.
লাইলী তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। তার বুক ধক ধক করছে। যদি নোটটা না পাওয়া যায়। যদি তারা মনে করে সে নোট নিয়েছে। তখন তারা কি করবে? বেগম সাহেব কি বাড়ি থেকে বের করে দেবেন? ঢাকা শহরে একটা ভাল বাড়ি পাওয়া খুব কষ্টের। এই বাড়িটা ভাল। এই বাড়ির মেয়েটা ভাল। বেগম সাহেবও ভাল। এই বাড়ি ছেড়ে যেতে। তার কষ্ট হবে।
মিতু তার ঘরে এসে দাঁড়াল। লাইলী তাকালো ভয়ে ভয়ে। মিতু বলল, পাওয়া গেছে লাইলী?
জ্বে না আফা।
থাক, আর খুঁজতে হবে না।
টাকা আমি নেই নাই আফা।
টাকা তুমি নাওনি সেটা আমি জানি। টাকা তুমি নেবে কি করে? আমি রাখলে তবে তো নেবে। আমি টাকা রাখিনি। টাকা আমার ব্যাগেই আছে।
লাইলী নির্বোধের মত তাকাচ্ছে। কিছু বুঝতে পারছে না। মিতু হালকা গলায় বলল, টাকার ব্যাপারটা নিয়ে একটা নাটকের মত করে আমি মাকে আটকেছি। বাবাকেও ডেকে আনাচ্ছি, যাতে আজ সারাদিন বাবা, মা আর আমি আমরা তিনজন এক সঙ্গে থাকতে পারি।
লাইলী এখনো কিছু বুঝতে পারছে না। মিতুর মনে হল গ্রামের মেয়েরা আসলে শহরের মেয়েদের চেয়ে বোকা, নয়তো ব্যাপারটা বুঝতে লাইলীর এত সময় লাগার কথা না।
মিতু তার খাটে বসতে বসতে বলল, আজ হচ্ছে আমার বাবা-মা’র ম্যারেজ ডে। তারিখটা মা’র মনে আছে কিন্তু বাবা ভুলে গেছেন। কাজেই বাধ্য হয়ে আমাকে একটা নাটক করতে হল। এখন বুঝতে পারছ?
জ্বে আফা।
আচ্ছা, তাহলে এখন তুমি চলে যাও। আমার খুব মন খারাপ লাগছে। বাবা আসার। আগ পর্যন্ত আমি কাঁদব। তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে। বাবার গাড়ি দেখলেই আমার দরজায় টোকা দেবে। সঙ্গে সঙ্গে আমি কান্না বন্ধ করব। পারবে না?
পারুম আফা।
মিতু দরজা বন্ধ করে তার সিডি প্লেয়ারে লাবাম্বা জিপসী গান ফুল ভলমে দিয়ে দিল। হৈ-চৈ ধরনের গান ছাড়া সে কাঁদতে পারে না। পুরো ফ্ল্যাট বাড়ি কাঁপিয়ে জিপসী ব্যান্ড গাইছে–লাবাম্বা। লাবাম্বা। মিতু তার বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
শৃঙ্খলা
নসু অনেক্ষণ হল জেগেছে। চাদরের নিচ থেকে এখনো মাথা বের করছে না। এমন কিছু তাড়া নেই। এক সময় মাথা বের করলেই হল। তাছাড়া চাদরের ভেতর শুয়ে থাকতে ভাল লাগছে। শান্তি শান্তি লাগছে। নিজেকে নিরাপদ লাগছে। চাদরটা তার মাথার উপর এল কি করে তা অবশ্যি তার মনে নেই। রাতে যখন ঘুমুতে গিয়েছিল তখন কি ছিল? মনে পড়ছে না। মনে না পড়লে নেই। এটা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। নসু শুয়েছিল কুভুলি পাকিয়ে। সে তার ডান পা-টা ছড়িয়ে দিল। সমস্যা একটাই, এতে তার পা চাদরের ভেতর থেকে বের হয়ে পড়বে। চাদরের নিরাপদ আশ্রয় থেকে পা-টা বের করা কি ঠিক হবে? জগৎটাতো খুব সহজ জায়গা না। কোত্থেকে কি হয় কে জানে। তারপরেও তার চারপাশের জগৎটা ঠিক আছে কিনা তা জানার জন্যেই কাজটা তাকে করতে হচ্ছে। নরম কোন জিনিসের সঙ্গে পায়ের ধাক্কা লাগার কথা। ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে নরম জিনিসটার ঘেউ করে একটা শব্দ করার কথা। যদি উঠে তবে বুঝতে হবে সব ঠিক আছে।
পায়ের সঙ্গে নরম জিনিসটার ধাক্কা লাগল। জিনিসটা একবার ঘেউ করেই কুঁই কুঁই শব্দ করতে লাগল। ঠিক আছে, সব ঠিক আছে। কোন অনিয়ম হয়নি। পায়ের কাছে কুকুরটা ঠিক আছে। পরিপূর্ণ নিয়ম ও শৃঙ্খলার ভেতর শুরু হতে যাচ্ছে আরেকটি দিন। নসু তার পা দিয়ে কুকুরটাকে আরেকটা ধাক্কা দিল। আবারো কুঁই কুঁই শব্দ হল। আহারে, কুকুরটা কি সুন্দর করেই না কুঁই কুঁই করে।
নসু চাদরের ভেতর থেকে মাথা বের করল। মাথার উপর ঝকঝকে নীল আকাশ। এত নীল যে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, চোখে ধাঁধা লাগে। মাথা ঝিম ঝিম করে। নসু চোখ ফিরিয়ে নিল। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে তাকালো সোজাসুজি। রাস্তায় লোক চলাচল করছে, রিকশা চলছে, হুস হাস করে গাড়ি যাচ্ছে। বাহ কি সুন্দর। চলমান জীবন দেখার আনন্দই অন্য রকম। নসু চোখে পলক পর্যন্ত ফেলে না। মনে হয় পলক ফেললেই মজাদার কিছু দেখা হবে না। এক পলকে অনেক কিছু হতে পারে।
নসু কোমরের নিচে হাত দিল। গায়ে কাপড় আছে কি না চট করে দেখে নেয়া। গায়ে কাপড় না থাকলে চাদরটা কোমরে জড়াতে হবে। নগ্ন অবস্থায় হাঁটাহাঁটি করা যাবে না। শহরের কিছু লোক আছে যারা নগ্ন মানুষ পছন্দ করে না। মা’রধোর পর্যন্ত। করে। সে যতবার নগ্ন অবস্থায় বের হয়েছে ততবার মা’র খেয়েছে।
নসু হাত দিয়ে দেখল তার পরনে একটা প্যান্ট। প্যান্টের যেখানে বেল্ট থাকার কথা সেখানে দড়ি বাঁধা। বেশ শক্ত করেই বাঁধা। কেউ একজন বেঁধে দিয়েছে। বাঁধাবাঁধির কাজ সে আজকাল করতে পারে না। বড়ই বেড়া ছেঁড়া লাগে। তার নিজস্ব জগতে সে বেড়া ছেঁড়া চায় না। সে চায় শৃঙ্খলা। মেয়েদের স্কুলের সামনে আগে সে প্রায়ই গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আজকাল যায় না। শৃঙ্খলার কারণেই যায় না। ফুটফুটে সব মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে কত ভাল লাগতো দেখতে। মাঝে মাঝে হেসে একজন আরেকজনের গায়ে গড়িয়ে পড়তো–আহা কি মধুর দৃশ্য। ওরা কথাও বলতো কি সুন্দর করে—ঐ দেখ পাগলা। ঐ যে পাগলা। ও মাগো, পাগলা হাসে। কি ভয়ংকর! পাগলা হাসছে।
নসু হাসতো ঠিকই। এরকম সুন্দর সুন্দর দৃশ্য চোখের সামনে দেখলে না হেসে পারা যায়? হাসার কারণেই শৃঙ্খলায় গন্ডগোল হয়ে গেলো। সে সবার নজরে পড়ে গেলো। মারের চোটে জীবন যাওয়ার উপক্রম। মারের সঙ্গে কি সব কঠিন কঠিন কথাবল হারামজাদা আর মেয়েছেলের দিকে নজর দিবি? জাতে পাগল তালে ঠিক। জায়গামত চলে আসে। হারামজাদা চোখ গেলে ফেলব, তখন জন্মের দেখা দেখবি।