বড় মেয়েটার কথা কুদ্দুসের প্রায়ই মনে হয়। তখন মনটা উদাস হয়। মেয়েটা বড়ই সুন্দর ছিল। ছবি দেখার পোকা ছিল। সবসময় ঘ্যান ঘ্যান করতো, বাপজান ছবি দেখব। ছবি দেখা বিরাট খরচান্ত ব্যাপার। তাছাড়া মনোয়ারা পছন্দ করে না। লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েকবার মেয়েকে ছবি দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। ছবির মধ্যে শিক্ষণীয় কিছু নাই। টাকা নষ্ট। তারপরেও শিশুর আব্দার বলে কথা। শিশুদের প্রশ্রয় দিতে নাই কিন্তু তাদের দুএকটা আব্দার রাখতে হয়। এই বিষয়েও নবীজির নির্দেশ আছে, নবীজি শিশুদের স্নেহ করার জন্যে কঠিন নির্দেশ দিয়ে গেছেন। নবীজী বলেছেন, যে শিশুদের স্নেহ করেনা, সে আমার উম্মত।
কুদ্দুস নবীজির নির্দেশ মেনে মেয়েটাকে স্নেহ করেছে। প্রয়োজনের বেশি করেছে। করা উচিত হয় নাই। আরেকটু কম স্নেহ করলে তার মৃত্যুতে কষ্ট কম হত।
তবে আল্লাহপাকের হিসেব ঠিক আছে। মেয়েটা বেশি সুন্দর ছিল। বড় হলে মেয়েকে নিয়ে বিপদ হত। স্নেহ দেখানোতে বিপদ আছে বলেই মজিদকে সে স্নেহ কম দেখাচ্ছে। ইঁদুরের বাচ্চা ধরে দিয়েছে। এতে অনেক খানি স্নেহ দেখানো হয়ে গেছে। কোনো এক ফাঁকে একটা ধমক দিয়ে স্নেহ কমিয়ে দিতে হবে।
বাপজান?
উঁ
ইন্দুর কী খায়?
যা পায় খায়। চিড়া গুড় মুড়ি কাগজ লোহা–খায় না এমন জিনিস নাই। ইন্দুর আর ছাগল দুইজনেই এক পদের-খাওনে উস্তাদ।
মজিদ চোখ বড় বড় করে বাবার কথা শুনে। এতে বড় ভাল লাগে কুদ্দুসের। মনোয়ারা আজকাল আর তার কথা শুনে না। কিছু বলতে গেলে বলে, চুপ যান। দিক কইরেন না।
কুদ্দুসের কথা বলতে ইচ্ছা করে। সংসার ধর্ম করতে হলে কথা বলতে হয়। কথার মধ্যেই থাকে ভাব-ভালবাসা। কথা না থাকলে ভাব-ভালবাসা আসবে কিভাবে? মনোয়ারা সহজ সত্য বোঝে না। তার শুধু রোজগারের চিন্তা। পথের ফকির হওয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে। আমাদের নবীজিও বলতে গেলে পথের ফকির ছিলেন।
বাপজান!
উ।
ইন্দুরটার ক্ষিধা লাগছে।
তোর নিজের লাগছে?
মজিদ লাজুক ভঙ্গিতে হাসে।
কুদ্দুসের বড়ই মায়া লাগে।
তোর মা আসুক ব্যবস্থা হইব। ক্ষিধের কথায় কুদ্দুস নিজেও খানিকটা অস্থির বোধ করে। তার নিজেরও ক্ষিধে হচ্ছে। প্রবলভাবে হচ্ছে। ঘরে খানিকটা চিড়া ছিল। দুপুরে ভিজিয়ে মজিদকে দেওয়া হয়েছে। কুদ্দুসের ধারণা ছিল মজিদ খানিকটা হলেও বাবার জন্যে রেখে দেবে। তা রাখে নাই। বড় মেয়েটা বেঁচে থাকলে অবশ্যই রাখতো। মায়ের জাত তো, চারদিকে নজর না করে এরা খেতে পারে না। এটাও আল্লাহপাকের হুকুমে হয়। আল্লাহপাকের সবদিকে খুব কঠিন নজর।
ক্ষিধে লাগছে বাপজান।
একবারতো শুনছি। এক কথা একশবার বলনে ফয়দা নাই। দিক করিস না।
মজিদ চুপ করে যায়। ইঁদুরের বাচ্চা নিয়ে খেলে। সুতা ধরে ঝুলিয়ে রাখে। ক্ষুদ্র প্রাণীটা ছটফট করে। মজিদ তাতে মজা পায়। কুদ্দুসও আরেকটা বিড়ি ধরায়। বিড়িটা ধরায় ক্ষিধা কমানোর জন্যে। বিড়ি সিগারেটের ধোয়া ক্ষিধার জন্যে বড় উপকারী। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হয়, মনোয়ারা যদি খালি হাতে আসে। কি উপায় হবে? জমানো টাকা সে খরচ করবে না। বড়ই কঠিন মেয়ে। এই টাকায় সে রিকশা কিনবে। কে চালাবে তার রিকশা? কিছুই বলা যায়। না। হয়তো সে নিজেই চালাবে। বড়ই কঠিন মেয়ে। তার অসাধ্য কিছুই নাই। মেয়েটার এখন কিছুটা মাথা খারাপের মত হয়ে গেছে। রোজগারের কোনো পথ দেখছে না। কুদ্দুসকে সে কিছু বলে না। কিন্তু সে বুঝতে পারে।
মনোয়ারা রাত নটার দিকে ফিরলো। মনোয়ারাকে দেখে কুদ্দুসের বুক ধক করে উঠলো। কারণ মনোয়ারার পেছনে ভদ্রলোক কিসিমের এক লোক। পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি, হাতে রুমাল। নাকে চেপে ধরেছে। সেই লোক সন্দেহজনক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দেখছে। খুক খুক করে কাশছে। এই দৃষ্টি, এই কাশি, নাকে চেপে ধরা এই রুমাল কুদ্দুস চিনে। সে বড় বিষণ্ণ বোধ করে।
কুদ্দুস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। বেহেশতে তার একটা সুন্দর সংসার হবে এটা সে ধরেই নিয়েছিল। মজিদ সরিফা আর তার স্ত্রী মনোয়ারাকে নিয়ে অতি সুন্দর সংসার। সেখানে ছবিঘর থাকলে মেয়েটাকে রোজ ছবি ঘরে নিয়ে যেত। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর চারজনে মিলে দাওয়ায় বসে গল্পগুজব। বেহেশতে নিশ্চয়ই চাঁদনি আছে। চাঁদনি পসরে গল্পগুজবের মজাই অন্য। এখন মনে হচ্ছে, বেহেশতের সেই সংসারে মনোয়ারার স্থান হবে না। রোজ হাশরে মনোয়ারা কঠিন বিপদে পড়বে। স্বামীর সুপারিশ সেদিন গ্রাহ্য হবে না। গ্রাহ্য হলে সে অবশ্যই বলতো, আল্লাহপাক, এই মেয়ে তার সংসার বড় ভালোবাসে। সে যা করেছে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্যেই করেছে। স্বামী হয়ে আমি তাকে ক্ষমা করেছি। তুমিও তাকে ক্ষমা করে দিও।
মনোয়ারা কুদ্দুসের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, আফনে মজিদরে লইয়া একটু ঘুইরা আহেন। কুদ্দুস মজিদকে কোলে তুলে নিল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে মনোয়ারা। তার দিকে তাকিয়ে বড় মায়া লাগে কুদ্দুসের। মজিদের হাতে ধরা সুতার মাথায় ইঁদুর ঝুলতে থাকে। মানুষের নিষ্ঠুরতায় সে ইঁদুর বড়ই কাতর বোধ করে।