ফুলির মা তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোমাকে না যেতে বললাম।
আফা আপনের শাড়ি ঠিক করেন, হাঁটুর উপরে উইঠ্যা গেছে।
আমার শাড়ি কোথায় উঠেছে না উঠেছে তা তোমাকে দেখতে হবে না। তুমি তোমার কাজে যাও।
ফুলির মা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, মরা বাড়িত তিন দিন কাজ কাম করা নিষেধগো আফা। তিন দিন, তিন রাইত চুলা জ্বলে না।
টেলিফোন বাজছে। মনিকা টেলিফোন ধরার জন্যে প্রায় ছুটে গেল। আমেরিকায় কল বুক করা হয়েছে। লাইন অসম্ভব বিজি। কিছুতেই লাইন পাওয়া যাচ্ছে না।
হ্যালো হ্যালো।
কে মনিকা আপু?
হা। টিকিট পেয়েছিস?
পেয়েছি তবে কনফার্মড না। এয়ারপোর্টে বসে থাকতে হবে।
সবাই আসছিস?
পাগল হয়েছ। পাপ্পু গেছে সামা’র ক্যাম্পে, পাপ্পুর বাবা একুশ তারিখ যাবে বেলজিয়াম। ওর কনফারেন্স।
বেলজিয়ামের কোথায় যাবে?
লীয়েগে না–কি যেন নাম। ও আচ্ছা তুমিও তো বেলজিয়াম গিয়েছিলে জায়গাটা কেমন আপা?
সুন্দর। খুব সুন্দর। শহর থেকে বের হলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
পাপ্পুর বাবার সঙ্গে আমারো যাবার কথা ছিল…. এর মধ্যে এই খবর।….
টেলিফোন লাইনে কি একটা গন্ডগোল হচ্ছে, কটু করে একটা শব্দ হল। লাইন কেটে গেল।
মনিকা বিরক্ত মুখে রিসিভার নামিয়ে রাখার সময় দেখল, ফুলির মা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। টেলিফোনে কি কথাবার্তা হচ্ছে হা করে শুনছে। মনিকা আঁঝালো গলায় বলল, তোমাকে না বললাম চলে যেতে।
কই যামু?
যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাও। সব সময় গা ঘেঁসে থাকবে না।
জ্বি আইচ্ছা। আফা আপনের শাড়ি হাঁটুর উপরে উইট্টা রইছে।
একবারতো বললাম, আমার শাড়ি নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। জ্বি
আইচ্ছা।
আমার জন্যে চা বানিয়ে আন। দুধ চিনি কিছুই দেবে না, আমি দিয়ে নেব।
মরা বাড়িত চূলা জ্বালা নিষেধ আছে আফা। তিনদিন চুলা বন থাকব।
তুমি এক্ষুনি গিয়ে চুলা জ্বালাবে। চা করবে। আজে বাজে কথা বলবে না, মোটেও তর্ক করবে না। আজে বাজে কথা এবং তর্ক দু’টাই আমি অপছন্দ করি।
জ্বি আইচ্ছা।
কথা বলে বলে তুমি আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছ। এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন।
শাড়িটা ঠিক করেন আফা।
মনিকা শাড়ি ঠিক করল। তার মাথার যন্ত্রণাটা বাড়ছে। টেনশান ঘটিত যন্ত্রণা। সব তাকে একা করতে হচ্ছে।
এমন কেউ নেই যাকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তার ধারণা এই কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষদের স্বভাবে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সবাই দায়িত্ব নেয়ার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। দায়িত্ব নেয়া পর্যন্তই। একবার দায়িত্ব নিয়ে নেবার পর আর কোন খোঁজ পাওয়া যাবে না।
বারডেমে ডেডবডি রাখার দায়িত্ব নুরুদ্দিন নামের এক লোক (মনিকার দূর সম্পর্কের মামা) নিয়েছিল। খুব আগ্রহের সঙ্গে নিয়েছিল। বারডেমের ডিরেক্টর সাহেব -কি তার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। একসঙ্গে উঠা-বসা। টেলিফোন করা মাত্র ব্যবস্থা হবে।
মনিকা বলেছিল, জায়গা থাকলে তবেই না ব্যবস্থা হবে। শুনেছি মাত্র তিনটা ডেডবডি রাখার ব্যবস্থা ওদের আছে। তিনটাই যদি অকুপায়েড থাকে?
অকুপায়েড থাকলেও ব্যবস্থা হবে। দরকার হলে অন্য ডেডবডি ফেলে দিয়ে ব্যবস্থা হবে। এই ব্যাপারটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও তো।
মনিকা ছেড়ে দিয়েছিল। নুরুদ্দীন সাহেব সকাল নটার সময় দায়িত্ব নিয়ে হাসিমুখে চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন তিনি এক ঘন্টার মধ্যে ব্যবস্থা করছেন। এই যে তিনি গেলেন–গেলেনই। আর ফিরলেন না। শেষ পর্যন্ত মনিকার নিজেরই যেতে হল।
এই অবস্থায় মিনিটে মিনিটে মাথা ধরবে নাতো কি? প্রতিটি কাজ তাকে নিজেকে দেখতে হচ্ছে। আত্মীয় স্বজনদের টেলিফোন করা। প্লেনে আসবে তাদের আনার জন্যে এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠানো। কে কোথায় থাকবে সেই ব্যবস্থা করা। বিছানা, বালিশ, মশারী….
আফা আপনের চা।
দুধ চিনি দিয়ে নিয়ে এসেছ?
জি।
তোমাকে না বলেছিলাম দুধ চিনি ছাড়া চা আনতে। তুমি কি ইচ্ছা করেই আমাকে বিরক্ত করছ?
ফুলির মা হাই তুলল। মনিকার কথাকে সে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। মনিকা চায়ে চুমুক দিল। আশ্চর্যের ব্যাপার চা খারাপ হয়নি। দুধ চিনি সবই পরিমাণ মত হয়েছে।
আফা, টেলিফোনে কার সাথে কথা কইতেছিলেন?
তা দিয়ে তোমার দরকার আছে?
আফনের ছোড ভইন?
হা আমার ছোট বোন মৃন্ময়ী। ও সিয়াটলে থাকে।
ছোড আফা কি আইতাছে?
হ্যাঁ, আসছে। ভাল কথা, ও যে এসে থাকবে–কোথায় থাকবে? ব্যবস্থা আছে। কোন?
ফুলির মা দাঁত বের করে হাসল।
মনিকা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, হাসছ কেন?
সব ব্যবস্তা আছে আফা। খালুজান সব ব্যবস্তা রাখছে। আফনের জইন্যে আলাদা ঘর, মেজো আফার জইন্যে আলাদা ঘর, ছোড আফার ঘর, ভাইজানের ঘর। আফা ভাইজান আসতাছে না?
তোমার এত খবরের দরকার নেই। তুমি ঘর গুছিয়ে ঝাড়পোছ করে রাখ।
ভাইজান কি খবর পাইছে আফা?
কেন শুধু শুধু বিরক্ত করছ ফুলির মা। সামনে থেকে যাও।
ফুলির মা গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। কারণ টেলিফোন বাজছে। টেলিফোনে কেউ যখন কথা বলে ফুলির মা’র শুনতে ভাল লাগে। টেলিফোন করেছে মৃন্ময়ী। তার গলার স্বরে স্পষ্ট বিরক্তি—
আপা, বাংলাদেশের টেলিফোনের একি অবস্থা। এই যে লাইন কেটে গেল তারপর থেকে সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটা সামান্য টেলিফোনের জন্যে যদি এত সময় নষ্ট হয় তাহলে দেশ চলবে কি ভাবে।