্ট রথীন্দ্রনাথ বসু ওভারিয়ান ক্যানসারে যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন।
এঁরা সবাই বাংলাদেশের ক্যানসার ইনস্টিটিউটের জন্যে যা করণীয় তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
অনলাইনে দেখলাম, ২৫০ জন নিজেদের ভিক্ষুক ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা অর্থ সংগ্রহের জন্যে ভিক্ষার থালা নিয়ে পথে বের হবেন।
আর হিমুর দল তো হলুদ পাঞ্জাবি পরে তৈরি হয়েই আছে। তারা নাচুনি বুড়ি। ঢোলের বাদ্যের অপেক্ষা।
কনফুসিয়াসের বিখ্যাত বাণী সবাইকে মনে করিয়ে দেই। ‘আ জার্নি অব আ থাউজ্যান্ড মাইলস বিগিনস উইথ আ সিংগল স্টেপ’। আমরা কিন্তু প্রথম ‘স্টেপ’ নিয়ে নিয়েছি।
আল্লাহপাক বলেছেন, তোমরা বেহেশতে প্রবেশ করবে হিংসামুক্ত অবস্থায়।
আমাদের ক্যানসার হাসপাতালে একই অবস্থা। তবে হিংসা না, সবাইকে প্রবেশ করতে হবে রাজনীতিমুক্ত অবস্থায়। ডাক্তাররা আওয়ামী লীগ, বিএনপি করবেন, ইলেকশন হবে, মারামারি হবে—তা কখনো না।
পৃথিবীর কোথাও আমি ছাত্রদের এবং শিক্ষকদের রাজনৈতিক দল করতে দেখিনি। এই অর্থহীন মূর্খামি বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার। এই মূর্খদের মধ্যে আমিও ছিলাম। ড. আহমদ শরীফ এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অতি শ্রদ্ধেয় দুজন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সাদা দলে ইলেকশন করেছি। এখন নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। মূর্খ মনে হয়। আমাদের ক্যানসার ইনস্টিটিউটে মূর্খদের প্রবেশাধিকার নেই।
বিশ্বমানের গবেষণা শুরুতেই আমাদের ইনস্টিটিউটের পক্ষে সম্ভব হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। তবে সারা বিশ্বের ক্যানসারের ওপর গবেষণার ফলাফল তারা ব্যবহার করতে পারবেন।
বিদেশি ডাক্তারদের প্রতি আমাদের এক ধরনের মোহ আছে। মোহভঙ্গের সময় এসেছে। বাংলাদেশের সেরা অনকোলজিস্টরা ইনস্টিটিউট চালাবেন। একটি আমেরিকান হাসপাতালে সর্বাধুনিক যেসব যন্ত্রপাতি থাকবে তার সবই থাকবে আমাদের ইনস্টিটিউটে। যন্ত্রপাতি দেখাশোনা এবং পরিচালনার জন্যে দক্ষ শক্তিশালী টিম থাকবে। বর্তমান চিকিৎসা অতিমাত্রায় যন্ত্রনির্ভর।
দামি যন্ত্রপাতি কেনার বাংলাদেশি স্টাইলে আমরা যাব না। কোনো টেন্ডার না। ইনস্টিটিউট ঠিক করবে তার কী যন্ত্র দরকার। তারা সরাসরি কিনবে।
বাংলাদেশি স্টাইল হলো—প্রথমে টেন্ডার ডাকা হবে। ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের পোষা ছাত্র দল ঝাঁপিয়ে পড়বে। টেন্ডার হয়ে যাবে। এখন বিদেশ ভ্রমণ পালা। নানান টিম আলাদা আলাদাভাবে যন্ত্র কেনা এবং তার প্রয়োগ জানতে বিদেশ ভ্রমণ করবে। সবশেষে যাবেন মন্ত্রী মহোদয় (স্ত্রী এবং শ্যালিকাসহ)।
যন্ত্র কেনার পর সবার আগ্রহ শেষ হয়ে যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরে যন্ত্র পড়ে থাকবে দিনের পর দিন। কেউ ছুটিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে না। ছুটানোর দায়িত্ব কার এই নিয়ে জটিলতা। যন্ত্র ছোটানোতে আর মালকড়ি পাওয়ার সম্ভাবনা নাই।
এক সময় যন্ত্র ছাড় করা হবে। যন্ত্র বসাতে লাগবে প্রায় এক বছর। তত দিনে যন্ত্র বেঁকে বসেছে। এটা একটা সুসংবাদ, কারণ যন্ত্র কেন কাজ করছে না এটা জানার জন্যে বেশ কিছু দল আবার বিদেশ সফর করবে। স্ত্রী-শ্যালিকাসহ মন্ত্রী মহোদয় আবারও যাবেন।
পাদটীকা
বাংলাদেশের একজন রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্যে আমেরিকায় এসেছেন। নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি সেরা ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করাবেন। তাঁর রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং বিভাগীয় প্রধান রোগী দেখতে এসে বললেন, আপনার কী কী সমস্যা আমাকে বলবেন?
রোগী চোখ কপালে তুলে বললেন, আপনি বাংলাদেশি নাকি?
হ্যাঁ। আমার বাড়ি চিটাগাং।
রোগী থমথমে গলায় বললেন, এত টাকা-পয়সা খরচ করে আমেরিকায় এসে আমি বাংলাদেশি ডাক্তারের চিকিৎসা নিব না। আমেরিকান ডাক্তার লাগবে। বাংলাদেশি দিয়ে চলবে না।

একটা ব্যাপার আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছি, তখন পশ্চিমারা বাঁদরের চেয়ে সামান্য ওপরে অবস্থান করছিল।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের শুরুটা আমরা করেছি। চৈনিক ও আরবদের অবস্থান আমাদের নিচে। পাঁচ হাজার বছর আগে আমাদের সার্জনরা প্লাস্টিক সার্জারি করতেন।
কর্কট রোগ (ক্যানসার) সম্পর্কে পাঁচ হাজার বছর আগের ভারতীয় চিকিৎসকেরা নিদান দিয়ে গেছেন। শূন্য এবং অসীম—এই দুই সংখ্যা আমাদের আবিষ্কার।
আমাদের সবার উচিত শৈশবের একটি কবিতা নতুন করে পড়া—
‘আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে?’

হুমায়ূন আহমেদ, নিউইয়র্ক থেকে
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ২৯, ২০১২

Exit mobile version