আপনার বাবা তাহলে বিপদ আপদে আপনাকে সতর্ক করে দেন।
হ্যাঁ করেন।
ভাল তো।
মোটেই ভাল না। উনি আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। অতি তুচ্ছ ব্যাপারেও উনি নাক গলান। একবার ব্যাংককে গিয়েছি। ব্যাংককের ম্যাসাজ পার্লারের এত নামডাক। ভাবলাম দেখি ব্যাপারটা কি? দু হাজার বাথ দিয়ে টিকিট করলাম। পার্লারে ঢুকতে যাচ্ছি–হঠাৎ বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, বাবলু ছিঃ বাবা। এসব কি? ম্যাসাজ না নিয়ে চলে এলাম। দুহাজার বাথ জলে গেল। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক, তিনি তার স্কুল শিক্ষকের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। আমি তাঁর কাছ থেকে মুক্তি চাই। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই। তাঁকে যে এখন আমি কি পরিমাণে ঘৃণা করি তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।
ঘৃণা করেন?
অবশ্যই করি। আপনি হলেও করতেন। বাবার কারণে আমাকে গ্রামে হাই স্কুল দিতে হয়েছে। রাস্তা করে দিতে হয়েছে। এতিমখানা করতে হয়েছে। লোকে ভাবছে আমি বোধহয় ইলেকশন করব। গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করছি। আসল ব্যাপার হল আমার বাবা। সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান–স্কুল করে দে। কলেজ করে দে। এতিমখানা করে দে। অসহ্য। এখন ধরেছেন হাসপাতাল করতে হবে। একশ বেডের হাসপাতাল। একশ বেডের হাসপাতালে কত টাকা লাগে তা উনার কল্পনার মধ্যেও নেই। টাকা গাছে ফলছে না। টাকা কষ্ট করে উপার্জন করতে হচ্ছে।
হাসপাতাল করছেন?
উপায় কি, করতে তো হবেই। সাভারে নব্বই একর জমি নিয়েছি। আরো নিতে হবে।
রকিব সাহেব হঠাৎ গাড়ির গতি কমিয়ে ষাট কিলোমিটারে নিয়ে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত গলায় বললেন, স্পীড বেশি দেয়ার জন্যে বাবা দারুণ হৈ চৈ শুরু করেছেন।
তারপর তিনি আমার দিকে ঝুঁকে এসে প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, যখন বাবার গলা শুনতে ইচ্ছা করে তখন আমি ইচ্ছা করে স্পীড দেই। ডেঞ্জারাস টার্ন নেই। বাবা ধমক দেন। উনার গলা শুনে ভাল লাগে।
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে রইলাম। রকিব সাহেব বললেন, আপনি যে বললেন সাইকোলজিকেল–সেটা হতে পারে। বাচ্চা বয়সে একটা ভয়াবহ মৃত্যু দেখেছি, আমার মাথার ভেতর সেটা ঢুকে মাথাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে চিকিৎসা করালে হয়তো সুস্থ হব। আমি কিন্তু চিকিৎসা করাতে চাই। আমি চাই এই ব্যাধি আমার থাকুক। আমৃত্যু থাকুক। এই চাওয়াটা কি অন্যায়?
না অন্যায় না।
ভাই, আপনি আমার হাসপাতালটার জন্যে খুব সুন্দর একটা নাম দেবেন। আমি আমার বাবার নামে হাসপাতাল দিতে চেয়েছিলাম। বাবার তাতে ভয়ংকর আপত্তি। রেগেমেগে এমন ধমকানো আমাকে ধমকিয়েছেন–মনে করলেই হাসি আসে-হা হা হা। হা-হা-হা।
রকিব সাহেব প্রাণ খুলে হাসছেন। ব্যাধিগ্রস্ত কোনো মানুষকে আমি এত সুন্দর করে কখনো হাসতে দেখিনি।
লাবাম্বা
মিতুর ঘর থেকে তীক্ষ্ণ চিৎকার–মা, আমার টাকা?
মিতুর মা আফরোজার অফিসের গাড়ি চলে এসেছে, নিচ থেকে হর্ণ দিচ্ছে। তার দাঁড়াবার সময় নেই। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, কি হল?
আমার টাকা কোথায় গেল মা?
আমি কি জানি কোথায় গেল।
টেবিলের উপর রেখে বাথরুমে মুখ ধুতে গেছি….
কত টাকা?
পাঁচশ টাকার একটা নোট। আজ আমি বন্ধুদের চটপটি খাওয়াব। কে আমার টেবিল থেকে টাকা নেবে?
আফরোজা কথা বাড়াতে চাইছেন না। অফিসের মাইক্রোবাস অপেক্ষা করছে। সহকর্মীরা নিশ্চয়ই বিরক্তমুখে বসে আছেন। সেদিন কথায় কথায় রমিজ সাহেব বলেছেন–তার এগারো বছরের চাকরি জীবনে এ রকম না কি কখনো হয়নি যে, গাড়ি হর্ণ দিয়েছে আর মহিলা সহকর্মী নেমে এসেছেন। শেষ মুহূর্তেও মহিলাদের না-কি কিছু কাজ বাকি থাকে।
আফরোজা মেয়ের ঘরে এসে ব্যাগ খুলে টাকা বের করলেন। মিতু বললো, তুমি ময়লা টাকা দিচ্ছ কেন? আমি ময়লা টাকা দিয়ে বন্ধুদের চটপটি খাওয়াবো না। আমি এই টাকা নেব না।
নতুন টাকা আমি এখন পাব কোথায়?
সেটা আমি জানি না। তুমি আমাকে চকচকে নতুন একটি নোট দিয়ে তারপর অফিসে যাবে। নয়তো তোমাকে আমি ঘর থেকে বেরুতে দেব না। দরজা বন্ধ করে আটকে রাখবো।
মিতু এবার ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। তার আচার আচরণ কাজকর্ম সবই এখনো স্কুলের মেয়ের মত। সে সত্যি সত্যি দরজা বন্ধ করে দেবে। নিচ থেকে ক্রমাগত গাড়ির হর্ণ ভেসে আসছে। আফরোজার কাছে ঝকঝকে টাকা নেই। যন্ত্রণায় পড়া গেল।
মিতু খাটে বসে আছে। হাসিমুখেই বসে আছে। পা নাচাচ্ছে। তার গায়ে তার বাবার একটা শার্ট।
মা, আমাকে অফিসে যেতে হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
হোক দেরি।
এই দুশ টাকা রেখে দে। এই নোট দুটি তো মোটামুটি পরিষ্কারই আছে।
অসম্ভব। আমি মাত্র দুশ টাকা নিয়ে যাব?
তুই বড় যন্ত্রণা করিস মিতু। আমি কি অফিসে যাব না?
না।
কী যে তুই পাগলের মত বলিস।
আমি যদি ইউনিভার্সিটিতে যেতে না পারি, তুমিও পারবে না।
ঘরে বসে থেকে আমি কি করবো?
আমার টাকা কোথায় গেল খুঁজে বের করবে।
আফরোজা কাজের মেয়ে লাইলীকে নিচে পাঠালেন। সে বলে আসবে তিনি আজ অফিসে যাবেন না। তার শরীর ভাল না। জ্বর আসছে।
মিতু পা নাচানো বন্ধ করে বলল, টাকাটা লাইলী নেয়নি তো মা? ঘরে আমরা চারজন মাত্র মানুষ। আমি তুমি লাইলী আর জিতুর মা। তুমি নিশ্চয়ই নাওনি। বাকি থাকছে লাইলী আর জিতুর মা। জিতুর মা নেবে না কাজেই কালপ্রিট হচ্ছে লাইলী।