‘পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে
এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।’
—জীবনানন্দ দাশ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, তারিখ: ০১-১২-২০১১
কচ্ছপকাহিনি
প্রায় ১০০ বছর আগে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রামের দৃশ্যচিত্র। আসরের নামাজ শেষ করে মাদ্রাসার একজন হতদরিদ্র শিক্ষক তাঁর বড় দুই পুত্রকে ডেকে পাঠালেন। তাদের বললেন, আমি হতদরিদ্র, নাদান একজন মানুষ। তোমাদের দুজনকে পড়াশোনা করানোর সাধ্য আমার নাই। আমি একজনকে পড়াশোনা করাব। অন্যজন গৃহস্থি (খেতের কাজ) করবে। তোমরা দুই ভাই আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসো, কে পড়াশোনা করবে, আর কে গৃহস্থি করবে। এই নিয়ে যেন পরে ভাইয়ে ভাইয়ে মনোমালিন্য না হয়। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ আল্লাহ পাক অপছন্দ করেন।
ঘটনা শুনে বড় ভাই কাঁদতে শুরু করল। কারণ, তার খুব স্কুলে পড়ার শখ। তার ধারণা হলো, হয়তো এই সুযোগ সে পাবে না। তার ছোট ভাই বড়জনের কান্না দেখে বাবাকে বলল, আমি গৃহস্থি করব। বড় ভাই পড়াশোনা করুক।
সেই অঞ্চলে সত্তর মাইলের মধ্যে কোনো স্কুল নেই। সত্তর মাইল দূরে বাচ্চা একটা ছেলেকে জায়গির পাঠানো হলো। অন্যের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করবে। বিনিময়ে তাদের ফুট-ফরমাশ খাটবে।
গরমের ছুটিতে বালক জায়গির থেকে বাড়িতে ফিরেছে। বালকের মা বললেন, বাবা গো! খাওয়াদাওয়া তারা ঠিকমতো দিত?
বালক বলল, দিত। কিন্তু তরকারিতে লবণ কম বলে খেতে পারতাম না।
তুমি লবণ চাইতা?
আমার লজ্জা করে।
গরমের ছুটির পর বালক জায়গিরে ফিরে যাচ্ছে। বালকের মা তার সঙ্গে বাঁশের চোঙের ভেতর ভরে লবণ দিয়ে দিলেন, যাতে বালককে লবণের কষ্ট না করতে হয়।
বালকের নাম ফয়জুর রহমান আহমেদ। আমার বাবা। অতি দুর্গম গ্রামের তিনি প্রথম ম্যাট্রিকুলেট, তিনি প্রথম গ্র্যাজুয়েট।
মুসলমান একটি ছেলে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে শুনে আঠারোবাড়ীর জমিদার তাকে দেখতে চাইলেন। বাবা খালি পায়ে জমিদারের সামনে উপস্থিত হলেন। সেই সময় ছাতা মাথায় দিয়ে জুতা পরে জমিদারের সামনে যাওয়া যেত না। জমিদার বললেন, বাবা, তুমি জুতা পায়ে আমার কাছে আসার যোগ্যতা অর্জন করেছ। আর কখনো আমার সামনে খালি পায়ে আসবে না।
এই জমিদারের কথা আমি মধ্যাহ্ন উপন্যাসে উল্লেখ করেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই জমিদারের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত গান, ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে’ এই জমিদার বাড়িতে লেখা।
বাঁশের চোঙায় লবণ নিয়ে জায়গির বাড়িতে যাওয়ার বিষয়টা একসময় আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। দুপুরে ভাত খাচ্ছি। তরকারিতে লবণ কম হয়েছে। পাতে লবণ নিতেই মা পুরোনো গল্প তুললেন। যেহেতু অনেকবার শোনা গল্প, আমি হুঁ হুঁ করে গেলাম। মা বললেন, তোদের গ্রামের বাড়িতে আগে যেমন স্কুল ছিল না, এখনো নাই। তুই একটা স্কুল করে দে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা কত কষ্ট করে দূরে দূরে পড়তে যায়।
আমি বললাম, মা! স্কুল-কলেজ করা কোনো লেখকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তবে আপনি চেয়েছেন, আমি স্কুল করে দেব।
মা বললেন, স্কুলটা যেন তোর বাবার নামে হয়।
আমি বললাম, স্কুল হবে স্কুলের নামে। বাবার নামে, মায়ের নামে না। আমি স্কুলের নাম দিলাম ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নামে স্কুল। বাবা একজন শহীদ। কাজেই তাঁর নামও স্কুলে যুক্ত। মা! ঠিক আছে?
কী যে ভয়াবহ এক ঝামেলা সেদিন মাথায় নিলাম, তা আমি জানি আর জানেন বেলাল বেগ।
বেলাল বেগ সম্পর্কে বলি। ঘোরের জগতে বাস করা একজন মানুষ। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেছেন। আড়বাঁশির ওস্তাদ মানুষ। আমেরিকানরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাবরেটরি স্কুল করে, তখন তিনি সেই স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হন। বিটিভিতে চমৎকার সব শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম করতেন। একটির নাম ‘কিন্তু কেন’।
বেলাল বেগের সন্ধান আমাকে দিলেন সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে বেলাল বেগের সঙ্গে ছিলেন। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের তিনিও ছিলেন শিক্ষক। বেলাল বেগের সন্ধান করার চেষ্টা করলাম। শুনলাম, তিনি স্ত্রী এবং সংসারের ওপর অভিমান করে সন্দ্বীপে একা বাস করছেন। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা আমেরিকায় থাকে। তারা বেলাল বেগকে নিয়ে যেতে চায়। বেলাল বেগ নিজের দেশ ছেড়ে যাবেন না।
বেলাল বেগকে সন্দ্বীপ থেকে আনা হলো। আমি তাঁকে স্কুলের কথা বললাম। তাঁর চোখ চকচক করতে লাগল। তিনি আমাকে কিছু শর্ত দিলেন।
১. এই স্কুল আর দশটা স্কুলের মতো হলে চলবে না। এটি হতে হবে এমন এক স্কুল, যা উন্নত দেশের স্কুলের পাশে দাঁড়াবে।
২. স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার পাশাপাশি শিখবে মোরালিটি।
৩. প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর মাথায় স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিতে হবে।
আমি বললাম, আপনি আপনার মতো করুন। সব দায়িত্ব আপনার।
বেলাল বেগ ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি চলে গেলেন আমার গ্রামের বাড়ি কুতুবপুরে। গ্রামের মানুষদের আগে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্কুলের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হবে। স্কুলের জন্য একসঙ্গে অনেকখানি জায়গা প্রয়োজন। জায়গা কিনতে হবে। এই অঞ্চলে কোনো রাস্তাঘাট নেই। রাস্তাঘাট করতে হবে। ইলেকট্রিসিটি আনতে হবে।
বেলাল বেগের কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে একদিন আমার মা তাকে ডেকে পাঠালেন। বেলাল বেগের হাত ধরে বললেন, বাবা! একটা পর্যায়ে সবাই আমার ছেলেকে ছেড়ে চেলে যায়। তুমি তাকে ছেড়ে যেয়ো না। সে একা স্কুলটা করতে পারবে না।
বেলাল বেগ বললেন, আমি কখনো আপনার ছেলেকে ছেড়ে যাব না। আপনাকে কথা দিলাম।
বেলাল বেগ কথা রাখেননি। স্কুল নির্মাণের মাঝপথে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে আমেরিকায় চলে গেলেন। আমি স্কুল শেষ করলাম। অপূর্ব আর্কিটেকচারাল ডিজাইনের কী সুন্দর স্কুল! ডিজাইনার ছিল আর্কিটেকচারের দ্বিতীয় বর্ষের একজন ছাত্রী—মেহের আফরোজ শাওন।
স্কুল তো দাঁড়াল। স্কুল চালাব কীভাবে? কিছুই তো জানি না। আমার সঞ্চিত অর্থের সবটাই গেছে। কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছি, তার একটা উদাহরণ দিই। ১২ বছর আগে খরচ করেছি ৭০ লাখ টাকা। স্কুলের জন্য ফার্নিচার কেনার টাকা নেই। লোহার খুঁটি গাড়া হয়েছে, বেড়া দেওয়ার টাকা নেই।
চেষ্টা করলাম সরকারের হাতে স্কুল তুলে দিতে। সরকারি লোকজন চোখ কপালে তুলে বলল, একটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার দাঁড়া করিয়ে আপনি দিয়ে দেবেন, তা কীভাবে হবে?
আওয়ামী লীগ, বিএনপি—অনেক দেনদরবার করলাম, তারা কেউ এই দায়িত্ব নেবে না। শিক্ষা শিক্ষা বলে এই দুই দলই মুখে ফেনা তুলে ফেলে, কিন্তু তৈরি একটা স্কুলের দায়িত্ব নেয় না।
একবার মনে হলো স্কুল বাদ, স্কুলের বদলে হাসপাতাল বানালে কি কেউ দায়িত্ব নেবে? প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটা হাসপাতাল তো দরকার। সেই চেষ্টাও বিফল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের লোকজন এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন আমি একজন মানসিক প্রতিবন্ধী।
গেলাম ব্র্যাকের কাছে। তারা যদি কিছু করে। ব্র্যাকের কর্মকর্তারা এলেন, দেখলেন, প্রচুর খাওয়াদাওয়া করলেন এবং চলে গেলেন।
একসময় স্কুলের ২৬০টি কাচের জানালা ভেঙে পড়ল। লাইব্রেরি ঘর হিসেবে যেটা বানানো হয়েছিল, সেখানে নেশাখোরেরা গাঁজা খাওয়ার আসর বসাল। স্কুলের মাঠে সরিষা বুনে দেওয়া হলো। স্কুলের চারপাশের লোহার খুঁটিগুলো তুলে গ্রামের মানুষেরাই সের দরে বাজারে বেচে দিল। স্কুল ভবন গরু-ছাগল রাখার স্থায়ী নিবাসে পরিণত হলো।
এক রাতে খেতে বসেছি। আমার মা দুঃখিত গলায় বললেন, তোকে দিয়ে স্কুল বানানোর সিদ্ধান্ত ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। তুই আমার ওপর কোনো রাগ রাখিস না। দান গ্রহণ করতেও যোগ্যতা লাগে, তোর গ্রামের সেই যোগ্যতা নেই।
আমি বললাম, মা! আমি হচ্ছি কচ্ছপ। কচ্ছপ একবার যা কামড়ে ধরে তা ছাড়ে না। কচ্ছপের কামড় থেকে বাঁচার একটাই উপায়—তার গলা কেটে ফেলা। স্কুল আমি একাই চালাব।
হ্যাঁ, স্কুল চলছে। পাসের হার ১০০ ভাগ। এ বছর বৃত্তি পেয়েছে পাঁচটি ছেলেমেয়ে।
আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, পুরো বাংলাদেশে এই স্কুলের চেয়ে সুন্দর স্কুল নেই। কোনো স্কুলের এত বড় লাইব্রেরি নেই। এতগুলো কম্পিউটার নেই। আমি আমার স্কুলে এখন পর্যন্ত কোনো রাজনীতিবিদকে (এমপি, মন্ত্রী ইত্যাদি) নিতে পারিনি। তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। তাদের আমার প্রয়োজনও নেই।