আসমানী ছেলের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে ডাকল, ও সুলেমান।
সুলেমান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আহারে কি সুন্দর চেহারা। কি সুন্দর চোখ। চোখের দিকে তাকালেই মায়ায় মনটা উদাস হয়। আসমানী বলল, কার্তিক মাসের রইদ বালা না রে বাপধন।
সুলেমান কিছু বলল না, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। আসমানী স্বস্তি বোধ। করল। সে ভেবেছিল ছেলে আবারো রেগে যাবে।
মুড়ি খাবি?
দেও।
গুড় নাই, খালি নাইরকেল আর মুড়ি।
আইচ্ছা।
আসমানী এক বাটি মুড়ি সামনে রাখল। সুলেমান মুড়ি চিবুচ্ছে। কুট কুট করে খাচ্ছে। আহারে কি সুন্দর লাগছে।
মা।
কি রে ময়না।
আমি বাড়িত থাকমু। গানের দলে যামু না।
আসমানী মনে মনে বলল, আইচ্ছা।
লোকে আমারে নিয়া কুকথা কয়, হাসে।
আমি বলব তোর বাপরে।
বলেই মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। উপায় নেই। সুলেমানকে যেতেই হবে। বায়নার দুহাজার টাকা নেয়া হয়ে গেছে। আরো টাকা আসবে। সংসার টাকাগুলির জন্যে হা করে আছে।
আসমানী ছেলের মাথায় হাত রাখল। ছেলে ঝটকা মেরে মা’র হাত সরিয়ে দিল। আসমানী সাহস পেয়ে ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। সুলেমান তখনো কিছু বলল। তার বড় বড় চোখ শুধু ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করল। আসমানীর মনে হল ছেলে তার কথা বিশ্বাস করে ফেলছে। সে হয়ত ভাবছে মা তাকে পাঠাবে না।
.
হাশেম মিয়া সুলেমানকে দেখে অত্যন্ত খুশী হয়েছেন। ঘেটু দলের জন্যে এরকম সুন্দর ছেলেই দরকার। ড্যান্স মাষ্টার সুলেমানকে মেয়েদের পোষাক পরিয়ে দিয়েছেন। ঠোঁট লিপস্টিক দিয়ে লাল টুকটুক করা হয়েছে। নারকেল মালা দিয়ে বুক উঁচু করা। সুলেমানের লম্বা চুল বেণী করা। বুক দু’টা কেমন উঁচু হয়েছে। আরেকটু কম হলে মানানসই হত। তবু সুন্দর লাগছে। খুব সুন্দর। এমন সুন্দর লাগছে যে চোখ ফেরানো যায় না। হাশেম মিয়া ড্যান্স মাষ্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, গলা কেমুন?
গলা খুবই চমৎকার। সুলেমান, দেখি একটা গান শুনা।
সুলেমান রিনরিনে গলায় গান ধরল,
কোথায় তোমার ঘর বান্ধই
কোথায় তুমি থাক?
তোমার শাড়ির অঞ্চলে বান্ধই
কারে গোপন রাখ?
বলব না বলব না বান্ধই
আমার গোপন কথা।
শাড়ি খুইল্যা দেখামু বান্ধই
……. (মুদ্রণ যোগ্য নয়)
গান গাইতে গাইতে সুলেমান শাড়ি খোলার ভঙ্গি করল। হাশেম মিয়া বললেন, মধু মধু। কাছে আয়।
সুলেমান কাছে এগিয়ে গেল। হাশেম মিয়া তার গাল টিপে আদর করলেন।
. হাশেম মিয়ার স্ত্রী সন্ধ্যা থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে। ঘেঁটু নাচের ছেলে বাড়িতে থাকতে এলে বাড়ির মেয়েরা চোখের জল ফেলে। এই নিয়ম ঘেটু নাচের মতই প্রাচীন নিয়ম। হাশেম মিয়ার সুন্দরী স্ত্রী কেঁদে নিয়ম রক্ষা করে। কারণ শৌখিনদার মানুষরা ঘেঁটু নাচের বালকদের বড়ই পছন্দ করে। শৌখিনদার মানুষ যখন রাতে স্ত্রীর সঙ্গে ঘুমুতে আসে তখন ঘেঁটু বালককেও সঙ্গে নিয়ে আসে। সেই বালক রাতে স্বামী স্ত্রীর মাঝখানে ঘুমায়।
কবর
ফুলির মা ক্ষীণ গলায় বলল, আফা চাচাজান কি ফিরিজের ভিতরে থাকব?
মনিকা দু’টা রিলাক্সিন খেয়ে শুয়েছিল। ফুলির মা’র কথা শুনে উঠে বসলো। চট করে তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। রিলাক্সিন মানুষের নার্ভ ঠাণ্ডা করে, তারটাও করেছিল, ঝিমুনির মত এসে গিয়েছিল-ফুলির মা’র কথায় ঝিমুনি কেটে গেল। এই বোকা কাজের মহিলাটা তাকে বিরক্ত করে মা’রছে। অসহ্য। অসহ্য।
মনিকা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কি বললে?
ফুলির মা প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করার সাহস পেল না। যদিও একজন মৃত মানুষকে ফ্রীজে রেখে দেয়ার ব্যাপারটা তাকে খুব ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। একটা মানুষ গত তিন দিন ধরে ফ্রীজে ঠাণ্ডা হচ্ছে। এটা কেমন বিচার?
ফুলির মা চলে যেতে ধরেছিল। মনিকা তাকে ফিরাল। কঠিন গলায় বলল, যেও না তুমি, দাঁড়াও। একই প্রশ্ন তুমি বার বার করছ কেন? তোমাকে কি আমি বুঝিয়ে বলিনি?
জ্বে বলছেন।
তুমি বুঝতে পারনি?
জ্বে পারছি।
তাহলে কেন বার বার বিরক্ত করছ?
মানুষটা ফিরিজের মইধ্যে থাকব।
মনিকা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, শোন ফুলির মা। ব্যাপারটা সেরকম না। আমার ভাই বোনরা সব দেশের বাইরে। সবাই বাবার ডেড বডি শেষ বারের মত দেখতে চাচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক। সবাই দূরে দূরে থাকে। কেউ আমেরিকা কেউ জাপান। ইচ্ছা করলেই ছুটে আসতে পারে না। অনেক সময় প্লেনের টিকিট পাওয়া যায় না। বুঝতে পারছতো ব্যাপারটা? ওরা যেন শেষ দেখা দেখতে পারে সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে। বাবাকে বারডেমের একটা ঠাণ্ডা ঘরে রাখা হয়েছে। যাতে ডেড বডি নষ্ট না হয়। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
সবাই যখন বাবাকে শেষ দেখা দেখে ফেলবে তখন তাঁকে যথারীতি গোর দেয়া হবে। বুঝতে পেরেছ?
জ্বি পারছি।
দাঁড়িয়ে আছ কেন, চলে যাও। নাকি তোমার আরো কিছু বলার আছে? বলার থাকলে বল। কিন্তু এরপর আর বিরক্ত করতে পারবে না।
জ্বে না। কিছু বলার নাই। কিন্তু আফা ফিরিজের মইধ্যে গোর আজাব ক্যামনে হইব।
কি বললে?
মিত্যুর পরে গোর আজাব হয়। মানকের নেকের আয়। আল্লাপাকের দুই ফিরিশতা। ফিরিজের মইধ্যে…..
তুমি আমার সামনে থেকে যাও ফুলির মা। তুমি আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছ। হোয়াট এ নুইসেন্স।
বিরক্তিতে মনিকার ঠোঁট বেঁকে গেল। তার ভাবতেই খারাপ লাগছে এরকম নির্বোধ একজন মহিলার হাতে শেষ সময়ে তার বাবার দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল। সে নিশ্চয়ই কিছু বুঝতেই পারে নি। শেষ সময়ে শ্বাস কষ্ট হয়, অক্সিজেন দেয়ার দরকার পড়ে। বুদ্ধিমান একজন মানুষ ছুটাছুটি করে ব্যবস্থা করতো। ফুলির মা নিশ্চয়ই সেই ভয়াবহ সময়ে পান খেতে খেতে গল্প জুড়ে দিয়েছে।