মজিদ তার সাড়ে চার বছরের ক্ষুদ্র জীবনে অনেক বিস্ময়কর জিনিস তার বাবার কাছ থেকে উপহার পেয়েছে। এমন বিস্ময়কর কিছু পায়নি। ইঁদুরের সুতা ধরে আনন্দে তার প্রায় কান্না পেয়ে গেল।
কুদ্দুস মিয়া পুত্রের আনন্দ কিছুক্ষণ দেখল। তারপর উদাস ভঙ্গিতে একটা বিড়ি ধরাল। তিনটি মাত্র বিড়ি আজ তার সারাদিনের সম্বল। দিন সবে শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই একটা অকারণে খরচ করে ফেলা নিতান্তই বেকুবি। তারপরও কুদ্দুস মিয়া বেকুবিটা করলো। কারণ ছেলের আনন্দিত মুখ দেখে তার মনটা উদাস হয়েছে। মন উদাস হলে বিড়ি সিগারেট টানতে ইচ্ছা করে।
মজিদ বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা ইন্দুর কামড় দেয়?
কুদ্দুস মিয়া না সূচক মাথা নাড়ল। ছেলের সঙ্গে সে কথাবার্তা খুব কম বলে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা কম বলাই নিয়ম। বেশি কথা বললে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক না। প্রশ্রয় পেলে ভয় ভক্তি কমে যায়। কুদ্স মিয়ার ধারণা ছেলেমেয়ে মানুষ করার সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হলো তাদের দিকে একেবারেই নজর না দেওয়া। অকারণে কথা না বলা। কিছুতেই যেন বাবার ভালবাসা এরা টের না পায়। ভালবাসা প্রকাশ করার জিনিস নয়, ভালবাসা গোপন রাখার জিনিস। যে ভালবাসা যত গোপন সেই ভালবাসা তত গভীর। এই যে মজিদ ইঁদুর নিয়ে খেলছে, খেলাটা দেখতে তার। ভাল লাগছে। সেই ভাল লাগা পুত্রের টের পাওয়া খুবই ভুল হবে। কাজেই সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়ি টানতে লাগলো। তার এই ঘর থেকে আকাশ দেখা যায়, এটাও এক আনন্দের কথা। তবে এটাকে ঘর বলা ঠিক হচ্ছে না। পাইপ ঘর বলা যায়। এক মাসের উপর হলো তারা উঠে এসেছে সিউয়ারেজ পাইপে। শুরুতে কুদ্দুসের কঠিন আপত্তি ছিল। পাইপের ভেতর মানুষ থাকে? রাতে ঘুমের মধ্যে পাইপ গড়াতে শুরু করলে তখন? তার ইচ্ছা ছিল মনোয়ারার সঙ্গে সে একটা কঠিন ঝগড়া করে। শেষ পর্যন্ত ঝগড়াটা করলো না, মেয়েছেলের সঙ্গে ঝগড়া করে ফায়দা কি? এরা যুক্তি বোঝে না। আল্লাহ পাক যুক্তি বোঝার ক্ষমতা এদের দেন নাই। তাছাড়া মনোয়ারা সংসারের জন্যে খেটে মরছে। তার সামান্য কথা শুনলে সে যদি খুশি হয়, হোক। মানুষকে খুশি করার মধ্যেও সোয়াব আছে।
মিরপুর ইলেকট্রিক সাব-অফিসের মাঠে জমা করে রাখা গোটা পনেরো পাইপের মধ্যে একটার দখল তারা নিয়েছে। পাইপগুলো দূর থেকে যত ছোট মনে হয় আসলে তত ছোট না। ঝড় বৃষ্টির সময় বড়ই আরাম। বৃষ্টির একটা ফোঁটাও ভিতরে আসে না। পাইপের দুই মাথা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিলেই হলো। সবচে বড় সুবিধা মশার যন্ত্রণা নাই। প্রথম দুই রাত ঘুমাতে একটু কষ্ট হয়েছিল দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছিল। মনোয়ারাকে সে এক সময় বলেই ফেললো, ও বৌ! মনে হইতেছে কবরের ভিতরে শুইয়া আছি। মানকের নেকের আইস্যা সোয়াল জোয়াব শুরু করব।
মনোয়ারা জবাব দেয়নি। স্বামীর অধিকাংশ কথার সে কোনো জবাব দেয় না। এটা এক ধরনের বেয়াদবি। রোজ হাশরে মনোয়ারা এই বেয়াদবির কারণে বিপদে পড়বে। কুদ্দুস ঠিক করে রেখেছে সুযোগ সুবিধা মত বিষয়টা সে স্ত্রীকে বুঝিয়ে বলবে। সে রকম সুযোগ সুবিধা হচ্ছে না। মনোয়ারার মেজাজ খুবই খারাপ যাচ্ছে।
মনোয়ারা কোনো জবাব না দিলেও মজিদ উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, মানকের নেকের কে বাপজান?
কুদ্দুস পুত্রের কৌতূহলে আনন্দিত হয়। মানকের নেকেরের সোয়াল জবাব বিশদভাবে বলতে যায়—
এরা হইল আল্লাহ পাকের দুই ফেরেশতা। এরা আইস্যা পরথমে বলে তোমার রব কে? তারপর বলে কে তোমার রসুল? তারপর বলে…. মনোয়ারা চেঁচিয়ে বলে, চুপ কইরা ঘুম যান। দিক কইরেন না।
এটাও আদবের বরখেলাপ। স্বামীকে ধমক। স্বামী বড়ই আদবের জিনিস, তারে ধমক দেওয়া যায় না। এর জন্যেও রোজ হাশরে মনোয়ারার জটিল অসুবিধা হবে।
মনোয়ারার ধমকে কুদ্দুস খানিকটা উদাস হয়, তবে বিচলিত হয় না। যে সংসারের জন্যে এতো খাটাখাঁটি করে তার কিছু ভুলত্রুটি ক্ষমা’র চোখে দেখা যায়। এই যে থাকার জন্যে পাইপে সংসার পেতেছে, মনোয়ারার জন্যেই সম্ভব হয়েছে। এই সব খোঁজ-খবর সেই রাখে। গত শীতে মিউনিসিপ্যালিটি থেকে কিছু কম্বল দেওয়া হয়েছে। সংখ্যায় অতি অল্প। মনোয়ারা সেই কম্বল দু’টা জোগাড় করে ফেলল–অবিশ্বাস্য ব্যাপার। একটা তারা বিক্রি করেছে বিয়াল্লিশ টাকায়। দর ভাল পেয়েছে। অনেকে কুড়ি পঁচিশ টাকায় বিক্রি করেছে। সেই টাকা জমা আছে–একদিন রিকশা কেনা হবে। মনোয়ারার ধারণা তাদের একটা নিজস্ব রিকশা থাকলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মেয়েছেলে যে কী পরিমাণ নির্বোধ হয় এটা তার একটা প্রমাণ। রিকশা চালানোর শক্তি কি তার আছে? একটা পা বলতে গেলে–অবশ। সে যে দিন রাত ঘরে বসে থাকে–অকারণে থাকে না। উপায় নেই বলেই থাকে। কোনো কারণে পা ঠিক হলেও ঢাকা শহরে মোটর গাড়ির যে উৎপাত এর মধ্যে রিকশা চালানো সহজ কথা? জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার। বেবিট্যাক্সি হলে ভিন্ন কথা ছিল। কলের ইনজিন। চালিয়ে আরাম–চালানোর মধ্যে একটা ইজ্জতও আছে। রিকশাওয়ালাকে সবাই তুই তুমি করে। বেবিট্যাক্সিওয়ালাকে বলে আপনি করে। ইজ্জত ছোট করে দেখার কোনো বিষয় না।
কুদ্দুস অবশ্যি এখনো কিছু বলছে না। সময় হোক, সময় হলে বলবে। রাগারাগি চিৎকার করবে না। মেয়েছেলে অবলা প্রাণী, এদের সঙ্গে রাগারাগি করা যায় না। বুঝিয়ে বলতে হবে। তবে কুদ্দুসের ধারণা, বুঝিয়ে বলারও দরকার হবে না। রিকশার টাকা জমানোতো সহজ কথা না। বিপদ আপদের কি কোনো শেষ আছে? হুট করে একটা বিপদ আসবে–খরচ করো টাকা। গত ভাদ্র মাসে যে রকম বিপদ এসে ঘাড়ের উপর পড়লো, মনে হলে এখনো গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। তারা তখন পাকা দালানে মোটামুটি সুখেই ছিল। কল্যাণপুরে আটতলা দালান হচ্ছিল। কি কারণে কয়েক বছর ধরে কাজ বন্ধ হয়ে আছে। ঐ বাড়ির বিভিন্ন ঘর তাদের মত মানুষরা সেলামী। দিয়ে ভাড়া নিয়ে থাকে। তারাও দুশ টাকা সেলামী দিয়ে চার তলায় উঠে গেল। সিঁড়িতে রেলিং নাই এটাই সমস্যা। অন্ধকারে উঠতে নামতে ভয় ভয় লাগে। পরিবেশও খুব খারাপ, আজেবাজে মেয়েছেলে থাকে। রাত দুপুরে হুল্লোড়। এই সব জায়গায় সংসার করা ঠিক না। তারপরেও ছিল, উপায় কি? তখন বড় মেয়েটা পড়লো অসুখে–কথা নাই বার্তা নাই আকাশ-পাতাল জ্বর। তবে চিকিৎসার ত্রুটি হয় নাই। মনোয়ারা তার জমা টাকার প্রতিটি পাই পয়সা খরচ করেছে। আজেবাজে মেয়ে যে কয়টা ছিল তারাও সাহায্য করেছে। মেয়েটার মৃত্যুর পর আজেবাজে মেয়েগুলোও গলা ফাটিয়ে কেঁদেছে। রোজ হাশরে এই মেয়েগুলোর বিচার হবে। তখন কারো সুপারিশ কাজে লাগবে না। যদি কাজে লাগতো তাহলে অবশ্যই কুদ্দুস সুপারিশ করতো। আল্লাহ পাককে বলতো, ইয়া পরওয়াদেগার ইয়া গাফুরুর রহিম, তুমি এই মেয়েগুলোরে ক্ষমা করে দিও। এরা অভাবে পড়ে মহা অন্যায় করেছে। এই অভাব তোমারই দেওয়া। তুমি অবশ্য পরীক্ষা করার জন্যেই অভাব দিয়েছে। এরা তোমার জটিল পরীক্ষায় পাস। করতে পারে নাই। কিন্তু মেয়েগুলোর অন্তর ভাল ছিল।