নসু বলতে বাধ্য হয়েছে–সে আর আসবে না। সে থাকবে শৃঙ্খলার ভেতরে।
সবচে বেশী শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয় একজন পাগলকে। অন্য কেউ শৃঙ্খলা ভাঙলে কোন অসুবিধা নেই, পাগল ভাঙ্গলেই সমস্যা। দরকার কি? অন্যসব পাগলদের মত সেও ঝামেলাহীন জীবন পছন্দ করে। সারা দিন মনের আনন্দে পৃথিবীর শৃঙ্খলা দেখা। রাতে পায়ের কাছে কালো রঙের কুকুর নিয়ে সুখে দ্রিা। খাওয়া দাওয়া কোন সমস্যা না। হোটেল মালিকরা পাগল পছন্দ করে। পাগলদের খাওয়ালে বিক্রি ভাল হয়। হোটেল চালু থাকে। আয় উন্নতি হয়। কাজেই পাগলদের জন্য হোটেল ভাগ করা থাকে। একেক পাগলের জন্যে একেক হোটেল। নসুর ভাগের হোটেলটার নাম–নিউ ঢাকা কাবাব হাউস। নসু গভীর রাতে কাবাব হাউসের সামনে দাঁড়ায়। তাকে কিছু বলতে হয় না। তাকে দেখা মাত্র হোটেলের মালিক বলে–আসছেরে, নসু পাগলা আসছে। তখন বড় একটা এনামেলের গামলায় আধ গামলা খাবার তাকে দেয়া হয়। কাস্টমা’ররা প্রচুর খাবার নষ্ট করে, তার একটা অংশ নসু পায়। শিক কাবাব, নান রুটি, খানিকটা পরোটা। মুরগীর মাংস। নসুর কাছ থেকে খানিকটা পায় তার কুকুর। দুজনই মহা তৃপ্তিতে খায়। হোটেলের মালিক এই সময় তার সঙ্গে টুকটাক কিছু কথা বলেন। খাবার সময় নসুর কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তবু সে বলে। তার কথা শুনতে লোকটা পছন্দ করে। কি আর করা।
কেমন আছিসরে নসু?
জ্বে, আছি ভাল।
দেশে কবে যেন যাবি?
মাথাটা ঠিক হলেই চলে যাব।
দেশে আছে কে?
বউ আছে। পুলাপান আছে।
দেশ কোথায়?
স্মরণ নাই।
স্মরণ না থাকলে যাবি কি ভাবে?
বউ আইসা নিয়া যাবে।
নসুর এই কথাতে হোটেল মালিক হো হো করে হাসে। তার সঙ্গে অন্যরাও হাসে। এর মধ্যে হাসির কি আছে নসু বুঝতে পারে না। সে পাগল হবার পর বউ এসে তাকে ঢাকায় ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল। এইটাই নিয়ম–পাগল ঘরে পুষা যায় না। শহরে ছেড়ে দিয়ে আসতে হয়। বউও তাই করেছে, শহরে ছেড়ে দিয়ে গেছে। এত বড় শহর খাওয়া খাদ্যের অসুবিধা হবে না। সে সুখে থাকবে।
বউ যখন রেখে গেছে বউ নিয়েও যাবে। এটাইতো স্বাভাবিক। স্বাভাবিক কথা শুনে লোকে হাসবে কেন। নসু বড়ই বিরক্ত হয়। তবে বিরক্তি প্রকাশ করে না। পাগলদের একটা শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়। তাদের যখন তখন বিরক্তি প্রকাশ করলে চলে না।
তোর বউ দেখতে কেমনরে নসু?
আছে, সুন্দর-মুন্দর আছে।
এই কথাতেও সবাই হাসে। এর মধ্যে হাসির কি আছে তাও নসু বুঝতে পারে না। সে পাগল বলে তার বউ সুন্দর-মুন্দর হতে পারে না?
নসু ঠিক করে রেখেছে তার বউ যখন তাকে নিতে আসবে তখন এই হোটেলে তাকে নিয়ে আসবে। হোটেল মালিককে দেখিয়ে নিয়ে যাবে সে মিথ্যা কথা বলে নি।
তোর বউয়ের নাম কিরে?
নাম বলব না।
নাম বলবি না কেন? নাম স্মরণ নাই?
স্মরণ আছে বলব না। পর পুরুষরে পরিবারের নাম বলতে নাই।
বললে অসুবিধা কি?
পর পুরুষরে পরিবারের নাম বললে পরিবার অসতী হয়।
হোটেল মালিক আবারো গলা ফাটিয়ে হাসে। নসুর বিরক্তির সীমা থাকে না।
বল নসু নাম বল। নাম বললে তোকে ফাইভ ফাইভ সিগারেট খাওয়াব।
জ্বে না নাম বলব না।
নসু গম্ভীর হয়ে যায়। পাগল হলেও এইসব বিষয়ে সে খুব সাবধান। ছেলেপুলের নাম জানতে চাইলে সে বলে দেবে কিন্তু পরিবারের নাম বলবে না। মুশকিল হচ্ছে ছেলেপুলের নাম তার স্মরণ নাই। শুধু পরিবারের নামই স্মরণ আছে। তার পরিবারের নাম শরুফা।
শরুফার কথা সে দিনে কখনো মনে করার চেষ্টা করে না। সারা দিন সে শহরে ঘুরে বেড়ায়, শহরের শৃঙ্খলা দেখে। তার বড় ভাল লাগে। প্রতিদিনই চোখের সামনে কত শিক্ষনীয় ব্যাপার ঘটে যায়। নসুর নতুন নতুন জিনিস শিখতে ভাল লাগে। যেমন মাত্র কয়েকদিন আগে সে একটা নতুন জিনিস শিখল–ট্রাফিক পুলিশ যখন দুহাত তুলে তখন রিকশা এবং গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু সাইকেল চলে। কত দিন ধরে সে এই শহরে আছে কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার তার আগে চোখে পড়েনি। যখন চোখে পড়ল তখন বিষ্ময় ও আনন্দে সে অভিভূত হয়ে পড়ল। কি বিচিত্র ব্যাপার! ট্রাফিক পুলিশ ট্রাক, বাস, রিকশা সব আটকাতে পারে কিন্তু সাইকেলের মত দুচাকার একটা সামান্য জিনিস আটকাতে পারে না। তখন শৃঙ্খলার মধ্যে একটা। গন্ডগোল হয়ে যায়। নসুর খুব ইচ্ছা করছিল এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা সে তার কুকুরটাকে বুঝিয়ে দেয়। সেটা সম্ভব না। আল্লাহ পাক পশুদের প্রতি তেমন দয়া। করেননি। শৃঙ্খলার ব্যাপারটা তাদের বোঝার ক্ষমতা দেননি। নসুর সেদিন তার কুকুরটার প্রতি বড় মায়া লেগেছিল। আহারে অবোধ পশু।
নসু ঠিক করে রেখেছে যেদিন সে ভাল হয়ে দেশের বাড়িতে যাবে কুকুরটাকেও নিয়ে যাবে। গ্রামদেশে শহরের মত খাওয়া খাদ্য নাই, তা কি আর করা। অবোধ একটা পশুকে সেতো আর ফেলে রেখে যেতে পারে না।
নসু সারা দিন হাঁটে। মজা করে চারপাশের শৃঙ্খলা দেখে। রাতে ফুটপাতের কোন একটা নিরাপদ কোনায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। তার খুব ভাল ঘুম হয়। হঠাৎ হঠাৎ কোন কোন রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আচমকা মনে হয় শৃঙ্খলায় কোন গন্ডগোল হয়নি তো? কয়েক মুহূর্ত সে আতংকে অস্থির হয়ে থাকে। আঁ আঁ করে বিকট চিৎকার দিতে ইচ্ছা করে। তখনই কুকুরটা কুঁই কুঁই করে শব্দ করে। নসুর মনে হয়–সব ঠিক আছে। শৃঙ্খলা বজায় আছে। কুকুরটার সঙ্গে সে তখন দুএকটা কথা বলে। সে জানে মানুষের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আল্লাহ পাক পশুদের দেননি। তারপরেও কথা বলে। কথা বলতে তার ভাল লাগে–আমার পরিবার যখন আমারে নিতে আসবো তখন তোরেও ইনশাল্লাহ নিয়া যাব। কোন চিন্তা করিস না। আমার পরিবারের নাম হইল–শরুফা। পরিবারের নাম মুখে আনার জন্যে নসু খানিকটা লজ্জা বোধ করে। কাজটা ঠিক হয়নি। তারপরেও তার ভাল লাগে। শরুফার বিষয়ে আরো দুএকটা কথা তার বলতে ইচ্ছা করে। সে বলে না। পশুরা মানুষের জটিল কথা বুঝবে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। তাদের জগতে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরী হবে। কি দরকার?
সংসার
মজিদের বয়স সাড়ে চার বছর। এ বয়সেই সে তার বাবার প্রতিভার একজন মুগ্ধ সমঝদার। আজ তার মুগ্ধতা আকাশ স্পর্শ করেছে। কারণ তার বাবা কুদ্দুস মিয়া তাকে একটা ইঁদুর ধরে দিয়েছে। শুধু ধরে দেয়নি, হঁদুর নিয়ে সে যেন মজা করতে পারে সেই ব্যবস্থাও করেছে। লাল সুতা দিয়ে ইঁদুরের লেজ বাঁধা। সুতা ছেড়ে দিলে ইঁদুর কুট কুট করে হাঁটতে থাকে। সুতা টেনে ইঁদুর কাছে আনা যায়।